আজ ৮ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৩শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

সনদ পেতে ভোগান্তির শেষ নাই চাপে আছে দায়িত্বপ্রাপ্ত চসিকের ১৩ কর্মকর্তা ।


নিজস্ব প্রতিবেদক >>> চট্টগ্রামের সরকারি বেসরকারি এমন কোন প্রতিষ্ঠান নেই দুর্নীতি চলতেছে না,তারই অংশবিশেষ।স্কুল শিক্ষিকা কুলসুমা আকতার দুই কন্যাসন্তান রেখে মারা যান মাস কয়েক আগে। ব্যাংকে কিছু টাকা আছে। এখন ব্যাংকের টাকা উত্তোলনের জন্য প্রয়োজন দেখা দেয় ওয়ারিশান সার্টিফিকেটের। কিন্তু দিনের পর দিন ঘুরেও তার দুই কন্যা ওয়ারিশান সার্টিফিকেট যোগাড় করতে পারেননি। ব্যাংকে মায়ের টাকা থাকলেও সেই টাকা ওঠাতে পারছেন না তারা।

শুধু কুলসুমার কন্যারা নন, এভাবে নগরীর ৪১ ওয়ার্ডে অসংখ্য মানুষ ভোগান্তিতে আছেন বলে জানা গেছে । কারো ওয়ারিশান সার্টিফিকেট, কারো জন্মনিবন্ধন, কারো মৃত্যুসনদ, কারো অবিবাহিত সনদসহ ওয়ার্ড কাউন্সিলর অফিসের রুটিন কাজগুলোতে স্থবিরতা বিরাজ করছে। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ১৩ জন কর্মকর্তাকে স্বাভাবিক কাজের বাইরে ওয়ার্ড কাউন্সিলের রুটিন ওয়ার্কের দায়িত্ব দেওয়া হলেও নাগরিক হয়রানি মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। প্রতিটি ওয়ার্ড অফিসে একজন করে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হলে এই সংকটের বহুলাংশে সুরাহা হতো বলে সংশ্লিষ্টরা মন্তব্য করেছেন। ছাত্র–জনতার গণঅভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর সিটি কর্পোরেশনের ৪১টি ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পালিয়ে গেছেন। আওয়ামী লীগ দলীয় এসব কাউন্সিলর অধিকাংশই মামলার আসামি। কাউন্সিলররা পালিয়ে যাওয়ার পর স্বাভাবিকভাবেই সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। ৫ আগস্টের পর থেকে নগরীর সবগুলো ওয়ার্ডের রুটিন কার্যক্রম মুখ থুবড়ে পড়ে। এতে করে ৪১টি ওয়ার্ডের হাজার হাজার মানুষ ভোগান্তিতে পড়েন। বিষয়টি অনুধাবন করে অন্তবর্তী সরকার ৭ অক্টোবর জারি করা এক আদেশে ৮ অক্টোবর থেকে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ১৩ জন কর্মকর্তাকে তাদের স্বাভাবিক দায়িত্বের বাইরে ওয়ার্ড কাউন্সিলরের রুটিন ওয়ার্ক করার বাড়তি দায়িত্ব দেয়। উক্ত আদেশে রাজস্ব কর্মকর্তা ছাব্বির হাসান সানি ১, ২ ও ৩; প্রধান শিক্ষা কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম ৪, ৫ ও ৬; প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা কমান্ডার লতিফুল হক কাজমী ৭ ও ৮; আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা রেজাউল করিম ৯, ১০, ১১, ১৩, ও ২৬; নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট জিল্লুর রহমান ১২ ও ৩৭; আইন কর্মকর্তা জসিম উদ্দিন ১৪ ও ১৫; প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম ১৬, ১৭ ও ২০; আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা শাহরীন ফেরদৌসী ১৮, ১৯, ২২, ৩২ ও ৩৩; আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা রক্তিম চৌধুরী ২১, ২৩, ২৫, ২৮ ও ৩৬; সিটি কর্পোরেশনের সচিব আশরাফুল আমিন ২৪, ২৭ ও ৩৮; স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট মনিষা মহাজন ২৯ ও ৩০; শিক্ষা কর্মকর্তা রাশেদা আক্তার ৩১, ৩৪ ও ৩৫ এবং নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট চৈতি সর্ববিদ্যাকে ৩৯, ৪০ ও ৪১ নম্বর ওয়ার্ডের দায়িত্ব দেওয়া হয়। উপরোক্ত ১৩ জন কর্মকর্তার সকলে সিটি কর্পোরেশনের গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রমের সাথে জড়িত। নিজেদের দায়িত্ব পালনের পর তাদের একজনকে কয়েকটি ওয়ার্ডের রুটিন ওয়ার্কের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু এতগুলো দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এসব কর্মকর্তার দিশেহারা হওয়ার উপক্রম বলে একাধিক কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন। তারা বলেন, অফিসে প্রচুর কাজ থাকে। এর বাইরে ওয়ার্ড অফিসের কাজগুলো করতে গিয়ে বেগ পেতে হচ্ছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা যতটুকু বেগ পাচ্ছেন তার চেয়ে হাজার গুণ বেশি ভুগছেন নগরীর সাধারণ মানুষ। যাদেরকে একটি সনদের জন্য দিনের পর দিন ঘুরতে হচ্ছে।

প্রান্তিক পর্যায়ের প্রশাসন হিসেবে ওয়ার্ড কাউন্সিলরের অফিস গুরুত্বপূর্ণ। এখানে স্বাভাবিকভাবে প্রতিদিন যেসব কাজ হয় সেগুলো স্পর্শকাতর। জাতীয়তা সনদ, জন্মনিবন্ধন, জন্মনিবন্ধন সংশোধন, ওয়ারিশান সনদ প্রভৃতির ওপর অনেক কিছু নির্ভরশীল। এসব সনদ দিয়ে রোহিঙ্গারা যেমন জাতীয়তা লাভ করতে পারে, তেমনি ওয়ারিশান সনদের গোলমালে কাউকে বঞ্চিতও হতে হয়। পিতার সম্পত্তি বা টাকা থেকে বোনদের বাদ দিতে গোঁজামিল দিয়ে ওয়ারিশান সনদ নেওয়ার অনেক ঘটনা ঘটেছে। আবার জাতীয়তা সনদ নিয়ে অনেক রোহিঙ্গা বাংলাদেশের পাসপোর্ট বানিয়েছে।

আবার সনদ না পেয়ে অনেকে পাসপোর্ট করা, জমিজমার বিলিবণ্টন, স্থাবর–অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রি, এফডিআর, ডিপিএস কিংবা ব্যাংকে জমা টাকা উত্তোলনসহ নানা ধরনের জরুরি কাজ সারতে পারছেন না। নগরীর ৪১ ওয়ার্ডের শত শত মানুষকে ভোগান্তিতে সময় পার করতে হচ্ছে।

একজন ওয়ার্ড কাউন্সিলর এলাকার সরাসরি ভোটে নির্বাচিত একজন রাজনৈতিক নেতা। এলাকার মানুষের সাথে থাকে তার নিবিড় যোগাযোগ। তিনি প্রত্যেককে চিনেন অথবা চিনে নিতে পারেন, যা সিটি কর্পোরেশনের একজন কর্মকর্তার পক্ষে সম্ভব হয় না। তাই ওয়ার্ড অফিসে কেউ কোনো সনদের জন্য আবেদন করলে সেটি যাচাই–বাছাইয়ের নামে দিনের পর দিন ঘুরতে হচ্ছে। একটি ওয়ারিশান সার্টিফিকেট প্রদানের আগে তিনজন ব্যক্তিকে শনাক্ত করতে হয়। এর মধ্যে একজন সিটি কর্পোরেশনের ট্যাঙ কালেক্টর। এখন ট্যাঙ কালেক্টরকে পাওয়া গেলে অপর দুজনকে পাওয়া যায় না, আবার অপর দুজনকে পাওয়া গেলে ট্যাঙ কালেক্টর নিজের কাজে বাইরে থাকেন। এতে করে দিন গড়ায়, কিন্তু সনদের দেখা মিলে না। আবার তিনজনের শনাক্তকরণ সম্পন্ন করেও অনেক সময় নাগাল পাওয়া যায় না সিটি কর্পোরেশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার।

মানুষের ভোগান্তির কথা স্বীকার করে তিনটি ওয়ার্ডের দায়িত্বে থাকা একজন কর্মকর্তা আজাদীকে বলেন, আসলেই মানুষের কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু আমার তো কিছু করার নেই। হাত–পা বাঁধা। আমি কাউকে চিনি না, জানি না। কাকে সনদ দিচ্ছি সেটা তো নিশ্চিত হতে হবে। না হয় পরে আমাকেই জেলে যেতে হবে।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, প্রতিটি ওয়ার্ডেই লাখ লাখ মানুষের বসবাস। এই বিপুল সংখ্যক মানুষের মাঝ থেকে একজন গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিকে উক্ত ওয়ার্ড কাউন্সিলরের পদে প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দিয়ে নির্বাচন পর্যন্ত কাজ করালে মানুষের ভোগান্তি থাকত না। বিশেষ করে রুটিন ওয়ার্কগুলো তথা সনদ নিয়ে যে ভোগান্তি তার অবসান হতো।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     এই বিভাগের আরও খবর