আজ ১১ই বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ২৪শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

কক্সবাজার আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে অনিয়ম ও দুর্ণীতির অভিযোগ


আবদুর রাজ্জাক, জেলা প্রতিনিধি, কক্সবাজার।।  ভবনের প্রবেশ পথ থেকে শুরু করে ছাদ পর্যন্ত পোস্টারে লেখা- দালাল ও প্রতারক নিষিদ্ধ, এদের  থেকে দূরে থাকুন। বাস্তবে দালাল ছাড়া “পাসপোর্ট ” আবেদনের ফাইল নড়ে না। সেবা গ্রহীতারা সেবার নামে প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হলেও  নেই কারো মাথাব্যথা এ নিয়ে । কক্সবাজার আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের প্রতিদিনকার চিত্র এরকমই। র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কয়েকদফা অভিযান চালিয়ে বেশ কয়েকজন দালাল গ্রেফতার করে। কিছু দিন ঠিকঠাক থাকলেও ফের দলালদের দৌরাত্ম্য বেড়েছে। জানা যায়, অফিস সহকারী ও কম্পিউটার অপারেটর মো: আল মামুন ও নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আনসার সদস্যরা পাসপোর্ট প্রত্যাশীদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত অশালীন আচরণ করে তাদের জিম্মি করে রেখেছে। আর এসব অভিযোগ নিয়ে সহকারী পরিচালকের কাছে গিয়েও মিলে না সুরাহা। তিনি উল্টো কক্সবাজারের পাসপোর্ট অফিসের নিয়মনীতি সম্পর্কে কিছুই জানেন না বলে এক শব্দ উত্তর দিয়ে তাড়িয়ে দেন। এমন অভিযোগ অনেক সেবা প্রার্থীর। একাধিক সেবা প্রার্থীরা জানান, দালাল না ধরে নিজে পাসপোর্টের জন্য আবেদন করলে পদে পদে হয়রানির শিকার হতে হয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে আবেদনপত্র জমা দেওয়ার পর ভুল ধরে কর্মকর্তারা সেটি গ্রহণ করেন না। আবার সংশোধন করে জমা দিলেও আরেকটি ভুল ধরা হয়। এভাবে ভুল শুধরে আবেদন জমা দিতে দিনের পর দিন ছোটাছুটি করতে হয়। তবে দালাল ধরে আবেদন করলে আবেদনপত্রে বিশেষ চিহ্ন দেওয়া থাকে। তখন ভুল ধরা হয় না। এতে একদিনেই ফিঙ্গারপ্রিন্ট, ছবি তোলার সুযোগসহ দ্রুত পাসপোর্ট পাওয়া যায়।’অনুসন্ধানে জানা গেছে, অফিস সহকারী ও কম্পিউটার অপারেটর মো: আল মামুন এবং নিরাপত্তা কর্মীরা ছাড়া পাসপোর্ট প্রত্যাশীদের আবেদনপত্রের ফাইল নড়ে না। তাদের সাথে রয়েছে ১০ সদস্যের একটি সংঘবদ্ধ দালাল চক্র। আর এসব দালালদের মধ্যে রয়েছে তাদের সখ্যতা। দালাল চক্র কন্ট্রাকে পাসপোর্ট নিয়ে ফাইলের উপর একটি সংকেত চিহ্ন বসিয়ে দেওয়া হয়। আর সেই সংকেত চিহ্ন দেখেই ফাইল জমা নিয়ে নেন অফিস সহকারী ও কম্পিউটার অপারেটর মো: আল মামুন। আর যারা সরাসরি পাসপোর্ট আবেদন ফাইল জমা দিতে যান তাদের পাসপোর্ট আটকে দেওয়ার হুমকি ধমকি ও দেন তারা।অভিযোগ রয়েছে, উপ-পরিচালক মোবারকের নির্দেশে কয়েকজন আনসার সদস্যদের মাধ্যমে দালালদের সঙ্গে লেনদেন করে। প্রতিটি পাসপোর্ট করে দেওয়ার জন্য সরকারি ফি বাদে গ্রাহকদের কাছ থেকে ১ থেকে ২ হাজার টাকা নেওয়া হয়। এই টাকা পাসপোর্ট গ্রহণকারীর কাছ থেকে সরাসরি নেওয়া হয় না। দালালের মাধ্যমে নেওয়া হয়।এদিকে কম্পিউটার অপারেটর মো: আল মামুন কক্সবাজার আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের কম্পিউটার অপারেটর মোঃ আল মামুনের অনিয়ম, দুর্ণীতি ও অসৌজন্যমূলক আচরণের বিরুদ্ধে আইনানুগ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কক্সবাজার জেলা প্রশাসক, মহাপরিচালক, ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর, ঢাকা ও দূর্ণীতি দমন কমিশন, ঢাকার নিকট লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন কক্সবাজার সদর উপজেলার ঝিলংজা ইউনিয়নের দক্ষিণ ডিককুল ২ নং ওয়ার্ডের মৃত আশরাফুজ্জামানের ছেলে নুরুল আবছার। অভিযোগকারী নুরুল আবছার জানান, বিগত ০৫/০৩/২০২৫ খ্রি. তারিখ আমার এক আত্মীয় ১ বছরের বাচ্ছার পার্সপোর্ট করার জন্য কক্সবাজার পাসপোর্ট অফিসে যাই। পার্সপোর্ট ফরমসহ, ব্যাংক ড্রাফটসহ চাহিত যাবতীয় কাগজপত্রাদি নিয়ে পার্সপোর্ট অফিসের নীচ তলায় গ্রাহকের ছবি তোলার স্থানে বিষয়ে মোঃ আল মামুন, পিতা- মোঃ সেলিম, মাতা- নূর বাহার, সাং- রাঙ্গুনিয়া পৌরসভা, ৮নং ওয়ার্ড, চট্টগ্রাম। আমার দেওয়া পাসপোর্ট ফরমে পিতা ও মাতার নাম ঠিক নাই বলে ফেরৎ দেন। আমি যাবতীয় কাগজপত্রাদি প্রদানের পরও তিনি আমার কোন কথা না শুনে, আমাদের সেবা না দিয়ে অন্য কাজ করতে থাকেন। এক পর্যায়ে সে আমার কাছ থেকে দশ হাজার টাকা দাবী করেন। আমি টাকা না দ্বিতীয় তলায় পরিচালককে জানালে তিনি নিজে এসে বিষয়টি সমাধান করে দেন এবং ছবি তুলে দেন। আমি পরিচালকের কাছে গেছি কেন? ক্ষমতা দেখাচ্ছি বলে সে আমার উপর চড়াও হন এবং অকথ্য ভাষায় গাল মন্দ করেন এবং বলতে থাকেন এখানে আমি যা বলি তাই হবে, তোদের মত লোকদের মেরে, বেঁধে পুলিশে দিই, এই বালের চাকুরী না করলে আমার কিছুই আসে যায় না বলে চিৎকার করে আমাদের ধমকাতে থাকেন । উপস্থিত বিভিন্ন লোকজন জানান যে, সে বিভিন্ন অযুহাত দেখিয়ে মানুষকে হয়রানি করে এবং যে কোন একটি বিষয়ে ঠেকিয়ে তার নিজস্ব লোকজন নিয়ে টাকা আদায় করেন। সকাল থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে একজন জন ব্যক্তি বিকাল ৪ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থেকে ফেরত আসা সহ নানা ধরণের অনিয়ম ও দূর্নীতির স্বীকার সাধারণ জনগণ। তিনি আরো জানান, এই অফিসে প্রায় ৬ মাসে বিভিন্ন সোর্সের মাধ্যমে অবৈধভাবে প্রায় ১ কোটি টাকা আয় করেন। আমরা ফ্যাসিস্ট সরকার পতনের পরও পাসপোর্ট অফিসের এইরকম জঘন্য কর্মচারীর আচরণ বর্তমান সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করার কৌশল মাত্র। আমি এই কর্মচারীর বিরুদ্ধে আইনানুগ প্রয়োনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জোর দাবী জনান। পাসপোর্ট করতে আসা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক যুবক জানান, মঙ্গলবার নতুন পাসপোর্ট আবেদন ফরম নিয়ে জমা দিতে যান ১০১ নং কক্ষে তার ফাইলে সব কাগজপত্র ওকে ছিল। কিন্তু কোন মাধ্যম ছাড়া পাসপোর্ট করতে যাওয়া আমার ফাইলটি তিন দিন ধরে ফেরত দেওয়া হয়। অবশেষে চতুর্থ দিন গেলে কম্পিউটার অপারেটর আল মামুন ধমক দিয়ে বললো ফাইলটি আর গ্রহণ করা হবে না। নানা অজুহাত দেখিয়ে সব কাগজপত্র মূল কপি আনতে হবে বলে তাড়িয়ে দেয়। পরে সেখানের এক কর্মকর্তার মাধ্যমে ১ হাজার টাকার বিনিময়ে অবশেষে আবেদন ফাইলটি জমা নেন। অনুসন্ধানে জানা যায়, নতুন পাসপোর্টের আবেদন দালাল চক্র মাধ্যমে না গেলে নানা অজুহাতে জমা নেন না । আর দালাল মধ্যমে দিলে গুনতে হয় অতিরিক্ত ৫—১০ হাজার টাকা যার একটি অংশ পৌঁছে যায় সংঘবদ্ধ দালাল চক্র মাধ্যমে অফিস কর্মকর্তাদের হাতে। আর পুরনো আর দালাল মধ্যমে দিলে গুনতে হয় অতিরিক্ত ৫—১০ হাজার টাকা যার একটি অংশ পৌঁছে যায় সংঘবদ্ধ দালাল চক্র মাধ্যমে অফিস কর্মকর্তাদের হাতে। আর পুরনো পাসপোর্ট রিনিউ করতে লাগে ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা। এদিকে পরিচয় গোপনে সাইদ নামে এক দালালের সঙ্গে একটি নতুন পাসপোর্ট করে দেওয়া নিয়ে কথা হয়।তিনি জানান, সরকারি নির্ধারিত ফি জমা দেওয়ার পর তাকে দিতে তাকে দিতে হবে ৫ হাজার টাকা এতে ১ সপ্তাহের মধ্যে মিলবে ভোগান্তি ছাড়া পাসপোর্ট।তারা বলেছেন, এই পাসপোর্ট কার্যালয়ে পদে পদে হয়রানির শিকার হচ্ছেন আবেদনকারীরা। প্রতিদিন গড়ে শত শত লোকজন পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেন। এর মধ্যে বেশিরভাগ দালালের শরণাপন্ন হন। এতে সরকারি ফির অতিরিক্ত খরচ হয় ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা। কোনও জটিলতা থাকলে পাসপোর্ট পেতে আরও বেশি টাকা দিতে হয়। দালাল না ধরে নিজে পাসপোর্টের আবেদন করলে জমা দেওয়া এবং ডেলিভারি বুথে হয়রানির শিকার হতে হয়।হয়রানির অভিযোগ জানাতে কর্মকর্তা (এডি) মোবারক হোসেনের সাক্ষাৎও পান না তারা। কখনো সাক্ষাৎ পেলে তিনি দেখান নানান যুক্তি। এক প্রকার এডি মোবারক নিজেই দালাল ধরতে বাধ্য করেন সেবা প্রার্থীদের। জানা গেছে, কক্সবাজার আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের উপ-পরিচালক মোবারক হোসেনের আচরণ অনেকটা সামন্ত প্রভুর মতো। তার নির্দেশ ছাড়া পাসপোর্ট অফিসের ভেতরে বাইরে পান থেকে চুনও খসেনা কেউই।এসব অভিযোগের বিষয়ে কক্সবাজার পাসপোর্ট অফিসের সহকারী উপ-পরিচালক মোবারক হোসেনের ও অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর মো আল মামুনের মুঠো ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ চেষ্টা করেও তারা কেউ ফোন রিসিভ না করায় তাদের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি । জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালহ্উদ্দিন বলেন, বিষয়টি উদ্বেগজনক। সেবার বিনিময়ে কেউ টাকা নিয়ে থাকলে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিষয়টি গুরুত্বের সাথে নেওয়া হবে বলে তিনি জানান।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     এই বিভাগের আরও খবর