ডা. ইসমেত জাহান আলো
বিসিএস (স্বাস্থ্য)
এমডি (প্যাডিয়াট্রিক্স)
ক্যারোটিন সমৃদ্ধ খাবারের পরিমাণ কমিয়ে দিলে, কয়েক মাসের মধ্যে আস্তে আস্তে হলুদ রঙ কমে শরীরের রঙ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। ১৭ মাসের রৌদ্রকে (ছদ্দনাম) নিয়ে তার মা এসেছেন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের শিশু বহির্বিভাগে। মায়ের চোখে মুখে চিন্তার ছাপ। কি হয়েছে জানতে চাওয়াতে বললো, রৌদ্রের শরীর হলুদ হয়ে যাচ্ছে, বেশ অনেক দিন ধরে জন্ডিস ওর, কিছুতেই কমছে না। বহু চিকিৎসা করেছেন, কিন্তু জন্ডিস কমার কোনো লক্ষণ নেই, মুরুব্বিরা বলছেন, ওর লিভার বড় হয়ে গেছে। রৌদ্রের শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পাশাপাশি জিজ্ঞেস করলাম, কি কি চিকিৎসা করেছেন? তার মা বললো, ‘হাত-পা ঝাড়াইসি, হাত-পা ধোয়াইয়া জন্ডিস নামাইসি, পানি পড়া খাওয়াইসি, কিন্তু কিছুতেই জন্ডিস কমছে না।’
আমি জিজ্ঞেস করলাম, রৌদ্রকে কি খাওয়ান?
মা বললো, খিচুড়ি, ভাত ও দুধ।
খিচুড়ি বা ভাতের সাথে কি দেন, মানে শাকসবজি?
মা বললেন, মিষ্টিকুমড়া, গাজর, ডাল, ডিম ও মাছ।
গাজর, মিষ্টি কুমড়া প্রতিদিন দেন?
তিনি বলেন, গাজরটা বেশি খায়, সাথে মিষ্টি কুমড়া থাকে।
রৌদ্রর খাদ্যাভ্যাস জেনে এবং শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আমি মোটামুটি নিশ্চিত হলাম, এটা জন্ডিস নয়। তবুও পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়ার জন্য রক্তের বিলিরুবিন পরীক্ষা করতে দিলাম। মাকে বুঝিয়ে বললাম, রৌদ্রের যে রোগটি হয়েছে, সেটি জন্ডিস নয়, তার নাম ক্যারোটেনেমিয়া (carotenemia)।
গাজর, মিষ্টিকুমড়া ও মিষ্টি আলুসহ যেকোনো হলুদ, কমলা বা লাল রঙের শাকসবজি-ফলমূল হলো ক্যারোটিন সমৃদ্ধ খাবার। দীর্ঘদিন ধরে অধিক পরিমাণে এসব ক্যারোটিন সমৃদ্ধ খাবার খেলে রক্তে beta carotene লেভেল বেড়ে যায়। ফলশ্রুতিতে চামড়ার নিচে ক্যারোটিন জমা হয়ে চামড়ার রং হলুদ বা কখনও কখনও কমলা আকার ধারণ করে।
ক্যারোটিনের এই আধিক্যের জন্য চামড়ার রঙ হলুদ হয়ে যাওয়াকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় বলে ক্যারোটেনেমিয়া (carotenemia). শরীরের যেসব জায়গায় চামড়া মোটা অর্থাৎ হাতের তালু, পায়ের তালুতে সাধারণত ক্যারোটিন জমা হয়ে থাকে। তাই হাতের তালু আর পায়ের তালু হলুদ দেখা যায়।
ক্যারোটিন হলো, আমাদের শরীরের ভিটামিন-এ'র প্রধান উৎস। ক্যারোটিনসমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার পর তা শরীরে গিয়ে ভিটামিন-এ তে রূপান্তরিত হয়। তবে আমাদের শরীর প্রতিদিন খুবই সীমিত পরিমাণে ক্যারোটিন থেকে ভিটামিন-এ তৈরি করে থাকে। কাজেই অধিক পরিমাণে ক্যারোটিনসমৃদ্ধ খাবার খেলেও তা থেকে সীমিত পরিমাণেই ভিটামিন-এ উৎপন্ন হয়। বাড়তি ক্যারোটিন রক্তে জমা হতে হতে এক সময় চামড়ার নিচে এসে জমা হয়। চামড়ার এই হলুদাভ বর্ণ ধারণ করার জন্য প্রায়শই অনেকে ক্যারোটেনেমিয়াকে জন্ডিসের সাথে গুলিয়ে ফেলে।
জন্ডিসের সাথে ক্যারোটেনেমিয়ার প্রধান পার্থক্য হলো, জন্ডিসে চোখের sclera হলুদ হয়ে থাকে এবং লিভার বড় হতে পারে। ক্যারোটেনেমিয়াতে চোখ স্বাভাবিক থাকে, লিভার বড় হয় না। জন্ডিসে রক্তে বিলিরুবিনের পরিমাণ বেড়ে যায়, ক্যারোটেনেমিয়াতে বিলিরুবিন বাড়ে না। জন্ডিস আমাদের জন্য ক্ষতিকারক এবং এর জন্য প্রকারভেদে চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। কিন্তু ক্যারোটেনেমিয়া ক্ষতিকারক নয় এবং এতে কোনো চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না।
ক্যারোটিনসমৃদ্ধ খাবারের পরিমাণ কমিয়ে দিলে, কয়েক মাসের মধ্যে আস্তে আস্তে হলুদ রঙ কমে শরীরের রঙ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। তাই বলে কি ভয়ে আমরা ক্যারোটিনসমৃদ্ধ হলুদ, কমলা বা লাল রঙের শাকসবজি ফলমূল বাচ্চাদের খাওয়াবো না? অবশ্যই খাওয়াবো। ভিটামিন-এ আমাদের চোখের জন্য, ত্বকের জন্য, বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধের অতি প্রয়োজনীয়। ভিটামিন-এ'র অভাবে চোখে রাতকানা রোগ হয়, ত্বক শুষ্ক হয়ে যায়, ভিটামিন-এ মিজেলস, ডায়রিয়া প্রতিরোধ করে থাকে। কাজেই ক্যারোটিনসমৃদ্ধ খাবার অবশ্যই প্রতিদিন খাওয়াবো, কিন্তু পরিমিত পরিমাণে।