#বন্যাপ্রাণী চলাচলের রাস্তা সংরক্ষণে ফিজিবিলিটি স্টাডি
#৫০ বছরের মধ্যে বিলুপ্ত হতে পারে আরো কিছু প্রাণী
#৬০ শতাংশ লোকবল নিয়ে চলছে চট্টগ্রামের বন রক্ষা বিভাগ
#জনগণের অসহযোগীতা, ‘সুফল’ প্রকল্পে উদাসীন কতৃপক্ষ
নিজস্ব প্রতিবেদক
চট্টগ্রামের সংরক্ষিত বনভূমিতে খাবারের সঙ্কট দেখা দেয়ায় বন্যপ্রাণীরা প্রতিনিয়িত লোকালয়ে হানা দিচ্ছে, লোকালয়ে বসবাসরতরাও সংরক্ষিত বনাঞ্চলে ঢুকে ফলজ-বনজ সম্পদ আহরণ করতে গিয়ে পড়ছেন বিপদে, হচ্ছেন বন্যপ্রাণীর আক্রমনের শিকার। এতে বন্যপ্রাণীরা যেমন ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে তেমনি লোকালয়ে বাড়ছে ভীতি। পর্যাপ্ত নিরাপত্তার অভাব এবং বন বিভাগের লোকবল সংকট থাকার কারণে বিষয়টির কোনো স্থায়ী সমাধান হচ্ছে না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চট্টগ্রাম জেলার বনাঞ্চল মূলত তিন ভাগে বিভক্ত। চট্টগ্রাম উত্তর, চট্টগ্রাম দক্ষিণ ও উপকূলীয় বনাঞ্চল। এর মধ্যে চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের ১৯টি রেঞ্জে ৩৫টি বিটে সংরক্ষিত ও রক্ষিত বনভূমির পরিমাণ ১ লাখ ৩৯ হাজার ৬৩৭ একর (৫৬ হাজার ৬১৪ হেক্টর)। অন্যদিকে চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের আওতায় প্রায় ১৩টি রেঞ্জে সংরক্ষিত ও রক্ষিত বনভূমির পরিমাণ প্রায় দেড় লাখ হেক্টর। বাকি বনাঞ্চল উপকূলীয় বন বিভাগের অধীন।
সংরক্ষিত ও রক্ষিত বনভূমিতে প্রায়শই অনুপ্রবেশ করছেন অনেকে। গত ৫ আগস্ট বোয়ালখালীর করলডেঙ্গার পাহাড়ি এলাকায় লেবু আনতে গিয়ে বন্যপ্রাণীর আক্রমণে গুরুতর আহত হয়েছেন মো. সাইফুদ্দিন (৩০) নামের এক বাক-প্রতিবন্ধী। সেখানে হাতি আক্রমণ করে তাকে। চলতি বছরের ৫ জুলাই চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার চুনতি ইউনিয়নের কৃষক মো. পেঠান (৭৫) বন্য হাতির আক্রমণে মারা গেছেন। লামা উপজেলার আজিজনগর ইউনিয়নে খামারবাড়ি থেকে ফেরার পথে বন্য হাতির আক্রমণের শিকার হন তিনি। ৬ জুলাই আনোয়ারা উপজেলার বারখাইন ইউনিয়নে বন্যহাতির আক্রমণে মারা গেছেন ছাবের আহমদ (৭০) নামে এক ব্যক্তি। মসজিদ থেকে বাড়ি ফেরার পথে সড়কে হাতির সামনে পড়েন তিনি। হাতিটি শুঁড় ও পা দিয়ে তাকে আঘাত করে। হাসপাতালে নেয়ার পথে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
বন গবেষকরা বলছেন, বনসম্পদ আহরণের জন্য মানুষ যেমন সংরক্ষিত বনাঞ্চলে ঢুকে পড়ছে তেমনি খাদ্যসঙ্কটের কারণে বন্যপ্রাণীরাও লোকালয়ে ঢুকে পড়ছে। এতে উভয় পক্ষ ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। গত ৩ আগস্ট বিরল প্রজাতির ‘চশমা পরা হনুমান’ পাচারকালে অপরাধীকে গ্রেপ্তার করে শাস্তির আওতায় আনা হয়। এর আগে গত ১৮ জুলাই চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার জঙ্গলে শিকারির জালে আটকা পড়ে একটি আজগর সাপ। পরে সেটিকে উদ্ধার করে বাঁশখালী ইকোপার্কে অবমুক্ত করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাইদুজ্জামান চৌধুরী।
বন গবেষকদের মতে, এভাবে চলতে থাকলে আগামি পঞ্চাশ বছরের মধ্যে চট্টগ্রামের বনভূমি থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে অসংখ্য প্রাণ। এর মধ্যে প্রথমেই থাকবে হাতি। কারণ গত শতাব্দী জুড়ে ব্যাপক নগরায়ণ ও বনাঞ্চল ধ্বংস করা হয়েছে এ অঞ্চলে। বন্যপ্রাণী চলাচলের রাস্তাও বন্ধ করা হয়েছে। বনেও কমেছে পর্যাপ্ত খাবার।
এ প্রসঙ্গে আলাপকালে বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউট, চট্টগ্রাম অঞ্চলের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ড. রফিকুল হায়দায় চাটগাঁর সংবাদকে বলেন, ‘ব্যাপক নগরায়নের ফলে বন্যপ্রাণীদের চলাচলের প্রাকৃতি রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে। বনেও খাবার কমেছে। এজন্য প্রায়শই মানুষ ও বন্যপ্রাণীদের মধ্যে বৈরি সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে। যদি এর জন্য দায়ী করতে হয় তাহলে মানুষই দায়ী হবে। কারণ বন্যপ্রাণীরা তো আর মানুষের মতো হিংস্র ও আগ্রাসী না।’
প্রকৃতি বাঁচাতে হলে বন্যপ্রাণীদের রক্ষা করতে হবে উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, ‘চট্টগ্রামের বনভূমি গুলোতে মানুষের আগ্রাসন যদি অতীতের মতো চলতে থাকে তাহলে আগামি পঞ্চাশ বছরের মধ্যে হাতিসহ অনেক প্রাণী বিলুপ্ত হতে পারে।’
জানা গেছে, বন্যপ্রাণীরা যাতে নির্বিগ্নে চলাচল করতে পারে সেজন্য চট্টগ্রামের কক্সবাজার-উখিয়া-বার্মা অঞ্চলের বনাঞ্চল নিয়ে এবং বাঁশখালী-সাতকানিয়া-আনোয়ারা বনাঞ্চল নিয়ে ফিজিবিলিটি স্টাডি করা হচ্ছে। এছাড়া বন্যপ্রাণীদের পর্যাপ্ত খাবারের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে সাসটেইনেবল ফরেস্ট অ্যান্ড লাইভলিহুডস (সুফল) প্রকল্প বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে বন বিভাগ। কিন্তু জনসহযোগীতা ও কতৃপক্ষের উদাসীনতার কারণে খুড়িয়ে চলছে এ প্রকল্পের কাজ। চট্টগ্রামের বন সংরক্ষণেও নেই পর্যাপ্ত জনবল। সে কারণে প্রায়শই সংরক্ষিত বনাঞ্চল জবর দখল হচ্ছে, অপরাধীদের বিরুদ্ধেও দেয়া হচ্ছে মামলা।
এ প্রসঙ্গে আলাপকালে চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রধান বন সংরক্ষক বিপুল কৃষ্ণ দাশ বলেন, ‘সংরক্ষিত বনাঞ্চলে প্রায়শই মানুষেরা প্রবেশ করে জবর দখল ও চোরাচালান করছে। বিষয়টিকে প্রতিহত করার জন্য আমাদের লোকবল থাকার কথা কমপক্ষে ২৩শ’ কিন্তু রয়েছে প্রায় ১৩শ’ জন। আমরা ঊর্ধ্বতন কতৃপক্ষের মাধ্যমে রিক্রুটের চেষ্টা করছি।’
এসময় ‘সুফল’ প্রকল্পের অগ্রগতি সম্পর্কেও জানান তিনি। তিন বলেন, বনাঞ্চলের নিকটবর্তী মানুষের অসহযোগীতার কারণে এ প্রকল্প আশানুরুপ পর্যায়ে পৌঁছুচ্ছে না। এজন্য মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই।’
প্রসঙ্গত, ১৯৭৩ সালের ২৭ মার্চ বাংলাদেশের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদেশক্রমে ‘বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ) আইন জারি করা হয়।