আজ ৬ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২১শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

বিদেশি সিগারেটের হোলসেল মার্কেট চট্টগ্রাম


অনলাইন ডেস্ক

ভারত ও মায়ানমারের সিগারেট সীমান্ত দিয়ে পাচার হয়ে চট্টগ্রামে নিয়ে আসছে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এতে করে বিদেশি চোরাই সিগারেটে এখন চট্টগ্রামের বাজার সয়লাব। বছরের পর বছর এই সিগারেটের রমরমা পাইকারি বাণিজ্য চলে নগরীর রিয়াজুদ্দিন বাজার ও খাতুনগঞ্জে। এতে প্রতি মাসে সরকার কোটি টাকারও বেশি রাজস্ব হারাচ্ছে। এসব দোকানের আছে অর্ধশতাধিক ধরনের বিদেশি সিগারেট। এসব সিগারেটের মধ্যে রয়েছে, ইজি স্পেশাল গোল্ড, মন্ড, স্ট্রবেরি, ভন ইন্টারন্যাশনাল, উইনস্টোন, গ্রান্ড-২০০০, ইজি অউরা, ব্লাক, মালবোরো, উলসন ল্যান্ড এম, ত্রি জিরো ত্রি, মডার্ন, ডাবল হ্যাপিনেস ও ডানহিলসহ বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সিগারেট।

রিয়াজউদ্দিন বাজারের অর্ধশতাধিক দোকানে প্রকাশ্যেই প্রতিদিন গড়ে প্রায় কোটি টাকার বিদেশি সিগারেট বেচাকেনা হয়। এই বাজারের তিনটি অঘোষিত সিগারেটের পাইকারি হাট রয়েছে। প্রতিটি দোকানে গড়ে প্রায় ২ থেকে ৫ লাখ টাকার অবৈধ সিগারেট কেনাবেচা হয়। সে হিসাবে মাসে প্রায় ৮-১০ কোটির অধিক টাকার অবৈধ সিগারেট বিক্রি হচ্ছে। যার পরিমাণ বছরে দাঁড়ায় ১০০ কোটি টাকার বেশি। ঢাকার কিছু কিছু স্থানে পাইকারি হারে বিক্রি হলেও চট্টগ্রামই মূল ঘাঁটি বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা।

সর্বশেষ শনিবার (১২ অক্টোবর) মধ্যরাতে রাঙামাটি থেকে পাচারের সময় কোটি টাকা মূল্যের ভারতীয় সিগারেট জব্দ করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। জব্দকৃত সিগারেটের আনুমানিক মূল্য প্রায় দুই কোটি টাকা ছাড়াবে বলে সংশ্লিষ্টসূত্র জানিয়েছে।

মিলন চাকমা নামের এক ফল ব্যবসায়ী মৌসুমি ফল নিয়ে যাওয়ার ছদ্মবেশে পৌনে দুই কোটি টাকা মূল্যের ভারতীয় সিগারেট পাচার করতে যাচ্ছিলো। রাঙামাটির মানিকছড়ি চেকপোস্ট দিয়ে যাওয়ার সময় জাম্বুরা ভর্তি একটি ট্রাক (চট্ট মেট্টো-ড-১১-২৪-৩৩) তল্লাশি চালালে ৩৫টি বস্তাভর্তি বিপুল পরিমাণ ভারতীয় চোরাই সিগারেট উদ্ধার করা হয়। ট্রাকটিতে জাম্বুরা দিয়ে ঢেকে এসব চোরাই সিগারেট পরিবহন করছিল চোরাচালান কারবারিরা।
এসময় ট্রাক চালক রোমান ও হেলপার (সহকারী) মঞ্জুরুল আলমকে আটক করা হয়। আটক ট্রাক চালক রোমান জানিয়েছেন, ট্রাকের মালিক জনৈক করিম কোম্পানির। তার বাড়ি চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া থানার রানীরহাটে। মিলন চাকমা নামের এক ব্যক্তি ১০ হাজার টাকায় ভাড়া করে কুতুকছড়ি এলাকা থেকে এসকল সিগারেট ভেতরে রেখে চারিদিকে জাম্বুরা দিয়ে ডেকে মৌসুমি ফল নিয়ে যাওয়ার ছদ্মবেশে পৌনে দুই কোটি টাকা মূল্যের ভারতীয় সিগারেট পাচার করতে যাচ্ছিলো মিলন চাকমা।

রাঙামাটির কোতোয়ালি থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) সাহেদ উদ্দিন জানান, জব্দকৃত সিগারেটে সাথে ট্রাকের চালক ও হেলপারকে আটক করা হয়েছে। মামলা রুজুর প্রক্রিয়া চলছে।

কক্সবাজারের রামু ও বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে চোরাচালান চক্র। প্রশাসনের দুর্বল নজরদারির কারণে এই দুই উপজেলার সীমান্তে চোরাচালান চক্রের শক্তিশালী বলয় গড়ে উঠেছে। সিন্ডিকেটের সদস্যরা প্রতিনিয়ত মিয়ানমার থেকে নিয়ে আসছেন সিগারেট।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, গর্জনিয়া সীমান্তের বিভিন্ন গ্রামে একাধিক চোরাচালান চক্র রয়েছে। স্থানীয় প্রভাবশালী কতিপয় যুবক এই চোরাচালান সিন্ডিকেট পরিচালনা করে থাকে। দুই উপজেলার অন্তত ৯টি গ্রাম একেবারেই সীমান্ত ঘেঁষা হওয়ায় সেখান দিয়ে সিগারেট, অস্ত্র, বিস্ফোরক ও গরু পাচার করা হয়। গ্রামগুলোর মধ্যে রয়েছে, নাইক্ষ্যংছড়ির ফুলতলি, ভালুক্কায়া, বাইশারী, তুমব্রু, বাইশফাঁড়ি, আশারতলী, জামছড়ি, বম্বনিয়া এবং রামু উপজেলার হাজিরপাড়া ও মৌলভীরকাটা। এর মধ্যে হাজিরপাড়া ও মৌলভীকাটা দিয়ে মিয়ানমারের সিগারেট ও অন্ত্র পাচার হয়ে থাকে।

জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে রাঙামাটির জুরাছড়ি ও বরকল সীমান্ত দিয়ে ভারত থেকে এবং কক্সবাজারের রামু ও বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত দিয়ে পাচার হয়ে আসা এসব সিগারেট এনে রাঙামাটি হয়ে চট্টগ্রামে পাচার করে আসছে একটি সিন্ডিকেট।

চোরাই সিগারেটের ওপর বেসরকারি উদ্যোগে পরিচালিত এক বাজার জরিপে দেখা গেছে, বিদেশি সিগারেট আমদানিতে ৩৫০ শতাংশ শুল্ক দিতে হয়। দেশে প্রতি বছর প্রায় ৭ কোটি ৪০ লাখ টাকার বিদেশ থেকে আনা চোরাই সিগারেট বিক্রি হচ্ছে। এসব সিগারেট থেকে আমদানি শুল্ক আদায় করতে পারলে বছরে আরো প্রায় ১৩০ কোটি টাকার মতো রাজস্ব আদায় হতো।

ক্রেতা সেজে চোরাই সিগারেটের বিক্রি ও বিপণন নিয়ে জানতে চাইলে রিয়াজুদ্দিন বাজারের সিগারেট দোকানের এক কর্মচারী নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ব্যক্তি জানান, অবৈধ উপায়ে সমুদ্রপথে এবং বিমানবন্দরের মাধ্যমে সিগারেটগুলো নিয়ে আসা হয়। বন্দরের কর্মকর্তা ও পুলিশের সঙ্গে যোগসাজশে দোকানদাররা এই কাজটি করে থাকেন। এসব চোরাই সিগারেট কেনাবেচার নির্দিষ্ট কিছু লোক আছে। ফোন করে খবর দিলেই তারা এসে দোকানে দোকানে সিগারেট দিয়ে যায়। এখন খুচরা বিক্রেতাদের এসব সিগারেট কিনতে বা বিক্রি কোনো ঝক্কি পোহাতে হয় না।

সূত্রটি আরো জানায়, বাংলাদেশে উৎপাদিত প্রিমিয়াম সেগমেন্টের ২০ শলাকা সিগারেটের মূল্য ১৮২ টাকা। উচ্চ সেগমেন্টের ২০ শলাকার এক প্যাকেট সিগারেটের দাম ১০৮ টাকা। বিদেশ থেকে চোরাই পথে আনা এসব সিগারেটের ২০ শলাকার প্যাকেট বিক্রি করা হয় ১৪০ থেকে ১৫০ টাকা। যেমন মন্ড স্ট্রবেরি, মন্ড আপেল এই ২০ শলাকার একটি প্যাকেটের দাম মাত্র ৯০ থেকে ৯৫ টাকা। যা দেশীয় প্রিমিয়াম সেগমেন্টের ২০ শলাকার সিগারেটের চাইতে অনেক কম। ফলে এসব সিগারেটের চাহিদাও বেশি।

সূত্র জানায়, চোরাচালানের মাধ্যমে আসা সিগারেটের মূল্য হুন্ডির মাধ্যমে চলে যায় মিয়ানমারের ব্যবসায়ীদের হাতে। তাদের মাধ্যমেই দুই দেশের চোরাকারবারিরা লেনদেন করে থাকে।

এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম মহানগর নগর পুলিশের (সিএমপি) মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) কাজী মো. তারেক আজিজ বলেন, সরকারি শুল্ক ফাঁকি দিতে একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট চক্র নিষিদ্ধ বিদেশি সিগারেট বাজারজাত করছে। এসব অবৈধ সিগারেটের পাইকারি বাণিজ্যে কোটি টাকার ব্যবসা করে যাচ্ছে।’ তিনি আরও জানান, চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে দেশের সীমান্ত এলাকা দিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকেও সিগারেট আমদানি করে আসছে। বান্দরবান, খাগড়াছড়ি সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে এসব সিগারেট এনে নগরের রিয়াজুদ্দিন বাজারে বাজারজাত করে।

তিনি বলেন, ‘শুধু সিগারেট না অবৈধ সবকিছুর বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। আমাদের গোয়েন্দা পুলিশও এসব নিয়ে কাজ করছে। আমাদেরকে কেউ তথ্য দিলে আমরা অভিযান করছি।’


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     এই বিভাগের আরও খবর