আজ ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২২শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

সংগৃহীত ছবি

কবে হবে রাষ্ট্রের অঙ্গ তৃতীয় লিঙ্গ


অনলাইন ডেস্কঃ লিঙ্গ জ্ঞানের ঘাটতির কারণে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের নিয়ে পৃথিবীর অধিকাংশ রাষ্ট্রের সমাজ ভয়ানক কুসংস্কারে আচ্ছন্ন। বাংলাদেশে এটি এখনও প্রকট। স্বীকৃতির নয় বছর পেরিয়ে আজও বাংলাদেশে কাক্সিক্ষত পর্যায়ে পৌঁছেনি তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠী।

লৈঙ্গিক বৈষম্য দূর করতে ও সমাজের মূলধারায় সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে ২০১৪ সালে একটি জনগোষ্ঠীকে ‘হিজড়া’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশ করে রাষ্ট্র। এরপর শিক্ষা খাতে তৃতীয় লিঙ্গের শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তি-উপবৃত্তিসহ বিভিন্ন প্রনোদনা দেয়ার দাবি তুলেছিলেন শিক্ষকেরা। কিন্তু কাজে আসছে না কোনো উদ্যোগ।
চট্টগ্রাম মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, চট্টগ্রামের কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তৃতীয় লিঙ্গের শিক্ষার্থীর অংশগ্রহনের কোনো তথ্য সংস্থাটির কাছে নেই। অর্থাৎ হিজড়া পরিচয়ের শিক্ষার্থী আমাদের সমাজে এখনও বেমানান।

শিক্ষা বোর্ডের বিদ্যালয় পরিদর্শক ড. বিপ্লব গাঙ্গুলি এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমার ধারণা ৫ম শ্রেণীর পর ধাপ পেরুনোর আগেই তৃতীয় লিঙ্গের শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া থেকে ঝরে যায়।’

সংবিধানের ২৮(৪) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রের যে কোনো অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য সরকার বিশেষ বিধান প্রণয়ন করতে পারবে।

চট্টগ্রামে তৃতীয় লিঙ্গের কতজন মানুষ বসবাস করে সে বিষয়ে সঠিক কোনো তথ্য নেই কোনো সংস্থার কাছে। সারাদেশের মতো চট্টগ্রামের ব্যস্ত অফিস পাড়াগুলোতে এই জনগোষ্ঠীর মানুষেরা জীবন নির্বাহ করতে এখনও চাঁদা সংগ্রহ করেন।

সমাজ সেবা অধিদপ্তরের আওতায় তাদের জন্য বিভিন্ন ভাতা-প্রশিক্ষণ চালু রয়েছে। অর্থ ও খাদ্য সহায়তা পেতে প্রশিক্ষণে অংশ নেয় অনেকে। কিন্তু এরপর কার্যকর কোনো পরিবর্তন হয় না। একাধিকবার প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা পেয়েও সামাজিক অবস্থান পরিবর্তন করতে পারেন না তারা। এ নিয়ে আক্ষেপ রয়েছে তাদের অনেকের মধ্যে।

আরও পড়ুন ধর্মীয় বিধিনিষেধে জেন্ডারে অসমতা : চবিতে বিএনপিএস এর সেমিনারে বক্তারা

স্বাভাবিকভাবে লেখাপড়া করতে পারলে, সমাজে অন্যদের মতো সার্ভিস দিতে পারলে অর্থাৎ একটি স্বাভাবিক জীবন পেলে ধন্য হতেন মো. আলমগীর (স্বপ্না)। চাটগাঁর সংবাদের সাথে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে আমার চালচলন মেয়েদের মতো। আমার বাবা মারা যাওয়ার পর পরিবার, সমাজ আমাকে সহজভাবে গ্রহণ করেনি। লেখাপড়া করার সুযোগও হয়নি। আমি অন্য সব মানুষের মতো স্বাভাবিক জীবন চাই।’ সরকারিভাবে স্বীকৃত ‘হিজড়া’ শব্দটি আবহমানকাল ধরে আমাদের সমাজে নেতিবাচক শব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। শিক্ষাখাতে তৃতীয় লিঙ্গের শিক্ষার্থী সহজে অংশগ্রহণ করতে পারলে ইতিবাচক পরিবর্তন হতে পারে। এক্ষেত্রে ‘হিজড়া’ শব্দটির পরিবর্তে ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ শব্দটি ব্যবহার করলে শিক্ষাখাতে এ জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ বাড়তে পারে মনে করছেন বিজ্ঞজনেরা।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ডিপার্টমেন্ট অব সাইকোলজির প্রধান ও অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর ড. পঞ্চানন আচার্য্য বলেন, ‘আমাদের সমাজে হিজড়া বা ট্রান্স জেন্ডারের বিষয়ে ভুল দৃষ্টিকোণ বিদ্যমান। সমাজের স্টিগমা (প্রচলিত ভুল ধারণা) দূর করা সম্ভব হলে এ ধরনের মানুষদের শিক্ষাখাত এবং সম্মানজনক প্রফেশনে যুক্ত করা যাবে। এজন্য হিজড়া, ট্রান্সজেন্ডারদের একটি জেন্ডার হিসেবে আখ্যায়িত করতে হবে। সেক্ষেত্রে সকলকে ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ বলা যাবে। সমাজ যতদিন না পর্যন্ত ওদেরকে অন্যসব মানুষের মতো স্বাভাবিক মানুষ হিসেবে বিবেচনা করবে, ততদিন তারা স্বাভাবিক জীবন থেকে বঞ্চিত হবে। লেখাপড়া অর্থাৎ শিক্ষাখাতে যদি তাদেরকে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় যুক্ত করতে চায় তাহলে প্রাইমারি লেভেলের পাঠ্যপুস্তক থেকেই তাদের প্রসঙ্গে জানাতে হবে। এতে যে কোনো শিক্ষার্থীর জন্য তৃতীয় লিঙ্গের শিক্ষার্থীদের স্বাভাবিক দৃষ্টিকোণে দেখতে সহজ হবে। এভাবে পরবর্তীতে সেটি পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রে সঠিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে সহায়ক হবে।’

তৃতীয় লিঙ্গের জন্য প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট থেকে বিশেষ কোনো কার্যক্রম বর্তমানে চালু নেই। ট্রাস্টটির সহকারী পরিচালক (উপবৃত্তি) মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন সোহাগ জানিয়েছেন, ‘বৃত্তি-উপবৃত্তির ক্ষেত্রে হিজড়াদের জন্য বর্তমানে আলাদা কোনো ব্যবস্থা নেই। এ ধরনের কোনো শিক্ষার্থী উপবৃত্তি পাচ্ছে কী না সে তথ্য আমার কাছে নেই।’

টেকসই উন্নয়নের (এসডিজি) ১৭টি লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে লিঙ্গ সমতাসংক্রান্ত লক্ষ্য এসডিজি-৫ এর মূল বক্তব্য হচ্ছে, ‘লিঙ্গ সমতা অর্জন করা।’ কিন্তু এসডিজি-৫ এর ৯টি টার্গেট এবং ১৪টি ইন্ডিকেটরের কোথাও ‘হিজড়া’ লিঙ্গের মানুষদের বিষয়ে কিছুই বলা হয়নি। অথচ এসডিজির মূল স্লোগান হচ্ছে ‘কেউ বাদ যাবে না’। এক্ষেত্রে এসডিজি-৫ নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে কাজ করার সুযোগ রয়েছে।

বাংলাদেশের শিক্ষাখাতে বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর কয়েকটি সাবজেক্টে থার্ড জেন্ডার বিষয়ে পড়ানো হলেও বিদ্যালয় কিংবা কলেজ গণ্ডির পাঠ্যপুস্তকে এখনও অবধি তৃতীয় লিঙ্গের বিষয় অনুপস্থিত। ইংরেজী এবং বাংলা ব্যাকরণে জেন্ডারের প্রকারভেদ এখনও দুটি। এ কারণে কৈশর থেকে তৃতীয় লিঙ্গের ব্যাপারে মনস্তাত্ত্বিক বিকাশ ঘটছে না। পরবর্তীকালে যখন পড়াশোনা শেষ করে সমাজে কেউ প্রতিষ্ঠিত হন তখনও তাদের মনোজগতে তৃতীয় লিঙ্গের বিষয়ে নানা ধরনের বিরূপ ধারণা বিদ্ধ থাকে।

মাধ্যমিক কিংবা উচ্চ মাধ্যমিকের পাঠ্যপুস্তকে থার্ড জেন্ডার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা যায় কী না এ প্রসঙ্গে আলাপকালে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান প্রফেসর মো. ফরহাদুল ইসলাম বলেন, ‘জেন্ডার বৈষম্য দূর করতে পৃথিবীর উন্নত রাষ্ট্রগুলোর মতো আমরা নিউট্রাল জেন্ডারে গুরুত্ব দিচ্ছি।’ অর্থাৎ ভবিষ্যতের পড়াশোনায় নারী, পুরুষ কিংবা অন্য লিঙ্গ সবই এক লিঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হবে। তবে এক্ষেত্রে অন্য সাবজেক্টের বইয়ে তৃতীয় লিঙ্গকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া অধ্যায় সংযোজনের প্রক্রিয়া চলছে উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, ‘রাষ্ট্র যেহেতু এই জনগোষ্ঠীকে স্বীকৃতি দিয়েছে, তাই বিশেষ ইম্পোর্টেন্স দেয়া হচ্ছে।’


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     এই বিভাগের আরও খবর