অনলাইন ডেস্কঃ আযান কিংবা গীতাপাঠ, মিলাদ-মাহফিল অথবা পূজাপাঠ; ধর্মীয় সব আয়োজনে তারস্বরে মাইক বাজানো এখন রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। যদিও ধর্মপালনে মানুষের ক্ষতি হয় এমন কোনো প্রযুক্তি ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা নেই। তবুও ধর্ম প্রতিযোগীতায় গণমানুষের জন্য অকল্যাণকর এসব প্রযুক্তি ব্যবহার কমছেই না বরং বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন-শব্দদূষণের কারণে দুশ্চিন্তা, উগ্রতা, উচ্চ রক্তচাপ, টিন্নিটাস, শ্রবণশক্তি হ্রাস, স্মরণশক্তি হ্রাস, মানসিক অবসাদসহ অন্যান্য ক্ষতিকর ও বিরূপ প্রতিক্রিয়া ঘটতে পারে।
শব্দদূষণ প্রতিরোধে বাংলাদেশ সরকার একটি বিধিমালা প্রনয়ন করেছিলো ২০০৬ সালে। সেই বিধিমালা অনুসারে, বেশকিছু স্থান, প্রতিষ্ঠান ও প্রচার-প্রচারণায় আইনটি কার্যকরের সুযোগ নেই। শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা-২০০৬ এ উল্লেখ আছে- মসজিদ, মন্দির, গীর্জা, প্যাগোডা বা অন্য কোনো ধর্মীয় উপাসনালয়; ঈদের জামাত, ওয়াজ মাহফিল, কীর্ত্তণ, শবযাত্রা এবং জানাজাসহ অন্যান্য ধর্মীয় অনুষ্ঠানে; সরকারী গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রচারকালে; প্রতিরক্ষা, পুলিশ বাহিনী ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষের দাপ্তরিক কাজ সম্পাদনকালে; স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস, বিজয় দিবস, ২১ ফেব্রুয়ারী, ১ বৈশাখ, মহররম বা সরকার কর্তৃক ঘোষিত অন্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ দিবসের অনুষ্ঠান চলাকালে শব্দদূষণের বিপরীতে এ আইন কার্যকর হবে না।
বাংলাদেশে অন্যান্য দূষণের মতো শব্দদূষণ তীব্রাকার ধারণ করায় ২০১৫ সালে এ বিষয়ে গবেষণা ও জরিপ পরিচালনার উদ্যোগ নেয় পরিবেশ অধিদপ্তর। এ প্রেক্ষিতে ৪৭ কোটি ৯৮ লাখ টাকা বরাদ্দের ‘শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত ও অংশীদারিত্বমূলক কর্মসূচি’ নামের একটি প্রকল্প ২০২১ সালের জানুয়ারি মাস থেকে বাস্তবায়নের বাস্তব কাজ শুরু করে সংস্থাটি। প্রকল্পটি চলতি বছরের ডিসেম্বরে সমাপ্ত হওয়ার কথা রয়েছে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের দেশের ৬৪টি জেলায় শব্দের মানমাত্রা পরিমাপ করা হয়েছে। প্রকল্পে কনসালটেন্ট হিসেবে কাজ করছে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের আইন বিভাগ। অ্যাওয়ার্নেন্স বৃদ্ধির জন্য ক্যাম্পেইন, ট্রেনিং, প্রচারণাকে গুরুত্ব দিয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হচ্ছে। সোমবার (১৩ নভেম্বর) পটিয়ার আবদুস সোবহান রাহাত আলী বিদ্যালয়েও এ ধরনের একটি কর্মসূচি পালন করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম। এছাড়া পরিচালিত হচ্ছে মোবাইল কোর্ট। বিধিমালা প্রয়োগে পরিবেশ অধিদপ্তর মূলত হাউড্রোলিক হর্ণ ব্যবহার বন্ধের ব্যাপাওে এখন বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে।
তবে ধর্মীয় কিংবা রাজনৈতিক প্রতিযোগীতায় উচ্চমাত্রার শব্দদূষণের বিষয়টি অকপটে স্বীকার করেছেন পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. ফেরদৌস আনোয়ার। চাটগাঁর সংবাদের সাথে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘বিধি অনুযায়ী ধর্মীয়, রাষ্ট্রীয় সংস্থার কার্যক্রমে শব্দদূষণ ঘটলে সেখানে আইন প্রয়োগ করা সম্ভব না। যেহেতু বিধি কিংবা আইন জনগণের স্বার্থরক্ষার্থে প্রণীত হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে এ সংক্রান্ত আইন সংশোধনের সুযোগও রয়েছে।’
শব্দদূষণ বন্ধে একটি যুগোপযুগী আইনের খসড়া প্রস্তাবনা আকারে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। শিগগিরই আইনটি অনুমোদন দেয়া হবে বলে দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র জানিয়েছে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের জরিপের তথ্যানুযায়ী, মাত্রাতিরিক্ত শব্দের কারণে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য জনগোষ্ঠী বিভিন্ন ধরণের ব্যাধিক্রান্ত হচ্ছেন। বর্তমানে দেশের এক তৃতীয়াংশ মানুষ শব্দদূষণে আক্রান্ত। বধিরতা, ক্ষুধামান্দ্য, রক্তচাপ বেড়ে যাওয়া, কাজে মনোযোগী হতে না পারা, টিন্নিটাস (কানের মধ্যে ভোঁ ভোঁ করা), হৃদরোগসহ নানাবিধ সমস্যায় ভুগছেন অনেকে।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, ‘উচ্চমাত্রার শব্দের মধ্যে থাকলে মানুষের শরীরে অ্যাড্রেনালিন হরমোনের ক্ষরণ বেড়ে যায়। বেশি অ্যাড্রেনালিন মানুষের রক্তচাপ ও হৃৎস্পন্দনের হার বৃদ্ধি করে। আমাদের চারপাশে যদি উচ্চমাত্রার শব্দ অব্যাহত থাকে এবং এমন পরিবেশে অনেক সময় কাটলে অতিরিক্ত অ্যাড্রেনালিন হরমোনের ক্ষরণ হতে থাকবে। তাতে হাইপারটেনশন হবে, প্রেশার বাড়বে আর হাইপারটেনশন, প্রেশার বেশি থাকলেই হৃদরোগের ঝুঁকি অবশ্যই বাড়বে। হাইপারটেনশন ও হৃদরোগ কিডনিসহ শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের ক্ষতি করে।’
আরও পড়ুন চট্টগ্রামে শব্দদূষণ বন্ধে প্রতিবাদ
পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা-২০০৬ সম্পর্কে প্রায় ৬৬ শতাংশ জনগণ অবগত নন। এছাড়া ৯৮ শতাংশ জনগণ বিধিমালা বাস্তবায়নে কোনো পদক্ষেপ লক্ষ্য করেননি বলে জানিয়েছেন। শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য সহায়ক আইন সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো হলে তবেই সুফল পাওয়া সম্ভব বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
আমেরিকান হার্ট এসোসিয়েশনের তথ্যানুযায়ী, শব্দের মাত্রা বৃদ্ধিতে যে কোনো বয়সের মানুষের স্ট্রোকের ঝুঁকি ১৪ ভাগ করে বৃদ্ধি পায়। তবে তা ৬৫ বছরের বেশি বয়সের মানুষের ক্ষেত্রে ২৭ ভাগ পর্যন্ত হতে পারে। বাংলাদেশে শব্দ দূষণের কারণে শিশু, বয়োজ্যেষ্ঠ এবং গর্ভবতী মায়েরা সবচেয়ে বেশী ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, ৮৫ ডেসিবেলের বেশি শব্দের মাত্রা ক্ষতির কারণ হতে পারে।
চট্টগ্রামে শব্দদূষণের পরিস্থিতি
পরিবেশ অধিদপ্তরের দেয়া তথ্যানুযায়ী, চট্টগ্রামে সামাজিক অনুষ্ঠান, গাড়ির হর্ণ, নির্মাণ, কারখানা, মিছিল-সভা-সমাবেশ ইত্যাদি কারণে শব্দদূষণ বাড়ছে। এক্ষেত্রে শব্দের মাত্রা বিধি নির্ধারিত মানমাত্রার চেয়ে দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ। চট্টগ্রাম শহরের ব্যস্ত কিংবা নীরব এলাকা সবগুলোই এখন অতিমাত্রার শব্দদূষণের কবলে। এরমধ্যে ইপিজেড (ফ্রি পোর্ট মোড়) এ সবচেয়ে বেশি শব্দদূষণ হচ্ছে। পোর্ট কলোনী সবচেয়ে কম শব্দদূষণ এলাকা হলেও সেখানেও শব্দের মাত্রা নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে দ্বিগুণ। বাণিজ্যিক এলাকার জন্য শব্দের নির্ধারিত মানমাত্রা দিনে ৭০ ও রাতে ৬০ ডেসিবল। কিন্তু চট্টগ্রামের বাণিজ্যিক এলাকাগুলোর সবচেয়ে বেশি দূষণ প্রবণ চাক্তাইয়ে শব্দের মাত্রা ১৩০ দশমিক ৩ ডেসিবল। শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধি অনুযায়ী নীরব এলাকার জন্য শব্দের নির্ধারিত মানমাত্রা দিনে ৫০ এবং রাতে ৪০ ডেসিবল। কিন্তু চট্টগ্রামের নীরব এলাকা গুলোও এখন অতি শব্দ দূষণের বাইরে নেই। আবাসিক এলাকা, হাসপাতালগুলোর আশেপাশে শব্দের গড়মাত্রা পাওয়া যাচ্ছে ১৩০ ডেসিবলের বেশি।