স্বাগত হিজরি নববর্ষ ১৪৪৬। হিজরি সনের প্রথম মাস মহররম। ইসলামে হিজরি সন ও তারিখের গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ হিজরি সন এমন একটি সন যার সঙ্গে মুসলিম উম্মাহর তাহজিব-তামাদ্দুন ও ঐতিহ্যের ভিত্তি সম্পৃক্ত। মুসলমানদের রোজা, হজ, ঈদ, শবেবরাত, শবেকদর, শবে-মেরাজসহ ইসলামের বিভিন্ন বিধিবিধান হিজরি সনের ওপর নির্ভরশীল। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ও আনন্দ-উৎসবসহ সব ক্ষেত্রেই মুসলিম উম্মাহ হিজরি সনের অনুসারী। দুঃখজনক হলেও সত্য যে হিজরি সনের পহেলা মাস মহররম একের পর এক আমাদের দুয়ারে উপস্থিত হয় ঠিক ; কিন্তু হিজরি সনের শুভ আগমন উপলক্ষে হৈ-চৈ নেই, নেই কোনো প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক ও অনলাইন মিডিয়ার বিশেষ কোনো আয়োজন। যেমনভাবে বিশেষ আয়োজন পরিলক্ষিত হয় ঈসায়ি নববর্ষের আগমনে। বাংলা ও ইংরেজি নববর্ষকে যেভাবে গুরুত্ব দিয়ে আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে উদযাপন করা হয় তাতে মনে হয় হিজরি নববর্ষ যেন আমাদের কোনো প্রয়োজনই নেই! অথচ হিজরি নববর্ষকে গুরুত্ব-সহকারে পালন করাই ছিল আমাদের মুসলিম অধ্যুষিত দেশে কাম্য। হিজরি সন গণনার সূচনা হয়েছিল ঐতিহাসিক এক অবিস্মরণীয় ঘটনাকে উপলক্ষ করে। রাসুল (সা.) এবং তাঁর সঙ্গী-সাথিদের মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের ঐতিহাসিক ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্যই আরবি মহররম মাসকে হিজরি সনের প্রথম মাস ধরে সাল গণনা শুরু হয়েছিল। আল্লাহর নির্দেশ পালনার্থে পবিত্র মক্কা থেকে মদিনায় রাসুলের (সা.) হিজরত থেকেই হিজরি সনের সূচনা।
খোলাফায়ে রাশেদার শাসনকালে মদিনাকেন্দ্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার গোড়াপত্তন হলে অফিসিয়াল তথ্যাদির নথি ও দিনক্ষণের হিসাব রাখতে গিয়ে বিভিন্ন প্রদেশের গভর্নররা বিপাকে ও অসুবিধায় পড়েন। যেহেতু তখন ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্য কোনো বর্ষপঞ্জি বা একক সন চালু ছিল না। রাষ্ট্রীয় অফিসিয়াল কার্যাদি নির্বিঘ্নে ও যথানিয়মে সম্পন্ন করার প্রয়োজনে নতুন সন প্রবর্তন তখন অনিবার্য হয়ে ওঠে। খলিফাতুল মুসলিমিন হজরত উমর ফারুকের (রা.)-শাসনামলে ১৬ হিজরি সনে প্রখ্যাত সাহাবি হজরত আবু মুসা আশআরি (রা.) ইরাক এবং কুফার গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। একদা হজরত আবু মুসা আশআরি (রা.) খলিফা উমরের (রা.) খেদমতে এ মর্মে পত্র লেখেন যে আপনার পক্ষ থেকে পরামর্শ কিংবা নির্দেশ সংবলিত যেসব চিঠি আমাদের কাছে পৌঁছে তাতে দিন, মাস, সাল, তারিখ ইত্যাদি না থাকায় কোন চিঠি কোন দিনের তা নিরূপণ করা আমাদের জন্য সম্ভব হয় না। এতে করে আমাদের নির্দেশ কার্যকর করতে খুব কষ্ট হয়। অনেক সময় আমরা বিব্রতবোধ করি চিঠির ধারাবাহিকতা না পেয়ে। হজরত আবু মুসা আশআরির চিঠি পেয়ে হজরত উমর (রা.) এ মর্মে পরামর্শ সভার আহ্বান করেন এখন থেকে একটি ইসলামী তারিখ প্রবর্তন করতে হবে। ওই পরামর্শ সভায় হজরত উসমান (রা.)-হজরত আলীসহ (রা.)-শীর্ষস্থানীয় সাহাবায়ে কেরাম এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন। সভায় উপস্থিত সবার পরামর্শ ও মতামতের ভিত্তিতে এ সভায় হজরত উমর (রা.) সিদ্ধান্ত দেন ইসলামী সন প্রবর্তনের। এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় হিজরতের ১৬ বছর পর ১০ জুমাদাল উলা ৬৩৮ খ্রিষ্টাব্দ। সেই থেকে আজ পর্যন্ত হিজরি সনের মাসগুলো মুসলমানদের জীবনধারার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে।
প্রিয় নবীজি (সা.) এর মক্কা মুকাররমা থেকে মদিনা মুনাওয়ারায় হিজরতের ঘটনা মুসলমানদের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। হিজরত মানে ছেড়ে যাওয়া, পরিত্যাগ করা ; দেশান্তর হওয়া ও দেশান্তরিত করা। পরিভাষায় হিজরত হলো ধর্মের জন্য এক স্থান ত্যাগ করে অন্য স্থানে চলে যাওয়া। নবুয়তের ত্রয়োদশ বর্ষে রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় হিজরত করেন।
ইসলামে হিজরি সনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। আল্লাহপাক এরশাদ করেন নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে গণনা হিসেবে মাস হলো ১২টি (মহররম, সফর, রবিউল আউয়াল, রবিউস সানি, জমাদিউল আউয়াল, জমাদিউস সানি, রজব, শাবান, রমজান, শাওয়াল, জিলকদ ও জিলহজ)। যেদিন থেকে তিনি আসমান ও জমিন গৃষ্টি করেছেন এর মধ্যে চারটি মাস বিশেষ সম্মানিত (সুরা তাওবাহ : ৩৬)। আর হারাম বা সম্মানিত চারটি মাস হলো-মহররম, রজব, জিলকদ ও জিলহজ। বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর কৃষ্টি-কালচারে ও মুসলিম জীবনে হিজরি সনের গুরুত্ব অপরিসীম।
হিজরি সনের প্রথম মাস হলো মহররম। মহররম একটি তাৎপর্যমন্ডিত এবং বরকতময় মাস। মুসলিম ইতিহাসে এ মাসটি বিভিন্ন কারণে মর্যাদায় অধিষ্ঠিত। কোরআনে এ মাসটিকে ‘শাহরুল্লাহ’ তথা আল্লাহর মাস বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। পবিত্র কোরআনের সুরা তাওবার ৩৬ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহতায়ালা বলেন চারটি মাস রয়েছে যেগুলো সম্মানিত মাস। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হলো মহররম। কোরআনে আরও এরশাদ হয়েছে লোকেরা তোমাকে নতুন চাঁদ সম্বন্ধে প্রশ্ন করে। বলো তা মানুষ ও হজের জন্য সময় নির্দেশক (সুরা বাকারা : ১৮৯)। মুসলিম উম্মাহর কাছে হিজরি সনের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। বিশেষ করে হিজরি সনের সম্পর্ক চাঁদের সঙ্গে থাকার কারণে এই সনের তাৎপর্য অত্যন্ত ব্যাপক। এই চাঁদের হিসাবে মুসলমানদের অনেক ইবাদত-বন্দেগি আচার-অনুষ্ঠান পালিত হয়ে থাকে। কাজেই হিজরি তারিখকে গুরুত্ব দেওয়া একান্ত জরুরি।
মহররম মাসের ১০ তারিখকেই আশুরা বলা হয়। নিঃসন্দেহে আশুরার দিনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও মর্যাদার দিন। এ দিনটি মুসলিম উম্মাহকে পৃথিবীর বিভিন্ন ঘটনার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এ দিনেই ঘটেছে পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে হৃদয় বিদরাক ও মর্মান্তিক কারবালা ঐতিহাসিক ঘটনা। এক কথায় এ দিনটি দ্বীন প্রতিষ্ঠায় হিজরত এবং হক তথা উত্তম প্রতিষ্ঠার জন্য এক সুমহান দিন। এ কারণেই মুসলিম উম্মাহ এ দিনটিকে বিশেষ ইবাদাত-বন্দেগি তথা রোজা পালনের দিন হিসেবে শ্রদ্ধা ও ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে পালন করে থাকে। মহররম মাসের ১০ তারিখ আশুরার দিনটি হজরত মুসা আলাইহিস সালাম ও তার সঙ্গী-সাথীদের জন্য বিজয়ের দিন হলেও এ দিনেই ঘটেছে পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে হৃদয় বিদরাক ও মর্মান্তিক কারবালা ঐতিহাসিক ঘটনা। আল্লাহর জমিনে দ্বীন তথা উত্তম প্রতিষ্ঠায় ইসলামের অগ্রসেনানী হজরত হোসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুর এ আত্মত্যাগ এক মহাঅনুপ্রেরণা। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুলে পাক (সা.) বলেন রমজানের রোজার পরে মহররমের রোজা হলো সর্বশ্রেষ্ঠ যেমন ফরজ নামাজের পরে শেষ রাতের তাহাজ্জুদ নামাজ সবচেয়ে বেশি মর্যাদাসম্পন্ন।
নতুন বছর ও নতুন চাঁদের দোয়া : নতুন বছরে এই দোয়া পড়লে বছরটি ভালো কাটবে। ইয়া মুকাল্লিবাল কুলুবি ওয়াল আবছার ইয়া মুদাব্বিরাল্লাইলি ওয়ান্নাহার ; ইয়া মুহাওয়িলাল হাওলি ওয়াল আহওয়াল হাওয়িল হালানা ইলা আহ্ছানিল হাল। অথর্ : হে অন্তরসমূহ ও দৃষ্টিসমূহ পরিবর্তনকারী! হে রাত ও দিনের আবর্তনকারী! হে সময় ও অবস্থা বিবর্তনকারী! আমাদের অবস্থা ভালোর দিকে উন্নীত করুন। উল্লেখ্য এই দোয়া বছরব্যাপী সব সময় পড়া যায়। নতুন বছরের সঙ্গে আসে নতুন মাসও। নতুন চাঁদে এই দোয়া পড়লে মাসটি নিরাপদ হবে। আল্লাহুম্মা আহিল্লাহু আলাইনা বিল আমনি ওয়াল ইমান ওয়াছ ছালামাতি আল ইসলাম ; রব্বি ওয়া রব্বুকাল্লাহ ; হিলালু রুশদিন ওয়া খায়র। অর্থ : হে আল্লাহ! এই মাসকে আমাদের জন্য নিরাপত্তা, ইমান, প্রশান্তি ও ইসলামসহ যোগে আনয়ন করুন ; আমার ও তোমার প্রভু আল্লাহ। এই মাস সুপথ ও কল্যাণের। (তিরমিজি : হাদিস : ৩৪৫১: মুসনাদে আহমাদ: হাদিস : ১৪০০: রিয়াদুস সালেহিন : ১২৩৬)।
পরিশেষে : আসুন ইবাদতের মাধ্যমে পুরোনো হিজরি বছরকে বিদায় দিয়ে নতুন হিজরি নববর্ষকে স্বাগত জানাই। পবিত্র মহররম মাস ও আশুরার দিনে (১০ মহররমের আগে বা পরে এক দিনসহ) আমরা রোজা রেখে আল্লাহর পক্ষ থেকে কল্যাণ লাভ করার সুযোগ গ্রহণ করি। বেশি বেশি তাওবা-ইস্তেগফার ও দান-খয়রাত করে এবং পরিবার পরিজনের জন্য ভালো খাবারের ব্যবস্থা করে গুনাহ থেকে মাফ পাওয়ার চেষ্টা করি। সুতরাং হিজরি নতুন বছরে আমাদের প্রত্যাশা বিশ্ববাসীর জন্য নতুন বছর ১৪৪৬ হিজরি বয়ে আনবে শান্তি নিরাপত্তা আর দূর হবে মহামারি এবং বন্ধ হবে ধর্মের নামে রক্তপাত। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মহররম ও আশুরা থেকে আমাদের অফুরন্ত ফজিলত দান করুন। আমিন।
লেখক: ফখরুল ইসলাম নোমানী, ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট
Leave a Reply