মাওলানা বোরহান উদ্দীন কাদেরী: আরবি হিজরী বছরের নবম মাস মাহে রমজান। অন্যান্য মাসের চেয়ে এ মাসের গুরুত্ব ও ফযিলত অত্যধিক। কেননা এ মাস কুরআন নাজিলের মাস, এ মাস লাইলাতুল কদরের মাস, রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের পবিত্র মাস। শয়তানকে শিকলাবদ্ধ করার ফলে বান্দারা একাগ্রচিত্তে ইবাদত বান্দেগী করার মাস। সারা বছর যে কয়টি ফযিলতমন্ডিত রাত রয়েছে তন্মধ্যে পবিত্র ‘লাইলাতুল ক্বদর’ সর্বশ্রেষ্ট রাত।
আর ক্বদর শব্দের অর্থ হলো নির্ধারণ বা পরিমাপ। যে রাতে মহান আল্লাহ্ পাক সৃষ্টিজীবের পূর্ণ এক বছরের ভাগ্য নির্ধারণ, প্রত্যেক প্রাণীর আহার-পানাহার, রিজিকসহ সর্বপ্রকার কাজ-কর্ম নির্ধারণ ও কার্যকর করার জন্য সংশ্লিষ্ট ফেরশতাদেরকে তালিকা বিতরণ করেন বলেই এ রাতকে পরিমাপ বা নির্ধারণী রাত বলা হয়।
যেমন পবিত্র কুরআনে পাকে মহান আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন - এ রাতে ফিরিশতাগণ ও জিব্রাইল আলাইহিস সালাম অবতীর্ণ হয়ে থাকে স্বীয় রবের আদেশ, প্রত্যক কাজর জন্য। [সুরা কদর, অনুবাদ কানযুল ঈমান] মহান আল্লাহ্ তা‘আলা এ রাতের মহিমা, ফজিলত ও সংজ্ঞা বা পরিচয় প্রদান করে বলেছেন, ‘লাইলাতুল ক্বদর ওই রজনী, যে রজনী হাজার মাস তথা ৮৩ বছর ৪ মাসের চেয়েও অধিক উত্তম।’(সুরা কদর,আয়াত নং ৩)
পবিত্র মাহে রমজানে মহান এ রজনী নিহিত থাকলেও কোন রজনীতে কদরের রাত রয়েছে তা কুরআন ও হাদিসে সুস্পষ্ট নির্ধারণ করে দেয়া হয় নাই। তবে মাহ রমজানের শেষ দশ দিনের কোন এক বিজোড় রাতই ক্বদর রাত্রি।
এ ব্যাপারে হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের দরবারে জানতে চাওয়া হলে তিনি ইরশাদ করেন- ক্বদর রাত্রি রয়েছে রমজানের শেষ দশ দিনের বিজোড় রাত। তিনি অন্যত্রে এরশাদ করেন- ‘তোমরা রমযানের শেষ দশ দিনের বিজোড় রাতে শবে ক্বদর তালাশ কর। [সহীহ বুখারী শরীফ]
তিরমিযী শরীফে হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহুতা‘আলা আনহু হতে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন সেটাকে অর্থাৎ শবে ক্বদরকে রমযানের নয় রাত বাকি থাকতে অথবা রমযানের সাত রাত অবশিষ্ট থাকতে, অথবা পাঁচ বা তিন রাত অবশিষ্ট থাকতে অথবা রমযানের শেষ রাত (অর্থাৎ ২১, ২৩, ২৫, ২৭ বা ২৯ রমযান রাত) খোঁজ করো। [জামে তিরমিযী]
প্রখ্যাত সাহাবী হযরত সূফিয়ান সওরী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর মতে- শবে ক্বদর নির্ধারিত কোন তারিখ নয় বরং রমযানের শেষ দশকের রজনীগুলোতে ঘুর্ণমায় হতে থাকে।
ইমাম আযম হযরত ইমাম আবু হানীফা রহমাতুল্লাহি আলায়হি, ইমাম আহমদ রহমাতুল্লাহি আলায়হি, হযরত উবাই ইবন কা’ব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর মতে ‘পবিত্র রমযানের ২৭ তারিখ রজনীতেই লাইলাতুল ক্বদর। অধিকাংশ মুসলিম মনীষী এ রজনীকেই মহিমাণ্বিত (ক্বদর) রজনীরূপে নির্বাচন করেছেন। যুক্তিস্বরূপ, তাঁরা বলেছেন, সূরা ক্বদরে মহান আল্লাহ্ তা‘আলা ‘লাইলাতুল ক্বদর’ শব্দটি তিন বার উল্লেখ করেছেন।
আর ‘লাইলাতুল ক্বদর’ শব্দদ্বয় লিখিত সর্বোমোট ৯টি হরফের সংযাজন প্রয়োজন। আর ৯কে তিন দ্বারা গুণ করল (৩*৯) গুণফল হয় সর্বোমোট ২৭ (সাতাশ) এ।
সুতরাং ২৭ তারিখের রাতেই ‘লাইলাতুল ক্বদর’ বা শবে কদ্বর। তাছাড়া এ সূরায় ত্রিশটা শব্দ (পদ) রয়েছে। তন্মধ্যে (ওই রাত নির্দেশক সর্বনাম) ‘হিয়া’ হচ্ছে ২৭তম পদে। হিয়া’ মানে পূর্ণ ক্বদর রাত্রি, অর্থাৎ মাগরিব হতে ফজর পর্যন্ত।
লাইলাতুল কদরের ফযিলত:
প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন- ‘আল্লাহ্ তা‘আলা শবে ক্বদর দ্বারা অন্যান্য রাতের চেয়ে কদর রাতকে সৌন্দর্য দান করেছেন । কেননা, এ রাতই সর্বশ্রেষ্ঠ রাত। অপর হাদিসে এরশাদ করেছেন- ‘তোমরা যদি তোমাদের কবরসমূহ আলাকিত পেতে চাও, তবে শবে কদরে জাগ্রত থেকে আল্লাহর ইবাদতে মশগুল থাকো।’
আল্লামা ইবনে জারীর তাবারী রহমাতুল্লাহি আলায়হি বর্ণনা করেছেন- এ রাতের যে কোন আমল হাজার মাসের চেয়ে উত্তম। এ রাতে ইবাদত করা ত্রিশ হাজার দিন ও ত্রিশ হাজার রাত ইবাদতের সমতুল্য।[নুযহাতুল মাযালিছ, পৃ. ১৬৬]
সহীহ বুখারী শরীফে সর্বাধিক হাদীস বর্ণনাকারী সাহাবী হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন- যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে এবং সাওয়াবের আশায় রমযান শরীফের রোযা পালন করে আল্লাহ্ তা‘আলা তার পূর্ববর্তী যাবতীয় (ছগীরা) গুনাহ্ ক্ষমা করে দেন এবং যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও সাওয়াবের আশায় লায়লাতুল ক্বদরের রাত জেগে ইবাদতে মশগুল থাকে আল্লাহ তারও পূর্ববর্তী সকল গুনাহ্ ক্ষমা করে দেবেন।
লাইলাতুল ক্বদরের আমল:
প্রখ্যাত মুফাসসির হযরত ইসমাইল হক্কী রহমাতুল্লাহি আলায়হি তাঁর "তাফসীর রুহুল বয়ানে উল্লেখ করেন, যে ব্যক্তি ক্বদর রজনীতে বিশুদ্ধ অন্তর নিয়ে নফল নামায আদায় করবে আল্লাহ্ তা‘আলা তার সমস্ত গুনাহ্ মাফ করে দিবেন।
নফল নামায:
এরাতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আমল হলো নফল নামাজ বেশিবেশি আদায় করা। নফল নামাজ যে কোন নিয়েমই পড়া যায়। তবে ‘নুজহাতুল মাযালিস’ নামক কিতাবে যে পদ্ধতির কথা উল্লেখ রয়েছেে তা হলো- প্রতি রাকাত সুরা ফাতিহার পরে সূরা তাকাসুর ১ বার এবং সূরা ইখলাস এগার বার করে আদায় করবে।
তার জন্য আল্লাহ্ তা‘আলা তার মত্যুর সময় সাকারাত কে সহজ করে দেবেন। অধিকন্তু কবরের আযাব থেকেও মুক্তি দেবেন এবং নূরের এমন চারটি স্তম্ভ দান করবেন যে, প্রতিটি স্তম্ভের ১০০০ মহল হবে।
তাছাড়া, আমাদের দেশে শবে ক্বদরেও কমপক্ষে (১২)বার রাক্‘আত নফল নামায একাকী কিংবা জামা‘আত সহকার পড়ার নিয়ম যুগযুগ ধরে আছে। তা, দু’ রাক্‘আত করে ৬ (ছয়) তাকবিরে পড়তে পারেন । প্রথম রাকআতে সুরা ফাতিহার পর ‘সূরা ক্বদর’ এবং দ্বিতীয় রাকআতে (৩) তিনবার ‘সূরা ইখলাস,’ (সূরা ক্বদর মুখস্থ না থাকলে উভয় রাক্‘আতে তিনবার সূরা ইখ্লাস) পাঠ করে নফল নামাজ আদায় করতে পারবেন। এটাও বরকতময়।
কবর জিয়ারত:
এরাতে শরীয়ত সম্মত পন্থায় মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজন, পীর-আউলিয়া ও বুজর্গদের কবর জিয়ারত করা অতি সওয়াবের ও প্রিয়নবীর সুন্নাত। কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ রাতের গভীরে নিদ্রাত্যাগ করে জান্নাতুল বাকিতে দাফন হওয়া সাহাবায়ে করামের কবর জিয়ারতে ছুটে গিয়ছিলেন যার বর্ণনা হাদীসে পাকে পাওয়া যায়।
দোয়া পাঠ করা:
এরাতে যে দো‘আটি পড়বেন তা হলো উম্মুল মুমেনীন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা বলেন, আমি বললাম, ইয়া রাসুলুল্লাহ! সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম যদি আমি লাইলাতুল ক্বদর রজনী পেতে সক্ষম হই, তবে কি পড়বো ? জবাবে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করলেন ‘আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুওভুন তুহিব্ববুল ‘আফওয়া ফাআ’ফু আন্না ইয়া গফুর ইয়া গফুর। অর্থাৎ হে আল্লাহ্ আপনিতো ক্ষমাকারী এবং আপনি ক্ষমা করা পছদ করেন। সুতরাং আমাকেও ক্ষমা করুন। [তিরমিযী শরীফ, মসনদে আহমদ]
কুরআন তেলাওয়াত অনন্য ইবাদত:
এ রাতে কুরআন তিলাওয়াত অন্যতম প্রধান আমল,যেহেতু কুরআন নাজিল হওয়ায় এই রাতের এতোই মর্যাদা। তাই যত বেশি সম্ভব কুরআন তেলাওয়াত করা অত্যন্ত সওয়াব ও পূণ্যময় ।
প্রিয়নবীর ওপর দরুদ পড়া:
দোয়া পাঠের সাথে যত বেশি সম্ভব আল্লাহ তা’আলার জিকির করা ও নবীজীর প্রতি দরুদ-সালাম পড়া। যে কোন দরুদ শরীফ পাঠ করতে পারেন। যেমন -আল্লা-হুম্মা সাল্লি আলা সাইয়্যেদিনা মুহাম্মদিও ওয়া আলা-আলে স্যাইয়্যেদিনা মুহাম্মদিও ওয়াবারিক ওয়াসাল্লিম।
দান-সদক্বা:
তাছাড়া দান-খায়রাত করা,সমাজে গরীব-অসহায়দের খাদ্য প্রদান,আর্থিক সাহায্য ইত্যাদি অত্যন্ত সওয়াবের কাজ।
আমাদের সমাজে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, আশুরা, শবে মেরাজ, ঈদুল আজহা, ঈদুল ফিতর, মাহে রমজান ও পবশবে কদর এসব ইসলামী সংস্ককৃতিতে মুসলমানদের অন্তরে সত্য দ্বীনি তথা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের মান-মানসিকতা সৃষ্টিতে অনন্য, অনবদ্য ও প্রত্যক্ষ জোরালো ভূমিকা রেখে আসছে আলহামদুলিল্লাহ।
এ রাতে ক্ষমার অযোগ্য যারা:
এতো রহমতের মধ্যেও এমন কিছু বান্দা রয়েছে যাদের অপরাধ এই মহিমাণ্বিত রজনীতে ক্ষমার অযোগ্য ঘোষণা করা হবে। যাদের উপর মহান আল্লাহর দয়া/রহমতের পরশ পড়বে না। তারা হলো ১. অনিষ্টকারী যাদুকর ও গণক, ২. মাতা-পিতার প্রতি অবাধ্য সন্তান, ৩. যার অন্তর হিংসা-বিদ্বেষ ও কৃপণতায় পরিপূর্ণ, ৪. যেনাকারী/ব্যভিচারী, ৫. আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী ব্যক্তি, ৬. চোগলখোর/পরনিন্দাকারী/গীবতকারী এবং ৭. বান্দার হক আত্মসাৎকারী।
মহান আল্লাহ্ পাক লায়লাতুল ক্বদর বা মহিমাণ্বিত কদর রজনীর সমুদয় ফয়েজ, রহমত, বরকত ও ফজীলত আমাদের প্রত্যককে দান করুক এবং যাবতীয় বালা-মসিবত হতে হেফাজত করুন, দেশ ও দেশবাসীর ওপর অফুরন্ত রহমত দান করুক। আমীন বেহুরমতে সায়্যিদিল মুরসালিন।
লেখক: শিক্ষক, জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া মহিলা কামিল মাদ্রাসা; চট্টগ্রাম।