অনলাইন ডেস্ক
আখেরি চাহর শোম্বা মূলত আরবি ও ফার্সি বাক্য। প্রথম শব্দ ‘আখেরি’ আরবি ও ফার্সিতে পাওয়া যায়। যার অর্থ হলো- শেষ। ফার্সি ‘চাহর’ শব্দের অর্থ হলো- সফর মাস এবং ফার্সি ‘শোম্বা’ শব্দের অর্থ হলো- বুধবার। অর্থাৎ ‘আখেরি চাহর সোম্বা’র অর্থ দাঁড়ায়- সফর মাসের শেষ বুধবার। দিনটিকে মুসলিম উম্মাহ খুশির দিন হিসেবে জানে এবং খুশির দিন হিসেবেই উদযাপন করে থাকেন।
আখেরি চাহার সোম্বা কী?
রসূলুল্লাহ (সা.) এর পবিত্র জীবনের প্রতিটি কথা, প্রতিটি কাজ আর সমস্ত আচার-ব্যবহার, চাল-চলন, গতি-বিধি, পদক্ষেপ, সময়-ক্ষণ তথা সমগ্র জীবনই উত্তম আদর্শের অনুপম নিদর্শন। যা কোরআন শরীফে নানা আঙ্গিকে ব্যক্ত হয়েছে। তবে মক্কায় তার নবুওয়্যাত- রেসালত জীবনের ১৩টি বছরই তাঁকে মক্কার কাফের কোরাইশদের নানামুখী কঠোর নির্যাতন নীরবে সহ্য করতে হয়েছে। হিজরতের পর মদীনায় আগমনের পরও রাসূলুল্লাহ (সা.) ইহুদী-মোনাফেকদের নতুন ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন। মক্কার কাফেররা তাকে, মদীনার ইহুদী মোনাফেকদের যোগ সাজশে স্বস্তিতে-শান্তিতে থাকতে দেয়নি এবং তারা সর্বদা আগ্রাসী ষড়যন্ত্র লিপ্ত থাকে এমনকি বহু রণাঙ্গনে অবতীর্ণ হতে বাধ্য করে এবং সর্বক্ষেত্রেই ওরা শোচনীয় পরাজয় করে। ঐতিহাসিক সত্য এই যে, ওরা মহানবী (সা.) এর প্রাণনাশের পর্যন্ত অপচেষ্টা চালাতে থাকে। মোনাফেক ইহুদী চক্র বিধর্মীরা মর্মে মর্মে অনুভব করতে পারে যে, ইসলামের বিজয়কে প্রতিহত করা সম্ভব নয়।
অবশেষে রসুলুল্লাহ (সা.) এর অসুস্থ হবার খবর ছড়িয়ে পড়লে ইহুদী ও মোনাফেকদের আনন্দের সীমা রইল না, অপর দিকে মুসলমানদের দুঃশ্চিন্তাও বেড়ে যেতে থাকে, তারা দারুণভাবে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন, হুজুর (সা.) এর চিরবিদায়ের আশঙ্কায়। তাদের চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে হঠাৎ সাময়িকভাবে তিনি আরোগ্য লাভ করার সংবাদে সাহাবায়েকরামের মাঝে যে বিপুল আনন্দ-উল্লাসের সঞ্চার হয়, তা এক অভূতপূর্ব ঘটনা। মহানবী (স.) এর সুস্থতার খবরে সাহাবিরা উচ্ছ্বসিত হয়ে অনেক দান-খয়রাত করেন। দিনটি ছিল সফর মাসের শেষ বুধবার। এ দিনকে স্মরণ করে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে যে ইবাদত ও উৎসব প্রচলিত তাই ‘আখেরি চাহার সোম্বা’।
আজ পবিত্র আখেরি চাহার শোম্বা। এ দিনটি মুসলিম বিশ্বে অত্যন্ত মর্যাদা ও গুরুত্বের সঙ্গে পালিত হয়ে থাকে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশের মুসলিমরা রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তি উদ্যোগে এ উৎসব-ইবাদত যথাযথ ধর্মীয় ভাবগম্ভীর্যের মাধ্যমে পালন করে থাকেন।
কিছু নির্দিষ্ট বিধি–বিধানের আলোকে ‘আখেরী চাহার শোম্বা’ পালন করা হয়। দিবসটি মূলত ‘শুকরিয়া দিবস’ হিসাবে পালিত হয়। যাতে সাধারণত গোসল করে দু’রাকাত শোকরানা–নফল নামাজ আদায় শেষে রোগ থেকে মুক্তির দোয়া ও দান–খয়রাত করা হয়। বিভিন্ন মসজিদ, মাদরাসা, দরবার, খানকায় ওয়াজ–নসিহত, জিকির–আজকার, মিলাদ মাহফিল, দোয়া ও মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়।
মোহাম্মদ (সা.)-এর কী অসুখ হয়েছিল?
মোহাম্মদ (সা.)-এর কী অসুখ হয়েছিল, তা নিয়ে দুটি বিবরণ পাওয়া যায়। ইবনে ইসহাক তার সিরাতে রাসুলুল্লাহ (সা.) গ্রন্থে দাবি করেন, মোহাম্মদ (সা.) বাকিউল গারকাদের কবরস্থান থেকে ফিরে প্রচণ্ড শিরপীড়ায় আক্রান্ত হন। অন্যদিকে সিরাতে রাসুলুল্লাহ (সা.) গ্রন্থের ব্যাখ্যাকার ইবনে হিশাম তার সিরাতুন নবী (সা.) গ্রন্থে বলেন, মোহাম্মদ (সা.) তার অন্তিম যাত্রায় প্রচণ্ড মাথাব্যথায় আক্রান্ত হন। মূলত মোহাম্মদ (সা.) প্রচণ্ড শিরপীড়ায় আক্রান্ত হওয়ার কারণে অসহ্য মাথাব্যথা অনুভব করেন। ওই মাথাব্যথা এতটা মারাত্মক ছিল, তিনি তার অন্তিমযাত্রার অধিকাংশ সময় অজ্ঞান ছিলেন। একটু সুস্থ হলেও আবার জ্ঞান হারাতেন।
আবিসিনিয়া থেকে আনা ওষুধ খাওয়ানো হলেও অবস্থার কোনও পরিবর্তন হয়নি। কিছুক্ষণ ভালো থাকলেও পরমুহূর্তে তিনি জ্ঞান হারাতেন। এ অবস্থায় মোহাম্মদ (সা.)-এর পরিবারের সদস্য ও সাহাবীরা তার বেঁচে থাকার আশা ছেড়ে দেন। ওই নিরাশার মধ্যেই একদিন মোহাম্মদ (সা.) আশার আলো জ্বালালেন। তিনি এক সকালে জ্ঞান ফিরে পেলেন। অনেকটা সুস্থ স্বাভাবিক আচরণ শুরু করেন। সাত কুয়োর জল দিয়ে গোসল করেন। নবী কন্যা ফাতেমা (রা.) এবং দুই নাতি হাসান (রা.) ও হোসেনকে (রা.) সঙ্গে নিয়ে দুপুরের খাবার খান। মোহাম্মদ (সা.)-এর ওই সুস্থ হওয়ার ঘটনায় তার পরিবারের সদস্য ও সাহাবীরা আনন্দে আত্মহারা হন। খুশিতে তারা আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে নফল নামাজ আদায় করেন। আল্লাহর নামে গরিব-দুঃখীর মাঝে সামর্থ্য অনুযায়ী দান-খয়রাত করেন। হজরত আবু বকর (রা.) পাঁচ হাজার, হজরত উমর (রা.) সাত হাজার, হজরত আলী (রা.) তিন হাজার দিরহাম এবং হজরত আবদুর রহমান বিন আউফ একশত উট দান করেন।
নবিপত্নী হজরত আয়েশা (রা.)-এর বিবরণ থেকে জানা যায়, সফর মাসের শেষ বুধবার মোহাম্মদ (সা.) হঠাৎ সুস্থ হয়ে ওঠেন। যদিও দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা নামতে নামতে মুহাম্মদ (সা.) আবারও অসুস্থ হয়ে পড়েন। কিন্তু ওই ঘটনাকে আজও মুসলিমরা প্রতিবছর স্মরণ করেন। সফর মাসের শেষ বুধবার ওই ঘটনা ঘটে বলে এর নামকরণ হয় আখেরি চাহার শোম্বা।