অনলাইন ডেস্কঃ পৃথিবীবিখ্যাত সাংবাদিক, লেখক, সাহিত্যিক, বিজ্ঞান গবেষক মার্ক টোয়েনের জন্মদিন আজ। ১৮৩৫ সালের ৩০ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রর ফ্লোরিডায় জন্মেছিলেন তিনি। তার জন্ম ও মৃত্যুর মধ্যে ব্যবধান ৭৫ বছরের। জন্ম ও মৃত্যু—দুবারই তার সঙ্গী ছিল হ্যালির ধূমকেতু। তার পুরো নাম স্যামুয়েল ল্যাংহর্ন ক্লেমেন্স। ‘মার্ক টোয়েন’ ছদ্মনামেই বিখ্যাত তিনি। ‘মার্ক টোয়েন’ শব্দটি আমেরিকার মিসিসিপি নদীর স্টিমবোটচালকদের একটা পরিভাষা। এর অর্থ ‘১২ ফুট গভীর পানি’। এটা নৌযান চলাচলের জন্য নদীর ন্যূনতম গভীরতা।
মিসিসিপি নদীর উপকূলবর্তী শহরে জন্মের চার বছর পর টোয়েন তার পরিবারের সাথে মিসিসিপি নদীর তীরবর্তী আরেক শহর মিসৌরির হ্যানিবলে গিয়েছিলেন। টোয়েনের মা ছিলেন হাসিখুশি ও আনন্দপ্রিয়। মায়ের কাছ থেকে এই গুণ পেয়েছিলেন তিনি। টোয়েনের বাবা ছিলেন আইনজীবী। টোয়েনের বয়স যখন মাত্র ১২, তখন তার বাবা মারা যান। বাবার মৃত্যুর পর পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে শুধু খাবারের বিনিময়ে ‘হ্যানিবল কুরিয়ার’ নামে স্থানীয় একটা পত্রিকায় কাজ শুরু করেন টাইপসেটার হিসেবে। পরে ‘হ্যানিবল ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন’ পত্রিকায় টাইপিংয়ের পাশাপাশি লেখালেখি আর সম্পাদনা করার সুযোগও পান। সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ২১ বছর বয়সে পত্রিকার কাজ ছেড়ে দিয়ে শুরু করেন স্টিমবোট চালানোর কাজ। আমেরিকার গৃহযুদ্ধ শুরু হলে কাজটা ছাড়তে বাধ্য হন টোয়েন। আর তখনই বেছে নেন ছদ্মনামটা।
তারপর টোয়েন কাজ নেন সোনার খনিতে। এর কিছুদিন পর আবার ফিরে যান সংবাদপত্রের জগতে। প্রতিবেদক হিসেবে যোগ দেন ‘দ্য টেরিটোরিয়াল এন্টারপ্রাইজ’ পত্রিকায়। রসাত্মক ভঙ্গিতে সংবাদ উপস্থাপন করতেন টোয়েন। সাংবাদিকতার পাশাপাশি শুরু করেন ছোটগল্প লেখা। এর কিছুদিন পর চলে যান সান ফ্রান্সিসকোতে। সেখানে গিয়েও সাংবাদিকতা আর লেখালেখি শুরু করেন। ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন আমেরিকার সবচেয়ে খ্যাতিমান লেখকদের একজন। এর মধ্যে বিভিন্ন এলাকায় রম্যবক্তৃতা দেওয়া শুরু করে তাতেও সুনাম অর্জন করেন টোয়েন।
লেখক হিসেবে মার্ক টোয়েন সর্বপ্রথম সাফল্যের দেখা পান যখন নিউইয়র্কের ‘দ্য স্যাটারডে প্রেস’ তার বড় রম্যগল্প ‘দ্য সেলিব্রেটেড জাম্পিং ফ্রগস অব ক্যালাভেরাস কাউন্টি’ প্রকাশ করে। তার লেখাটি জাতীয় পর্যায়ে খ্যাতি এনে দেয় এবং তার হাতে ওঠে জাতীয় পুরস্কার।
টোয়েনের লেখকজীবনের প্রথম দিকের একটা রচনা ‘ইনোসেন্টস অ্যাবরড’। পর্যটক হিসেবে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ফিলিস্তিন যাত্রার রোমাঞ্চকর কল্পিত কাহিনি বর্ণনা করেন মার্ক টোয়েন। শৈশবে নাবিক হয়ে সমুদ্রযাত্রার আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটে ওই রচনায়। বইটি তাঁকে খুব অল্প সময়ে জনপ্রিয় করে তোলে।
মার্ক টোয়েনের সমুদ্রযাত্রার স্বপ্ন একদিন ঠিকই পূরণ হয়। ইউরোপ ভ্রমণ থেকে ফেরার পথে জাহাজে পরিচয় হয় চার্লস ল্যাংডনের সঙ্গে। এ সময় চার্লস তার বোন অলিভিয়া ল্যাংডনের একটা ছবি টোয়েনকে দেখান। ছবি দেখে টোয়েন অলিভিয়ার প্রেমে পড়ে যান। পরে টোয়েন ওই ঘটনাকে ‘প্রথম দর্শনেই প্রেম’ হিসেবে অভিহিত করেন। ১৮৭০ সালে টোয়েন বিয়ে করেন ওই অলিভিয়া ল্যাংডনকেই।
১৮৭৬ সালে প্রকাশিত হয় মার্ক টোয়েনের বিখ্যাত উপন্যাস ‘অ্যাডভেঞ্চার অব টম সয়্যার’। সে বছরই প্রকাশিত হয় এটার সিকুয়েল ‘অ্যাডভেঞ্চার অব হাকলবেরি ফিন’। দুটি উপন্যাস বিশ্বসাহিত্যে ধ্রুপদি সাহিত্যের মর্যাদা লাভ করে তার জীবদ্দশায়ই। ‘টম সয়্যার’ চরিত্রটাকে নিজের প্রতিচ্ছবি হিসেবে উল্লেখ করেছেন টোয়েন। টম সয়্যার সিরিজের আরও দুটি উপন্যাস লিখে গেছেন তিনি।
বিখ্যাত বিজ্ঞানী নিকোলা টেসলা ছিলেন মার্ক টোয়েনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। টেসলার সঙ্গে বন্ধুত্ব তাকে বিজ্ঞান কল্পগল্প লিখতে অনুপ্রেরণা জোগায়। ১৮৮৯ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম বিজ্ঞান কল্পগল্পের বই ‘আ কানেটিকাট ইয়াংকি ইন কিং আর্থার্স কোর্ট’। শুধু বিজ্ঞান কল্পগল্প লেখাই নয়, বিভিন্ন রকম বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি নির্মাণের নেশাও ছিল তার। সে সময়ের লাখ দুয়েক ডলার খরচ করে নির্মাণ করেন একটা স্বয়ংক্রিয় টাইপসেটিং যন্ত্র।
মৃত্যুর এক বছর আগে টোয়েন বলেছিলেন, ‘১৮৩৫ সালে আমি আর হ্যালির ধূমকেতু এসেছিলাম একসঙ্গে। আগামী বছর সে আবার আসবে। জীবনের সবচেয়ে বড় অপ্রাপ্তি হবে তার সঙ্গে যেতে না পারা। বিধাতা হয়তো পাকাপাকি করে রেখেছেন, দুই দায়িত্বহীন উন্মাদ এসেছিল একসঙ্গে, যাবেও একসঙ্গে।’
টোয়েনের ভবিষ্যদ্বাণী সত্যি হয়েছিল। ৭৫ বছর পর ১৯১০ সালে ফিরে আসে হ্যালির ধূমকেতু। ২০ এপ্রিল ধূমকেতুটি পৃথিবী থেকে সবচেয়ে কাছে দৃশ্যমান হয়। তার পরদিন পৃথিবী ছেড়ে যান বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক মার্ক টোয়েন।
তথ্যসূত্র: সংগৃহীত