আজ ৬ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২১শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

শঙ্খচর

নতুন করে চাষাবাদ শুরু করেছেন শঙ্খ চরের সবজি চাষীরা


মো. কামরুল ইসলাম মোস্তফা, চন্দনাইশঃ বন্যার দুঃসহ স্মৃতি ভুলে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যয়ে নতুন করে সবুজ ফসল ফলাতে মাঠে নেমে গেছেন চট্টগ্রামের ‘সবজি ভান্ডার’ শঙ্খ চরের কৃষক-কৃষাণীরা। বন্যার ক্ষতিকে বুকে চেপে নিয়েই শত কষ্টের মধ্যেও নিজ উদ্যোগে ঋণ করে বন্যার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে আবারও নতুন করে সবজি চাষাবাদ শুরু করেছেন বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত সবজি চাষীরা। কেউবা জমি প্রস্তুত করছেন, কেউবা আবার প্রস্তুত করা জমিতে ফসলের বীজ বপণ করছেন। কেউবা জমিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বন্যার পানিতে ভেসে আসা লাকড়ি ও খড়কুটো অপসারণ করছেন। দুর্ভাগ্য যেন নিত্যসঙ্গী শঙ্খ চরের সবজি চাষীদের। প্রথমবারের ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে দ্বিতীয়বার সবজি আবাদ করেন তারা। এভাবেই চলছে তাদের জীবন সংগ্রাম।

চন্দনাইশ ও সাতকানিয়া উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত খরস্রোতা শঙ্খ নদী তীরবর্তী চর চট্টগ্রামের ‘সবজি ভান্ডার’ হিসেবে পরিচিত। এই চরে সারা বছর জুড়েই বিভিন্ন শাক-সবজি উৎপাদন হয়। এ অঞ্চলে শিল্পকারখানা না থাকায় শঙ্খ নদী তীরবর্তী লোকজন শাক-সবজি চাষের ওপর নির্ভরশীল। যাদের নিজস্ব জমি নেই তাঁরাও অন্যের জমি লিজ নিয়ে শাক-সবজি চাষ করেন। এতে শত শত পরিবার সচ্ছল ভাবে জীবিকা নির্বাহ করছেন। বেগুন, মূলা, শিম, ঢেঁড়শ, কাকরোল, চিচিঙ্গা, বরবটি, ঝিঙ্গা, তিত করলা, ফুলকপি, বাঁধাকপি, শসা, মিষ্টি কুমড়া, চালকুমড়া, লাউ, পেঁপে সহ বিভিন্ন ধরনের শাক উৎপাদন হয় এখানে। জমিতে ফলানো সবজি বিক্রি করে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার মুহূর্তে হঠাৎ বন্যার তাণ্ডবে ক্ষেত নষ্ট হয়ে সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পথে বসেছেন শঙ্খ চরের সবজি চাষীরা। গত ৭ আগস্ট থেকে ১০ আগস্ট পর্যন্ত টানা চার দিন অবিরাম মুষলধারে বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যায় চট্টগ্রামের ‘সবজি ভান্ডার’ এখন বিরানভূমিতে পরিণত হয়েছে।

সরেজমিন পরিদর্শনে গিয়ে কথা হয় শঙ্খ চরের সবজি চাষী দোহাজারী কিল্লাপাড়া এলাকার আবু তাহের কোম্পানির সাথে। তিনি বলেন, লাভের আশায় সবজির আবাদ করে সব হারিয়ে সবজি চাষীরা এখন নিঃস্ব। গত ১১ আগস্ট পানি নেমে যাওয়ার পর অনেকে নতুন করে সবজি চাষাবাদ শুরু করেছেন। বন্যার পর নতুন করে জমি তৈরি করা ও নতুন ফসল লাগানোতে সার, বীজের পাশাপাশি প্রয়োজন হয় লোকবলের। এজন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হয় টাকার। সেই টাকা সংগ্রহে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন চাষীরা। সেই ঋণ পরিশোধ করতে চলে যায় আরো কয়েক বছর। অনেকে মা-বোন, স্ত্রী-কন্যার গহনা বিক্রি বা বন্ধক দিয়ে টাকা যোগাড় করেন নতুন করে সবজি চাষাবাদ করতে।

পূর্ব দোহাজারী আজগর আলী বাড়ি এলাকার আহমদ মিয়া বলেন, বন্যার পানিতে শঙ্খ চরের সবগুলো ক্ষেত তলিয়ে গেছে। পুনরায় সবজি আবাদ করতে সহজে ঋণ পাওয়ার জন্য কৃষি বিভাগের সহযোগিতা খুবই প্রয়োজন সবজি চাষীদের।

খানবাড়ি এলাকার সামশুল ইসলাম বলেন, সবজি চাষীরা কিভাবে নতুন করে জমিতে ফসল বুনবেন সে সহযোগিতার দেখা মেলা কঠিন। ক্ষতিগ্রস্ত চাষীদের মধ্যে কৃষি কার্ডধারীদের সরকারিভাবে ধানের বীজ ও সার দেওয়া হলেও সবজি চাষীদের জন্য তা পর্যাপ্ত নয়। সহজ শর্তে ঋণ দিলে সবজি চাষীরা ভীষণ উপকৃত হবে।

শঙ্খ চরের সবজি চাষী কালিয়াইশ ইউনিয়নের মোজাম্মেল বলেন, জমিতে ফলানো সবজি বিক্রি করে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার মুহূর্তে হঠাৎ বন্যার তাণ্ডবে ক্ষেত নষ্ট হয়ে সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পথে বসেছেন শঙ্খ চরের সবজি চাষীরা। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ সরকারি ত্রাণ সহায়তা পেলেও চাষীরা নতুন করে চাষাবাদ করার জন্য সরকারি কোন সহযোগিতা পায়নি। চাষীদের খবর নেয়নি কেউ।

চন্দনাইশ উপজেলা কৃষকলীগ সাধারণ সম্পাদক নবাব আলী বলেন, দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে কৃষকদের উন্নয়নে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিরলস ভাবে কাজ করছেন। কৃষকদের বিনামূল্যে সার, বীজ প্রদানের পাশাপাশি বিভিন্ন প্রণোদনা ও ভর্তুকি দিয়ে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন তিনি। তবে, শিল্পকারখানাগুলোতে অগ্নিকান্ড হলে বীমার টাকা দিয়ে তারা যেভাবে নতুন করে কারখানা চালু করেন তেমনি কৃষকদেরকেও কৃষি বীমার আওতায় আনলে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকেরা বীমার টাকা দিয়ে নতুনভাবে চাষাবাদ করতে পারবেন।

দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে জিডিপির উল্লেখযোগ্য পরিমাণ যোগান কৃষিখাত তথা কৃষকদের কাছ থেকে আসলেও তারা পর্যাপ্ত সহযোগিতা পাচ্ছে না দাবি করে প্রাকৃতিক যে কোন দুর্যোগ পরবর্তী সময়ে পুনরায় চাষাবাদ করার জন্য সহজ শর্তে কৃষি ঋণ পেতে সহযোগিতা করার পাশাপাশি কৃষকদের কৃষি বীমার আওতায় আনার দাবি শঙ্খ চরের সবজি চাষীদের।

চন্দনাইশ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ আজাদ হোসেনের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে প্রতি বছরই দেশের কোথাও না কোথাও কম বেশি বন্যা দেখা দেয়। বন্যার কারণে মাঠের আউশ, রোপা আমন বীজতলা, বোনা আমন ও শাকসবজিসহ অন্যান্য ফসলের ক্ষয়ক্ষতি হয়। চন্দনাইশের দুইটি পৌরসভা ও আটটি ইউনিয়নে এক হাজার ৪০ হেক্টর সবজি, ৪৫০ হেক্টর আমন বীজতলা, ১২০ হেক্টর আউশ ও ১৫ হেক্টর রোপা আমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতির পরিমান টাকার অংকে আনুমানিক ৩১কোটি টাকা।

যেসব এলাকার চাষীরা ক্ষতির শিকার হয়েছেন তাঁদের তালিকা করে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবরে প্রেরণ করা হয়েছে। ইতিমধ্যে দুই হাজার কৃষকের জন্য মাথাপিচু পাঁচ কেজি করে ধানের বীজ বরাদ্দ পেয়েছি। ক্রমান্বয়ে তা কৃষকদের মাঝে বিতরণ করা হবে। নতুন করে সার ও বীজ সরবরাহ করার বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার পাশাপাশি প্রান্তিক কৃষকেরা যাতে আবারও ঘুরে দাঁড়াতে পারেন এজন্য কৃষি কার্ডধারী কৃষকদের সহজে কৃষি ঋণ পেতে সহযোগিতা করা হবে। কৃষকদের কৃষি বীমার আওতায় আনার বিষয়টি নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের বিষয় বলেও উল্লেখ করেন এই কর্মকর্তা।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     এই বিভাগের আরও খবর