চাটগাঁর সংবাদ ডেস্ক
তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ১২ হাজার ৫০০ টাকা করার প্রস্তাব শ্রম মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে মজুরি বোর্ড। এ প্রস্তাব চূড়ান্ত হলে এখনকার চেয়ে প্রায় ৫৬ শতাংশ বেশি মজুরি পাবেন গার্মেন্ট শ্রমিকরা। তবে এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে সমাবেশের ডাক দিয়েছে শ্রমিকদের ১১টি সংগঠন।
গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ন্যূনতম মজুরি বোর্ডের ষষ্ঠ সভা হয়। এতে ১২ হাজার ৫০০ টাকার ন্যূনতম মজুরির প্রস্তাব দেয় মালিকপক্ষ। পরে মজুরি বোর্ড তাদের প্রস্তাব মেনে নেয়। সভার পর গতকাল বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে সংবাদ সম্মেলন হয় সচিবালয়ে। সেখানে শ্রম প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান, ন্যূনতম মজুরি বোর্ডের চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী মোল্লা, মালিকপক্ষের প্রতিনিধি বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান, বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান, বিকেএমইএ সভাপতি একেএম সেলিম ওসমান, বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন ও মজুরি বোর্ডে শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধি সিরাজুল ইসলাম রনি উপস্থিত ছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, আগামী ১৪ দিনের মধ্যে মজুরির বিষয়ে প্রজ্ঞাপন হবে। শ্রমিকদের মজুরি কাঠামোতে পাঁচটি গ্রেড থাকবে। মোট মজুরির মধ্যে মূল বেতন হবে ৬৩ শতাংশ। তার মানে ১২ হাজার ৫০০ টাকা মোট মজুরির মধ্যে মূল বেতন হবে ৭ হাজার ৮৭৫ টাকা। আগামী ১ ডিসেম্বর থেকে নতুন মজুরি কাঠামো কার্যকর হবে।
ন্যূনতম মজুরির বিষয়ে শ্রমিক নেতা মোশরেফা মিশু বলেন, ‘মজুরি বোর্ড যে প্রস্তাব শ্রম মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে, তা সন্তোষজনক নয়।’
আরেক শ্রমিক নেতা নাজমা আক্তার বলেন, ‘মজুরি বোর্ডের প্রস্তাব পুনর্বিবেচনার সুযোগ রয়েছে। আমরা পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানাই।’
এদিকে প্রস্তাবিত ন্যূনতম মজুরি প্রত্যাখ্যান করে আগামী শুক্রবার প্রতিবাদ সমাবেশ ডেকেছে ১১টি সংগঠন। গতকাল বিকালে বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক জলি তালুকদার বলেন, ‘সাড়ে ১২ হাজার টাকায় চারজনের পরিবার চলা সম্ভব নয়। তাই আমাদের ২৫ হাজার টাকার দাবি পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানাচ্ছি।’
প্রস্তাবিত ন্যূনতম মজুরিকে ‘গ্রহণযোগ্য’ মনে করেন বাংলাদেশ জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক কর্মচারী লীগের সভাপতি ও ন্যূনতম মজুরি বোর্ডের শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধি সিরাজুল ইসলাম রনি। তিনি বলেন, ‘আমাদের বাস্তব অবস্থা বিবেচনায় নিতে হবে। শ্রমিকরা যেন কর্মচ্যুত না হন, তাদের যেন বাড়ি ফিরে যেতে না হয়, তাদের অবস্থা আমাদের দেখতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশনা দিয়েছেন, সে অনুসারে আমরা মনে করি, এটা বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বেঁচে থাকার জন্য মোটামুটি একটা অবস্থায় গিয়ে দাঁড়াবে। এটা গ্রহণযোগ্য।’
সংবাদ সম্মেলনে মন্নুজান সুফিয়ান বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে মালিক ও শ্রমিকপক্ষ এবং নিরপেক্ষ প্রতিনিধিদের নিয়ে দ্রুত নতুন মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘মজুরির যদি কোনো তারতম্য হয়ে যায়, আমরা শেষ সম্বল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দ্বারস্থ হই। উনার মৌখিক নির্দেশে আজ পোশাক কারখানার শ্রমিকদের সর্বনিম্ন মজুরি ঘোষণা করছি। শ্রমিকনেতা ও মালিকরা যারা আছেন, আহ্বান জানাব, আপনারা কারখানা খুলে দেবেন, শ্রমিক ভাইদের বলব কাজে যোগদান করতে।’ আন্দোলন-অবরোধের কারণে শিল্পাঞ্চলের বাড়ি ভাড়া মওকুফের জন্য মালিকদের প্রতি আহ্বান জানান প্রতিমন্ত্রী।
ন্যূনতম মজুরি বোর্ডে মালিকপক্ষের প্রতিনিধি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘মালিকপক্ষ সবসময় সহনশীল। মালিকপক্ষের সামনে দিয়ে যখন শ্রমিকরা ভাঙচুর করে, আমরা কিন্তু কখনো আমাদের শ্রমিকদের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে যাই না। শ্রমিকরা কাজ করেনি, তার পরও কারখানা বন্ধ রেখেছি, আমরা যথেষ্ট সহনশীল।’
২০১৩ সালে পোশাক খাতের ন্যূনতম মজুরি ৭৬ শতাংশ বাড়িয়ে ৫ হাজার ৩০০ টাকা করেছিল ন্যূনতম মজুরি বোর্ড। এরপর ২০১৮ সালে ন্যূনতম মজুরি তার চেয়ে প্রায় ৫১ শতাংশ বাড়ানো হয়। তখন ন্যূনতম মজুরি দাঁড়ায় ৮ হাজার টাকায়।
পোশাকশ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণের জন্য গত এপ্রিলে সরকার ন্যূনতম মজুরি বোর্ড গঠন করে। গত ২২ অক্টোবর বোর্ডের চতুর্থ সভায় শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধি ২০ হাজার ৩৯৩ টাকা ন্যূনতম মজুরির দাবি করে প্রস্তাব দেন। তার বিপরীতে মালিকপক্ষ প্রায় অর্ধেক বা ১০ হাজার ৪০০ টাকার মজুরি প্রস্তাব দেয়। মালিকপক্ষের এই মজুরি প্রস্তাবে ক্ষুব্ধ হয়ে শ্রমিকরা পরদিন আন্দোলনে নামে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, সাড়ে ১২ হাজার টাকা শ্রমিকদের জন্য যথেষ্ট নয়। সুতরাং এটি পুনর্বিবেচনার সুযোগ রয়েছে। আমি মনে করি, এর আগেও সরকারপ্রধান রাজনৈতিকভাবে এ ধরনের বিষয়াদি দেখেছেন। সরকারপ্রধান দেশের বাইরে থেকে ফিরলে মালিক প্রতিনিধি ও শ্রমিক প্রতিনিধিদের সঙ্গে মিশে যে প্রস্তাবনাটি এসেছে, আশা করি তা পুনর্বিবেচনার নির্দেশ দেবেন। আমরা আশা করি, ঘোষণাটি সরকারপ্রধানের কাছ থেকে আসবে।’
জানা গেছে, বর্তমানে ভারতে পোশাকশ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি ১৭১ মার্কিন ডলার। এ ছাড়া চীনে ৩০৩, কম্বোডিয়ায় ২০০, ইন্দোনেশিয়ায় ২৪২, ভিয়েতনামে ১৭০ এবং পাকিস্তানে ১১০ ডলার।