অনলাইন ডেস্কঃ একটি দেশের অর্থনীতিতে বিরাট ভূমিকা রাখে পর্যটন খাত। উদীয়মান অর্থনীতির দেশ হিসেবে বাংলাদেশেও এই খাত গুরুত্বপূর্ণ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে পর্যটন খাতে ৭২ লাখ ২৫ মানুষ প্রত্যক্ষভাবে কাজ করবেন। আর দেশের পর্যটন খাতের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্পট হলো কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত। তারা বলছেন, কক্সবাজারকে পরিকল্পিতভাবে পর্যটন নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে পারলে সামুদ্রিক ট্যুরিজমে এটি হতে পারে বিশ্বের অন্যতম আকর্ষণীয় স্পট।
মঙ্গলবার (১২ ডিসেম্বর) সকালে কক্সবাজারের শৈবাল হোটেলে আয়োজিত ‘কক্সবাজার: আশা-প্রত্যাশার পর্যটন’ শীর্ষক সেমিনারে তিনি এসব কথা বলেন। দেশের অন্যতম শীর্ষ অনলাইন গণমাধ্যম বাংলা ট্রিবিউন ও বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড যৌথভাবে এই সেমিনার আয়োজন করেছে।
আলোচনা সভার শুরুতে সঞ্চালক বাংলা ট্রিবিউনের বিশেষ প্রতিনিধি উদিসা ইসলাম বলেন, ‘সবসময় অভিযোগ করা হয়, গণমাধ্যম পর্যটন নিয়ে ভালো কিছু লেখে না। পর্যটনের যে সম্ভাবনার জায়গাগুলো আছে সেগুলো বলে না। গণমাধ্যম নেতিবাচক বিষয়গুলো তুলে আনে, যেন সেগুলোকে ইতিবাচক করা যায়। সেই জায়গা থেকে আমরা চেষ্টা করছি, পর্যটন খাতে যে পক্ষগুলো আছে তাদের সবাইকে নিয়ে আলোচনা করা যে দেশের পর্যটনে কী অবস্থা বিরাজ করছে, সেখানে কী করা সম্ভব। যারা দেশের বাইরে ঘুরতে যান, সেখানে যা দেখেন; তার পরিপ্রেক্ষিতে দেশের অবস্থা নিয়ে অনেকেই অভিযোগ করেন, পর্যটকরাই অনেক সময় অভিযোগ করেন। আমরা সেই বিষয়গুলো নিয়েই আলোচনা করতে চাই।’
সেমিনারে স্বাগত বক্তব্য দেন বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের উপপরিচালক মোহাম্মদ সাইফুল হাসান। কক্সবাজার সামুদ্রিক ট্যুরিজমের অন্যতম আকর্ষণীয় স্পট হতে পারে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমরা এতদিন বিদেশি ট্যুরিস্টদের নৌপথে আমন্ত্রণ জানাতে পারছিলাম না। কিন্তু মেরিটাইম পলিসির কারণে এখন সেই সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। আমরা খুব দ্রুত এটি নিয়ে কাজ করতে পারবো।’
সম্প্রতি বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড ও ইউএনডিপির একটি যৌথ সমীক্ষার তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারী কক্সবাজারের ৭১ শতাংশ পর্যটকই বলেছেন—এখানের খাবারের মান ভালো। তাদের ৫০ শতাংশ বলেছেন—এখানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভালো। কিন্তু ৫৩ শতাংশ পর্যটক সাগরে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই বলে জানিয়েছেন। আর ৩৬ শতাংশই বলেছেন—এখানে ট্রান্সপোর্টের দায়িত্বে যারা আছেন, তাদের আচরণে তারা সন্তুষ্ট নন। এই সমীক্ষার প্রতিটি ফলাফল নিয়ে আমরা কাজ করছি।’
আরও পড়ুন কক্সবাজারের পর্যটন খাতে হাজার কোটি টাকার ক্ষতির আশঙ্কা
কক্সবাজারে পর্যটক বাড়াতে ‘নাইটলাইফের’ ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন উল্লেখ করেন কক্সবাজার প্রেসক্লাব ও সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি মো. আবু তাহের। তিনি বলেন, ‘কক্সবাজারে পর্যটক বাড়াতে হলে নাইটলাইফের ব্যবস্থা করতে হবে। বাড়াতে হবে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা।’ সেইসঙ্গে রাস্তার পাশে পরিচ্ছন্ন খাবারের ব্যবস্থাও রাখতে হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
এই সংবাদকর্মী আরও বলেন, ‘কক্সবাজারে কি শুধু সমুদ্রসৈকত দেখার জন্য বিদেশি পর্যটকরা এখানে আসবেন? কক্সবাজারকে উন্নত পর্যটনকেন্দ্র গড়ে বিদেশি পর্যটক টানতে হবে। এজন্য সরকারি-বেসরকারিভাবে আন্তরিক ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন। সৈকতসহ বিভিন্ন পর্যটন স্পটে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা বাড়াতে হবে।’
নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে হোটেল-রেস্তোরাঁয় তৈরি খাবারের দাম বেড়ে যায়। এতে বড় প্রভাবক হিসেবে কাজ করে পণ্য পরিবহনে সংকট। তবে রেল যোগাযোগ চালু হওয়ায় সেই সংকট অনেকটাই কেটে যাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এর ফলে পর্যটন নগরী কক্সবাজারের হোটেল-রেস্তোরাঁগুলোতে খাবারের দামও কমতে পারে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির মহাসচিব ও হোটেল কল্লোলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইমরান হাসান। তিনি বলেন, ‘এখন রেল যোগাযোগ সহজ হয়েছে। আশা করছি আগামীতে উত্তরবঙ্গ থেকে যখন সবজি কক্সবাজারে আসবে, তখন হয়তো রেস্তোরাঁয় খাবারের দাম কমে যাবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘পর্যটন খাতে একটি বড় বাধা হচ্ছে ট্যাক্স বা ভ্যাট। প্রতিবছর ভ্যাট দিতে দিতে আমরা হয়রান। কক্সবাজারে ১২টি দফতর রয়েছে। তাদের সঙ্গে মোকাবিলা করতে গিয়ে আমাদের জান বেরিয়ে যায়। এখানে কে শোনে কার কথা—অবস্থা।’
এছাড়াও হোটেল ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন সংকটের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গা ইস্যুর কারণেও কক্সবাজারে বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তারা আসেন। তাদের নানা অনুরোধও রক্ষা করতে হয় আমাদের। এই রাষ্ট্রযন্ত্র যেভাবে ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, সেখানে কীভাবে পর্যটন ব্যবসা বাড়বে?’
রেস্তোরাঁকে শিল্প ঘোষণা করা হয়েছে, কিন্তু এই শিল্প টিকে থাকবে কীভাবে প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, ‘বাজারে নিত্যপণ্যে অস্থিরতা, সেইসঙ্গে গ্যাস-বিদ্যুতেরও দাম বেশি। সেই হিসাবে আমরা ব্যবসায়ীরা কোনও সুযোগ সুবিধাই পাই না।’
স্বাধীনতার ৫০ বছরে পর্যটনে কোনও পরিবর্তন হয়নি উল্লেখ করে ইমরান হাসান বলেন, ‘পর্যটন শিল্পকে উন্নত করতে দক্ষ কোনও লোক নেই। নেই কোনও প্রশিক্ষণ। পর্যটন শ্রমিক থেকে শুরু করে মালিকরা সবাই অদক্ষ। অথচ বিশ্বের নানা দেশের দিকে তাকালে দেখা যায় পর্যটন নিয়ে অনেক কিছু হচ্ছে।’
কক্সবাজার পর্যটন শিল্প নিয়ে ষড়যন্ত্র হচ্ছে অভিযোগ করে তিনি বলেন, ‘আমাদের খাদ্যে ভেজাল আছে—এমন কথা বলে মানুষের মনে এক ধরনের বিদেশি খাবারের প্রতি আকর্ষণ বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। আমাদের পরিকল্পনার অভাব কিংবা অব্যবস্থাপনা থাকতে পারে, কিন্তু আমাদের খাবারে ভেজাল নেই।’ এভাবে ভেজাল খাবারের তথ্য গণমাধ্যমে প্রচার করে একটা শ্রেণি দেশীয় বাজার নষ্ট করার চেষ্টা করছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা কক্সবাজারে পর্যটনের অন্যতম চ্যালেঞ্জ উল্লেখ করে কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ট্রাফিক) মো. জসিম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘কীভাবে পর্যটনের উন্নয়ন হবে? কক্সবাজারে ১২ লাখ রোহিঙ্গা আছে। হিসাব করলে স্থানীয়দের তুলনায় তারা দ্বিগুণ। কক্সবাজারে পরিবহন খাতেও রোহিঙ্গারা প্রবেশ করছে। হোটেল-রেস্তোরাঁসহ বিভিন্ন পর্যটন স্পটে নানা জায়গায় রোহিঙ্গা শ্রমিকরা প্রবেশ করছে।’ তারা নানান অপরাধেও জড়িয়ে পড়ছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আবু তাহের মুহাম্মদ জাবের। তিনি বলেন, ‘আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে পর্যটন খাতে ৭২ লাখ ২৫ হাজার মানুষ প্রত্যক্ষভাবে কাজ করবেন। এখানে আমরা এত দক্ষ মানুষ কোথায় পাবো? আমরা একটা আন্তর্জাতিক মানের ট্রেনিং ইনস্টিটিউট গড়ে তোলার কাজ করছি। এখানে যারা পড়াশোনা করবেন, তারা শুধু দেশেই নয়, বিদেশেও কাজের সুযোগ পাবে।’
তিনি বলেন, ‘রেস্টুরেন্ট আমাদের একটি শিল্প। এই শিল্প নিয়ে কীভাবে কাজ করা যায়, এ নিয়ে ট্যুরিজম বোর্ড কাজ করবে। একইসঙ্গে এই শিল্পের সঙ্গে যারা যারা সম্পৃক্ত; যেমন শিল্প মন্ত্রণালয়, এনবিআর সবাইকে নিয়ে বসে একটা সমাধানে আসার উদ্যোগ আমরা নেবো।’
দেশে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে মোট ১৭টা বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং সাতটি কলেজে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ট্যুরিজম বিষয়ে পড়ানো হয় উল্লেখ করেন আবু তাহের মুহাম্মদ জাবের। তিনি বলেন, ‘দুঃখজনক বিষয় হলো, প্রতিবছর আমাদের যে এক হাজার গ্র্যাজুয়েট তৈরি হয়, তাদের জন্য সেভাবে কাজের সুযোগ তৈরি করতে পারছি না। আরেকটা বিষয় হলো সামাজিক। আমাদের ছেলেমেয়েরা উচ্চশিক্ষা নিয়ে যখন সরকারি চাকরিজীবী হন, তখন তার শিক্ষক কিংবা পরিবার যেভাবে গর্ববোধ করেন, সেভাবে যারা হোটেল ম্যানেজমেন্ট কিংবা ট্যুরিজম নিয়ে পড়েন কিংবা এই সেক্টরে কাজ করেন সেভাবে তাদের সম্মানটা দেওয়া হয় না। এটা আমাদের সামাজিক একটা বড় সমস্যা। এই বিষয়টি নিয়ে আমরা কাজ করছি। চেষ্টা করা হচ্ছে, এই ছেলেমেয়েদের আমরা উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে পারি কিনা।’
পর্যটক এলে আমরা সমৃদ্ধ হবো, কিন্তু তাদের আমরা কী সেভাবে সহযোগিতা করেছি—প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, ‘সন্ধ্যার পরে পর্যটকদের বের হওয়ার যে বিষয়টা আলোচনায় অনেকে বলেছেন। আমি বলতে চাই, নির্বাচনের পর জানুয়ারি মাসে পরীক্ষামূলকভাবে এক মাস পর্যটকদের নিয়ে আমরা বিশেষ কর্মসূচি পালন করবো। পরবর্তী সময়ে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে নিরাপত্তার বিষয়ে জোরালোভাবে কাজ করবো।’
আলোচনায় পর্যটনের প্রতিবন্ধক হিসেবে ভিক্ষুক, শব্দদূষণ, যানজট ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রসঙ্গ উঠে আসে। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সংশ্লিষ্ট বিষয়ে চিঠি দিলে ট্যুরিজম বোর্ড এসব সমস্যা সমাধানে বিষয়ে উদ্যোগ নেবে। কারণ, অনেক বিষয় আছে, যেগুলো অন্যান্য দফতরের সঙ্গে যুক্ত। তাই কোনও চিঠি পেলে তারা সে বিষয়ে কাজ করতে পারবেন।’
সেমিনারে আরও বক্তব্য দেন বাংলা ট্রিবিউনের হেড অব প্ল্যানিং শেরিফ আল সায়ার, বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের উপ-পরিচালক মো. মাজহারুল ইসলাম, কক্সবাজার জেলা রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক রাশেদুল ইসলাম ডালিম, কক্সবাজার বিচ বাইক মালিক সমবায় সমিতির সভাপতি আনোয়ার ইসলাম হিরু ও সহ-সভাপতি মোহাম্মদ রাসেল, ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব কক্সবাজারের (টুয়াক) সাধারণ সম্পাদক নুরুল কবির পাশা প্রমুখ।
কক্সবাজারের পর্যটন নিয়ে বাংলা ট্রিবিউন ও বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের দুই দিনের আয়োজনের প্রথম দিন সোমবার (১১ ডিসেম্বর) ‘সৈকত থাকুক পরিচ্ছন্ন ও পর্যটকবান্ধব’ প্রতিপাদ্য নিয়ে পালন করা হয় সচেতনতামূলক কার্যক্রম। এদিন লাবণী পয়েন্ট থেকে সুগন্ধা পয়েন্ট পর্যন্ত সৈকত থেকে প্লাস্টিকসহ বর্জ্য সরানোর কাজে অংশ নেন শতাধিক স্বেচ্ছাসেবক।
সেমিনারের ফাঁকে পর্যটনের উন্নয়নে ভূমিকা রাখায় ‘আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবক দিবস-২০২৩’ উপলক্ষে কক্সবাজারের স্থানীয় পাঁচটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকে ক্রেস্ট প্রদান করা হয়।
দুই দিনের এই আয়োজনে বিশেষ সহযোগিতা করেছে বিকাশ। কর্মসূচির এয়ারলাইন পার্টনার ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স, নলেজ পার্টনার নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি, বেভারেজ পার্টনার কাজী অ্যান্ড কাজী টি এবং হসপিটালিটি পার্টনার হোটেল কল্লোল। স্বেচ্ছাসেবক ব্যবস্থাপনায় ছিল স্বেচ্ছাসেবীদের সংগঠন ইয়াসিদ।
তথ্যসূত্র: বাংলাট্রিবিউন