বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু ইতালিয় বংশোদ্ভূত ফাদার মারিনো রিগনের পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী পালিত হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার ২০ (অক্টোবর) মোংলা উপজেলার শেহালাবুনিয়া চার্চে তাঁর সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন, আত্মার শান্তি কামনায় ধর্মীয় প্রার্থনা এবং তাঁর কর্মময় জীবন নিয়ে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।
২০১৪ সালে ফাদার রিগন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসার জন্য ইতালি গমন করেন এবং ২০১৭ সালের ২০ অক্টোবর তিনি সেখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর আগে স্বজনদের কাছে তার শেষ মিনতি ছিল, মৃত্যুর পর তার মরদেহ যেন বাংলাদেশে সমাহিত করা হয়। তার শেষ ইচ্ছানুযায়ী ২০১৮ সালের ২১ অক্টোবর বাংলাদেশে ফেরত আনা হয় তার মরদেহ। বাগেরহাটের মোংলায় তার প্রতিষ্ঠিত শেহালাবুনিয়া চার্চে রিগনের মরদেহ এনে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়।
২০১২ সালে মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য তাঁকে মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা প্রদান করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের অকৃত্রিম বন্ধু, শিক্ষানুরাগী, অনুবাদক, কবি ও সাহিত্যিক ফাদার মারিনো রিগন ১৯২৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ইতালির ভিল্লাভের্লা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
ফাদার মারিনো রিগন বাংলাকে ভালোবেসে রপ্ত করেছিলেন বাংলা ভাষা। ভাষার প্রতি ভালোবাসার নিদর্শনস্বরূপ তিনি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা গীতাঞ্জলী, কবি জসিমউদ্দিনের নকশীকাঁথার মাঠ, সুজন বাদিয়ার ঘাট সহ ৪৮টি কাব্যগ্রন্থ, বাউল সম্রাট লালন শাহ'র ৩৫০টি গান ইতালিয় ভাষায় অনুবাদ ও সংকলন করে ব্যাপক সুনাম অর্জন করেন। কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি কবি জসিম উদ্দিন একাডেমী পুরষ্কারসহ অনেক সম্মাননা পেয়েছেন। ১৯৭৩ সালে কবি জসিমউদ্দিনকে সাথে নিয়ে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে দেখা করেন।
ফাদার রিগনের মৃত্যুতে তাঁর জীবন থেমে গেলেও থেমে যায়নি তার শুরু করে যাওয়া কর্মকাণ্ড। শিক্ষা বিস্তার ও সামাজিক কর্মকাণ্ডের উদ্দেশ্যে রিগনের নিজের হাতে গঠন করে যাওয়া ‘রিগন ফাউন্ডেশন’ সামাজিক নানা কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। ফাদার রিগনের রেখে যাওয়া কর্মকা-ের মধ্যে দিয়ে দেশের মানুষ তাকে স্মরণ করছে।
রিগন ফাউন্ডেশনের সভাপতি সুভাষ বিশ্বাস জানান, ফাদার মারিনো রিগনকে এবং তাঁর কী উদ্দেশ্য ছিল তা জানাতে ২০০৮ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত মোংলায় “রিগন মেলার” আয়োজন করা হয়। মেলায় রিগনের লেখা বই, অনুবাদ করা বই এবং যে সব পদক, এবং অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন সেই সব প্রদর্শন করা হয়েছে। তবে করোনার কারণে গত দুই বছর মেলা করা যায়নি। আগামী বছর মেলার আয়োজন করা হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
মোংলা উপজেলা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আহবায়ক নূর আলম শেখ জানান, নানা কর্মসূচির মধ্যে দিয়ে ফাদার মারিনো রিগনের পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী পালন করা হচ্ছে। তার সমাধিতে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ফুলের শ্রদ্ধা জানানো হয়। এছাড়া তার কর্মময় জীবন নিয়ে আলোচনা করা হয়।
[caption id="attachment_5447" align="alignnone" width="300"] ফাদার মারিনো রিগন[/caption]জানা গেছে, ১৯৫৩ সালের জানুয়ারি মাসে ২৮ বছর বয়সে ধর্ম প্রচার করতে ইতালি থেকে বাংলাদেশে আসেন ফাদার মারিনো রিগন। এরপর বাগেরহাটের মোংলার শেহলাবুনিয়া গ্রামে থেকে তিনি এই এলাকার শিক্ষা বিস্তারের উদ্যোগ নেন। একে একে গড়ে তোলেন ১৭টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। শিক্ষার্থীদের জন্য গড়ে তোলেন থাকার হোস্টেল। নারীদের আত্মকর্মসংস্থানের জন্য গড়ে তোলেন সেলাই কেন্দ্র।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মুক্তি যোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা দিতে ফরিদপুরের বানিয়ারচরে নিজের প্রতিষ্ঠিত চার্চে তিনি গোপনে চিকিৎসা ক্যাম্প স্থাপন করে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা ও সহায়তা প্রদান করতেন। মুক্তিযুদ্ধে তার এ অসামান্য অবদান ও সামাজিক কর্মকা-ের জন্য ২০০৯ সালে ৩০ ডিসেম্বর তাকে দেয়া হয় বাংলাদেশের সম্মান সূচক নাগরিকত্ব।
রিগন ফাউন্ডেশন থেকে সহায়তা নিয়ে লেখাপড়া করা কয়েকজন শিক্ষার্থী জানান, ফাদার মারিনো রিগন তাদের জীবনের আলোকবর্তিা জ্বেলেছেন। তাঁর সর্বাত্মক সহযোগিতা আজ তারা লেখাপড়া করে সার্থক পখে চলেছেন।