অনলাইন ডেস্কঃ দেশের প্রথম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে উদ্বোধন আজ। ২০১১ সালের ১৯ জানুয়ারি প্রথম চুক্তি সইয়ের এক যুগ পরে আলোর মুখ দেখছে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে।
তবে প্রথম পর্যায়ে উদ্বোধন হতে যাওয়া উত্তরার কাওলা থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত ১৩ টি সংযোগ সড়ক দিয়ে যান চলাচল শুরু করবে আগামী রোববার (২ সেপ্টেম্বর) সকাল ছয়টা থেকে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিমানবন্দরের কাওলা থেকে ১০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে ফার্মগেট আসতে সময় লাগবে ১০ মিনিট। এক্সপ্রেসওয়েতে গাড়ির সর্বোচ্চ গতিসীমা থাকবে ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটার। ফলে এ পথ পাড়ি দিতে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা সময় নষ্ট হবে না কর্মব্যস্ত নগরবাসীর।
তবে শুরু থেকে পরিকল্পনাবিদেরা বলছেন, একদিকে যেমন তাড়াতাড়ি এয়ারপোর্ট থেকে ঢাকায় আসা যাবে তেমনি ঢাকায় নামার পর এই গাড়িগুলো যানজটে পড়বে। আবার এয়ারপোর্ট থেকে তাড়াতাড়ি বনানী, তেজগাঁও, মহাখলী বা ফার্মগেট চলে আসা যাবে। আংশিক উদ্বোধনের ফলে যে গাড়িগুলো চট্টগ্রাম রোডে যেত সেগুলো একই ভাবে এখন ঢাকায় নেমে যানজট তৈরি করে ঢাকা ছাড়বে।
যা চলবে না এক্সপ্রেসওয়েতে
এক্সপ্রেসওয়ের ওপর দিয়ে থ্রি-হুইলার, মটর বাইক, বাই সাইকেল, পথচারী চলাচল করতে পারবে না। কোথাও থেমে ছবি তোলা যাবে না। এক্সপ্রেসওয়ে’তে কেবলমাত্র চলতে চার চাকা কিংবা এর অধিক চাকার বাস, ট্রাক ও প্রাইভেট কার।
বিভিন্ন বাহনের টোল হার
চার ক্যাটাগরিতে টোল আদায় হবে। ক্যাটাগরি-১ এ কার, ট্যাক্সি, জিপ, স্পোর্টস ইউটিলিটি ভেহিক্যাল, মাইক্রোবাস (১৬ সিটের কম) এবং হালকা ট্রাক (৩ টনের কম) ৮০ টাকা, ক্যাটাগরি-২ এ মাঝারি ট্রাক (৬ চাকা পর্যন্ত) ৩২০ টাকা, ক্যাটাগরি-৩ এ ট্রাক (৬ চাকার বেশি) ৪০০ টাকা, ক্যাটাগরি-৪ এ সব ধরনের বাস (১৬ সিট বা তার বেশি) ১৬০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
কোথায় কোন র্যাম্প
বর্তমানে প্রকল্পের হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের দক্ষিণে কাওলা থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত অংশ যান চলাচলে জন্য প্রস্তুত হয়েছে। এ অংশের মেইন লাইনের দৈর্ঘ্য ১১ দশমিক ৫ কিলোমিটার এবং র্যাম্পের দৈর্ঘ্য ১১ কিলোমিটার। র্যাম্পসহ মোট দৈর্ঘ্য ২২ দশমিক ৫ কিলোমিটার। এ অংশে ওঠা নামার জন্য মোট ১৫ টি র্যাম্প থাকবে। এর মধ্যে এয়ারপোর্ট দুইটি , কুড়িল তিনটি, বনানী চারটি, মহাখালী তিনটি, বিজয়স্বরণী দুইটি ও ফার্মগেট একটি। এর মধ্যে ১৩ টি র্যাম্প যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা হবে। উত্তর হতে দক্ষিণ অভিমুখী যানবাহন ওঠবে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দক্ষিণে কাওলা; প্রগতি সরণি এবং বিমানবন্দর সড়কের আর্মি গলফ ক্লাব হতে আর নামবে বনানী কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউ; মহাখালী বাস টার্মিনাল এর সামনে; ফার্মগেট প্রান্তে ইন্দিরা রোডের পার্শ্বে। দক্ষিণ হতে উত্তর অভিমুখী যানবাহন উঠবে বিজয় সরণি ওভারপাসের উত্তর এবং দক্ষিণ লেন; বনানী রেল স্টেশনের সামনে। আর নামবে মহাখালী বাস টার্মিনাল এর সামনে; বনানী কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউ এর সামনে বিমানবন্দর সড়ক, কুড়িল বিশ্বরোড এবং বিমানবন্দর ৩য় টার্মিনাল এর সামনে। তবে মহাখলীততে একটি ওঠার র্যাম্প ও বনানীতে সড়ক ভবনের পাশের ওঠার র্যাম্প আপাতত বন্ধ থাকছে।
সুবিধা ও অসুবিধা
প্রকল্পটি নির্মাণের সুবিধার্থে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এয়ারপোর্ট-বনানী রেলস্টেশন পর্যন্ত। বনানী রেলস্টেশন-মগবাজার পর্যন্ত। মগবাজার-চিটাগাং রোডের কুতুবখালী পর্যন্ত। উত্তরাঞ্চল থেকে আসা যানবাহনগুলো ঢাকাকে পাশ কাটিয়ে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে যেতে পদ্মা সেতুগামী বঙ্গবন্ধু এক্সপ্রেসওয়ে’তে সরাসরি ওঠে যাবে। অন্যরুটে দিয়ে যাবে চট্টগ্রাম ও সিলেটে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ বলেন, এই এক্সপ্রেসওয়ের উদ্দেশ্য ছিল শহরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে গাড়িগুলো যানজট ছাড়া চলাচল করতে পারবে। এক্সপ্রেসওয়ের একটা চরিত্র আছে। যেখানে গাড়িগুলো বাধাহীন ভাবে চলে যেতে পারবে। তবে এখানে দেখা গেছে অনেক জায়গায় র্যাম্প নামানো হয়েছে। এতে করে হয়ত বাণিজ্যিক সুবিধা বাড়বে। তবে শহরের মধ্যে যেসব জায়গায় র্যাম্প থাকবে সেখানে ট্রাফিক পদ্ধতি ঠিক না করা গেলে যানজট বাড়বে।
এই পরিকল্পনাবিদ বলেন, আংশিক উদ্বোধনের ফোলে এটার মূল যে উদ্দেশ্য ব্যহত হচ্ছে। যে উদ্দেশ্যে এটি করা হয়েছিল সেটির অনেক পরিবর্তন হয়েছে। সাময়িক খুলে দেওয়ার জন্য সুবিধা ও অসুবিধা দুটিই থাকবে।
পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. এম শামসুল হক বলেন, এখনকার বাস্তবতায় এই এক্সপ্রেসওয়ে দৃশ্যমান, টেকসই ও পিক আওয়ারে সমাধান দিতে পারবে না। এই এক্সপ্রেসয়ের বেশি সুবিধা পাবে ব্যক্তিগত যান। ২০১৩ সালে যখন এটা হওয়ার কথা ছিল তখকার প্রফেক্ষাপট এক রকম ছিল। আর এখন সেটা ভিন্ন রকম।
বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক এ পরিচালক বলেন, তবে ফার্মগেট অংশে যে যানবাহনগুলো নামবে তারা একটা সুবিধা পাবে কারণে এরপর মানিক মিয়া এভিনিউতে বড় একটা রাস্তা আছে। তবে বনানী ও মহাখলী যেখানে নামবে সেখানে আগে থেকেই যানজট রয়েছে। মহাখালী অংশে বড় গাড়ির একটা জট থাকে। আবার বইনানীতেও গাড়ির জট থাকে।
ঢাকার মেট্রোরেল, হাতিরঝিল প্রকল্পসহ উল্লেখযোগ্য বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের পরামর্শক এবং কুড়িল ইন্টারচেঞ্জের পরিকল্পনাকারী বলেন, শহরের যে জায়গাগুলোতে যানবাহন নামবে সেখানে ধারণক্ষমতা নেই। তাই এমন এক্সপ্রেসওয়ে কোন সমাধান দিতে পারে না।
প্রকল্পের সর্বশেষ অগ্রগতি
প্রকল্প পরিচালক এ এইচ এম এস আকতার বলেন, যে অংশটুকু উদ্বোধন হবে সেখানে সবধরনের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। উদ্বোধনের পরেরদিন অর্থাৎ ৩ তারিখ ভোর ৬ টা থেকে যানবাহনের জন্য খুলে দেওয়া হবে।
তিনি বলেন, একইসঙ্গে বাকি অংশের কাজও চলছে। সবমিলিয়ে ৬৫ শতাংশের ওপরে কাজ হয়েছে। ঢাকা শহরের মধ্যে দিয়ে এমন প্রকল্প বাস্তবায়নে বিভিন্ন ধরণের সমস্যা থাকে। তবে সেসব সমস্যা কাটিয়ে তুলে কাজ হচ্ছে।
প্রসঙ্গত, ২০১১ সালের ১৯ জানুয়ারি এ প্রকল্পের প্রথম চুক্তি সই করা হয়। এই প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয়েছে ২০১১ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত। প্রকল্পের বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান ফার্স্ট ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে কোম্পানি লিমিটেডের সঙ্গে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের ১৫ ডিসেম্বর ২০১৩ তারিখে সংশোধিত চুক্তি সই হয়। প্রকল্পটি থাইল্যান্ড ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ইটালিয়ান থাই ডেভেলপমেন্ট পাবলিক কোম্পানি লিমিটেড ৫১ শতাংশ এবং চায়না ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান শোনডং ইন্টারন্যাশনাল ইকোনোমিক গ্র্যান্ড টেকনিক্যাল কো-অপারেশন গ্রুপ ৩৪ শতাংশ ও সিনোহাইড্রো কর্পোরেশন লিমিটেড ১৫ শতাংশ যৌথ উদ্যোগে নির্মিত হচ্ছে। প্রকল্পের মূল দৈর্ঘ্য ১৯ দশমিমক ৭৬ কিলোমিটার। র্যাম্পসহ মোট দৈর্ঘ্য ৪৬ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার।
প্রকল্পের মোট ব্যয় ৮৯৪০ কোটি টাকা যার ২৭ শতাংশ বাংলাদেশ সরকার এবং বাকি অংশ ভিজিএফ হিসেবে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানকে প্রদান করবে। তবে ভূমি অধিগ্রহণ, নকশা বদল, অর্থ সংস্থানের জটিলতায় ৪ বার সময় বৃদ্ধির ফলে ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজার ৮৫৮ কোটি টাকায়।
তথ্যসূত্র: বাংলানিউজ২৪