মোস্তফা কামাল নিজামী (চিশতী): ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’-এর পরিকল্পনা বাস্তবায়নে চট্টগ্রামও বদলে যাচ্ছে ‘স্মার্ট চট্টগ্রামে’। এই বিভাগের যোগাযোগ ব্যবস্থা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি ও আর্থিক খাতকে স্মার্ট রূপে গড়ে তোলা হচ্ছে। এজন্য ৫০টি নতুন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। এগুলো বাস্তবায়ন হলে চট্টগ্রাম পুরোপুরি বদলে যাবে স্মার্ট চট্টগ্রামে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্মার্ট চট্টগ্রাম বিনির্মানে প্রথমত প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে এই বিভাগের বন্দর নগরী খ্যাত চট্টগ্রাম জেলাকে। এর আওতায় নগরীর লালখান বাজারে নেয়া হয়েছে একটি পাইলট প্রকল্প। এ প্রকল্পের কাজ শেষ হলে লালখান বাজার এলাকায় কোনো দৃশ্যমান ক্যাবল (বৈদ্যুতিক বা অন্যান্য) থাকবে না। ক্যাবল গুলো নেয়া হবে মাটির নীচ দিয়ে। ইতোমধ্যে এ প্রকল্পে কাজ শুরু করেছেন লালখান বাজার ওয়ার্ডের কাউন্সিলর।
চলতি বছরের অক্টোবরের মধ্যে এই প্রকল্পের কাজ শেষ হতে পারে বলে চাটগাঁর সংবাদকে জানিয়েছেন তিনি। এ প্রসঙ্গে আলাপকালে কাউন্সিলর আবুল হাসনাত মো. বেলাল বলেন, এই পাইলট প্রকল্পের কাজ এখন চলমান রয়েছে। ইতোমধ্যে কয়েকটি এলাকার ক্যাবল খুলে মাটির নীচ দিয়ে নেয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে পুরো ওয়ার্ডটিতে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে।’
প্রকল্পের ব্যয় কত হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটি আমার ব্যক্তিগত উদ্যোগের একটি প্রকল্প। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো খরচ আমি নিচ্ছি না। পুরো খরচটাই আমি দিচ্ছি। তাই কাজ শেষ না হওয়া অবধি ব্যয়ের বিষয়ে এখনই কিছু জানাতে পারছি না। এই প্রকল্প সফলভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) আওতাধীন সবগুলো ওয়ার্ডে এটি করা হবে। তখন চসিকের ওই নতুন প্রকল্পে ব্যয়ের বিষয়টি আসবে।’
‘স্মার্ট চট্টগ্রাম’ রূপান্তরে জেলা প্রশাসনের আরেকটি প্রকল্প হলো ‘স্মার্ট বিলিং লাইসেন্স’। এর আওতায় সব ধরণের লাইসেন্স প্রদান করা হবে অনলাইনে। এক্ষেত্রে ক্যাশলেস ডিলিং হবে।
‘স্মার্ট চট্টগ্রাম’ গড়তে নগরীতে ‘স্মার্ট স্কুল বাস’ পরিচালনার উদ্যোগ নিয়েছে জেলা প্রশাসন। সাতটা রুটে এই ধরনের বাস চলাচল করবে। এর ফলে অভিভাবকদের দুঃশ্চিন্তা অনেকটাই কমে যাবে। কারণ এসব বাসে থাকবে গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম (জিপিএস) ট্র্যাকিং, প্রশিক্ষিত চালক, অনলাইন ক্যামেরা। এর অংশ হিসেবে বর্তমানে জেলা প্রশাসনের পরিচালনায় চলছে ‘স্মার্ট ট্যুরিস্ট বাস’। যদিও এটি এখনও ট্রায়াল ভার্সনে রয়েছে এবং আধুনিক প্রযুক্তির অনেকগুলো এখনও বাসগুলোতে ব্যবহার করা হয়নি। কিন্তু পর্যটন শিল্পকে স্মার্ট রূপে গড়তে সেগুলোকেও পরিকল্পনার আওতায় আনা হবে।
শহরের মতো গ্রামাঞ্চলকেও স্মার্ট চট্টগ্রামের আওতায় আনতে গুরুত্ব দিচ্ছে জেলা প্রশাসন। কৃষি খাতকে গুরুত্ব দিয়ে ‘শেয়ারড এগ্রি ইক্যুপমেন্ট লেবার’ প্রকল্প নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। এর ফলে চট্টগ্রাম জেলার সবগুলো উপজেলা ও ইউনিয়নের কৃষকরা নিজেদের মধ্যে কৃষিযন্ত্র, শস্য, শ্রমিক ইত্যাদি সহজে বিনিময় করতে পারবেন।
জেলা প্রশাসন সূত্রে আরো জানা গেছে, পটিয়ার হাইটগাঁওয়ের আশ্রয়ণ প্রকল্পটিকে স্মার্ট গ্রামে রূপান্তরের কাজ করা হচ্ছে। এর নামকরণ করা হয়েছে শেখ হাসিনা স্মার্ট ভিলেজ। এছাড়া চট্টগ্রাম জেলার ১৯১টি ইউনিয়নে মডেল মাঠ ও কালচারাল গ্রাউন্ড স্থাপনের একটি প্রকল্প নেয়া হয়েছে।
‘স্মার্ট চট্টগ্রাম’ প্রসঙ্গে আলাপকালে জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান চাটগাঁর সংবাদকে বলেন, ‘স্মার্ট বাংলাদেশ কিংবা স্মার্ট চট্টগ্রাম গড়তে যোগাযোগ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি ও আর্থিক খাতে প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার শুরু হবে। এখানে একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো কেবল সবগুলো খাত স্মার্ট হলেই চলবে না, সোসাইটি এবং জনসাধারণকেও স্মার্ট হতে হবে। স্মার্ট চট্টগ্রামের অর্থ হলো সব খাতের সেবা ডিজিটালাইজেশন করানো। সেক্ষেত্রে সেবাগ্রহীতাদেরও স্মার্ট হওয়ার বিকল্প নেই। চট্টগ্রামে স্মার্ট বাংলাদেশের যাত্রা যে শুরু হয়ে গেছে, তার উদাহরণ এখন সর্বত্র। তবে এর জন্য প্রয়োজন সমন্বিত পদক্ষেপ।’
নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ কিংবা স্মার্ট চট্টগ্রাম গড়ার মূল চাবিকাঠি হলো ডিজিটাল সংযোগ। এই বিভাগে ইতোমধ্যে উদ্বোধনের অপেক্ষায় রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার নদীতলদেশের দীর্ঘতম সুড়ঙ্গপথ ‘বঙ্গবন্ধু টানেল’, দেশের চতুর্থ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও ঢাকা থেকে কক্সবাজারের নিরবিচ্ছিন্ন রেলপথ। সেপ্টেম্বরে বঙ্গবন্ধু টানেল যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেয়ার কথা রয়েছে। প্রকল্পটিতে মূল টানেলের পশ্চিম ও পূর্ব প্রান্তে সংযোগ সড়ক এবং আনোয়ারা প্রান্তে থাকছে একটি ফ্লাইওভার। টানেলটি হয়ে উঠবে ‘দুই শহরের এক নগরী’ এবং কর্ণফুলী নদীর তলদেশে তৈরি হওয়া প্যাসেজওয়ে। স্মার্ট চট্টগ্রামের জন্য এটি একটি বাস্তব পদক্ষেপ, যা কেবল চট্টগ্রামের নয় সারাদেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করবে।
স্মার্ট চট্টগ্রামের অন্য আরেকটি উদাহরণ হচ্ছে ঢাকা থেকে কক্সবাজারের নিরবিচ্ছিন্ন রেলপথ। রেলওয়ে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে চলতি বছর এই রেলপথে ঢাকা থেকে কক্সবাজারে নিরবিচ্ছিন্ন রেলপথে ট্রেন পৌঁছুবে।
এছাড়া কক্সবাজারের পুরানো বিমানবন্দরটি স্মার্ট রূপে রূপান্তরিত করে দেশের চতুর্থ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হতে যাচ্ছে। এটিও স্মার্ট চট্টগ্রামের অনন্য আরেকটি উদাহরণ। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে এই বিমানবন্দরের উদ্বোধন করার কথা রয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। এর ফলে কক্সবাজারের পর্যটন অর্থনীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে বলে মনে করা হচ্ছে।
অ্যাস্পায়ার টু ইনোভেট (এটুআই) এর প্রকল্প পরিচালক, মন্ত্রিপরিষদ ও আইসিটি বিভাগের যুগ্মসচিব ড. দেওয়ান মুহম্মদ হুমায়ুন কবির জানান, ‘২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হবে জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি ও উদ্ভাবনী বাংলাদেশ যার স্তম্ভ হবে চারটি। স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট গভর্নমেন্ট, স্মার্ট ইকোনমি এবং স্মার্ট সোসাইটি।’
ড. হুমায়ুন এ প্রসঙ্গে ডা. বার্নাড লনের একটি উদ্ধৃতি তুলে ধরে বলেন, ‘যিনি অদৃশ্যকে দেখতে পারেন তিনিই অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারেন। বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অদৃশ্যকে দেখতে পেরেছেন বলেই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ আজ ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ এ রূপান্তরিত হয়েছে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’
বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে।’
বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার স্মার্ট বাংলাদেশ বাস্তবায়নের উদ্যোগে ঢাকার পরেই প্রাধান্য দিচ্ছে চট্টগ্রাম বিভাগকে। তবে এই বিভাগে চট্টগ্রাম জেলাকে দেশের প্রথম স্মার্ট জেলা হিসেবে গড়তে চায় চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন।
এ প্রসঙ্গে আলাপকালে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) মো. আব্দুল মালেক চাটগাঁর সংবাদকে বলেন, ‘চট্টগ্রামকে স্মার্ট সিটিতে রূপান্তরিত করতে ১২২টি প্রকল্পের আইডিয়া নিয়ে কাজ শুরু করেছিলাম। এরমধ্যে ৫০টি প্রকল্পে কাজ হচ্ছে। এছাড়া আরো কিছু নতুন প্রকল্পের প্রস্তাব সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। ইনশাহআল্লাহ আমরা আশাবাদি, ২০৪১ এর অনেক আগেই চট্টগ্রাম ‘স্মার্ট চট্টগ্রামে’ রূপান্তরিত করা হবে।’