আজ ২৭শে ফাল্গুন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১২ই মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

সংগৃহীত ছবি

ফিরে দেখা


অনলাইন ডেস্কঃ বরেণ্য রাজনীতিবিদ আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর জীবন ছিলো সাফল্যে প্রাচুর্য্যপূর্ণ। চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে ভয় পেতেন না তিনি। যেখানে যে সময় মেধা ব্যয় করতেন উজান ঠেলে সফলতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছাতেন। আজ তার মৃত্যুবার্ষিকীতে ফিরে দেখা যাক সেকাল।

আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ১৯৪৫ সালের ৩ মে আনোয়ারা উপজেলার হাইলধর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার পিতা নুরুজ্জামান চৌধুরী ও মা খোরশেদা বেগম। পটিয়া উচ্চ বিদ্যালয় ও ঢাকা নটর ডেম কলেজে পড়াশোনা করেছেন আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু। শিক্ষা বৃত্তি নিয়ে উচ্চ শিক্ষা অর্জনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ইলিয়ন ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে অধ্যয়ন করেছিলেন। পরে নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যবসা প্রশাসনে ডিগ্রি অর্জন করে ১৯৬৪ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশে ফিরে আসেন। তিনি চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর শিল্পপতি সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মেয়ে নূর নাহারুজ্জামানের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৬৫ সালে পারিবারিক ব্যবসায় যোগ দেন তিনি। ছিলেন একজন সফল শিল্পোদ্যোক্তা।
বিচক্ষন এই ব্যক্তি প্রথম ব্যবসায়ী জীবনে চট্টগ্রাম নগরীর বাটালি রোডে রয়েল ইন্ডাস্ট্রি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পরে আসিফ স্টিল মিল, জাবেদ স্টিল মিল, আসিফ সিনথেটিক, প্যান আম বনস্পতি, আফরোজা অয়েল মিল, বেঙ্গল সিনথেটিক প্রোডাক্টসহ কয়েকটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। এছাড়া জামান শিল্প গোষ্ঠী ও বিদেশি মালিকানাধীন আরামিট কারখানা কিনে আরামিট গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি। বাংলাদেশের ব্যাংকিং জগতের পথিকৃৎ আখতারুজ্জামান বাবু নিজ চেষ্টায় গড়ে তুলেছিলেন ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেড। দুই দফা চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি এ ব্যবসায়ী নেতা দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই এরও সভাপতি ছিলেন। তিনি ওআইসিভুক্ত দেশের চেম্বার সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এ সুবাধে ১৯৮৯ সালে তিনি ৭৭টি জাতির গ্রুপে ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এই ঘনিষ্ট সহচর, মুক্তিযুদ্ধেও লড়াকু সৈনিকের ভূমিকা পালন করেছিলেন। তার রাজনীতি জীবনের শুরুটা হয়েছিলো ১৯৬৭ সালে। ১৯৬৮ সালে তিনি দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের সদস্য নির্বাচিত হন। সত্তরের সাধারণ নির্বাচনে আনোয়ারা ও পশ্চিম পটিয়া থেকে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি।

আখতারুজ্জমান চৌধুরী বাবুকে কেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক বলা হয়?
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে অসহযোগ আন্দোলনের সময় পাথরঘাটা ‘জুপিটার হাউস’ থেকে সংগ্রাম কমিটির কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতো। সেই জুপিটার হাউসের সত্ত্বাধিকারী ছিলেন আখতারুজ্জমান চৌধুরী বাবু। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা চট্টগ্রামে আসার পর ওই হাউস থেকেই সাইক্লোস্টাইল করে প্রচার করা হতো। তার বাসা থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রসহ সব জায়গায় পাঠানো হয়েছিলো। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামের চেরাগী পাহাড় মোড়ে প্রথম শহিদ হয়েছিলেন আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর সহোদর বশরুজ্জামান চৌধুরী। ভাইকে হারানোর পর মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ভারতে গিয়ে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন দায়িত্ব¡ পালন করেছিলেন। তিনি মুজিবনগর সরকারের ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিটির সদস্য ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তিনি বিশ্বজনমত গড়তে ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চলে গিয়েছিলেন। এরমধ্যে তিনি প্রথমে গিয়েছিলেন লন্ডনে। সেখান থেকে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের সদস্য হয়ে আমেরিকাতেও গিয়েছেন। এ কারণে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭০ সালের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত সদস্য হিসেবে তাকে ১৯৭২ সালে গঠিত বাংলাদেশ গণপরিষদের সদস্য করা হয়। এজন্য বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ণেও ভূমিকা রাখতে পেরেছিলেন তিনি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি তিনি জীবদ্দশায় পাননি। দেশ স্বাধীন হওয়ার প্রায় পঞ্চাশ বছর পর তার পক্ষে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি মরণোত্তর স্বাধীনতা পদক গ্রহণ করেছেন তার সুযোগ্য সন্তান বর্তমান সরকারের ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ।

যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গঠনে যে আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর ভূমিকা- বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর যুদ্ধবিধস্ত চট্টগ্রামের পুনর্গঠনে অন্যতম ভূমিকা রেখেছিলেন আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু। ওইসময় তাকে দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। যুদ্ধের পর এ অঞ্চলের বিপর্যস্ত ব্যবসায়ীক পরিবেশে সুবাতাস ফেরাতে তার পদক্ষেপগুলো ছিলো দূরদর্শী। বঙ্গবন্ধুকে তিনি সর্বদা সুপরামর্শ দিয়ে চট্টগ্রামসহ সারাদেশের সার্বিক উন্নয়নের মহাপরিকল্পনাতেও ভূমিকা রেখেছিলেন। চট্টগ্রামে তার বিকল্প নেতৃত্ব না থাকায় মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাকে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আ. লীগের সভাপতি পদে বহাল রেখেছিলো বাংলাদেশ আ. লীগ। তিনি কেন্দ্রীয় আ. লীগের শিল্প ও বাণিজ্য সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেছেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হলে অন্যান্য শীর্ষ নেতাদের মতো তিনিও মুষড়ে পড়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে নিজেকে সামলে নিয়ে দলীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে পুনরায় যোগাযোগ করা শুরু করেন তিনি। অক্লান্ত পরিশ্রম ও দূরদর্শীতায় তিনি দেশের মতো দলের পুনর্গঠনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। কিন্তু আশির দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত থাকায় কারাভোগসহ নানাবিধ নির্যাতনের শিকার হতে হয় তাকে। ধনী, গরিবসহ সব স্তরের মানুষের আস্থা অর্জন করেছিলেন আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু। এ কারনে চট্টগ্রাম থেকে ১৯৭০, ১৯৮৬, ১৯৯৬ ও ২০০৮ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     এই বিভাগের আরও খবর