এ টি এম পেয়ারুল ইসলামঃ ৮ মে ছিলো বিশ্ব মানবতার ইতিহাসে চিরভাস্বর মানবদরদী মহামানব, রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা জঁ অঁরি দাঁ (ঔবধহ ঐবহৎর উঁহধহঃ) এর জন্মদিন। প্রায় দুশ বছর আগে অর্থাৎ ১৮২৮ সালের ৮ মে সুইজারল্যান্ডের জেনেভা শহরে ব্যবসায়ী ও সমাজসেবক জীন জ্যাকস দম্পতির কোল আলো করে জন্ম নেন মহামতি জঁ অঁরি দাঁ সোজাসাপ্টা উচ্চারণে জীন হেনরী ডুনান্ট হিসেবেই যাকে আমরা চিনি। ১৯৪৮ সাল হতে তার জন্মদিনটি রেডক্রস তথা রেডক্রিসেন্ট দিবস হিসাবে উদযাপিত হয়ে আসছে। গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করতে হবে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যার আমলে তথা ১৯৭৩ সালের ৩১ মার্চ বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির কার্যক্রমের সূচনা হয়ে ২ নভেম্বর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায়। তাছাড়া তিনি ১৯৭৩ সালে ২৬ নং রাষ্ট্রপতির আদেশমূলে একে সহযোগী ত্রাণ সংস্থা হিসাবে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেন। এরপর হতে বাংলাদেশে ক্রমশ বিস্তৃত হতে থাকে রেডক্রিসেন্টের কার্যক্রম। বর্তমানে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির ৬৮টি জেলা ও সিটি ইউনিট দেশব্যাপী সক্রিয়ভাবে মানবতামূলক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। মহামান্য রাষ্ট্রপতি স্বয়ং এই সংস্থার এক্স অফিসিও প্রেসিডেন্ট যিনি প্রতি ৩ বছর মেয়াদে চেয়ারম্যান নিয়োগ দেন।
মনুষ্যত্বের সাথে যুদ্ধ যায় না। তারপরও মানবসমাজের ইতিহাসে বার বার সংঘটিত হয়েছে যুদ্ধ–হানাহানি। এই যুদ্ধ–হানাহানিবিভেদ বৈষম্যের শিকার আর্তমানবতার মুক্তি ও কল্যাণের জন্য অবিস্মরণীয় অবদান রেখে গেছেন কতিপয় মহামানব। মহামতি জীন হেনরী ডুনান্ট তেমনই একজন। শৈশব থেকেই প্রকাশ পেয়েছিল তার মানবসেবার প্রতি টান। মাত্র ৬ বছর বয়সে যখন পিতার সাথে ফ্রান্সের টাওলন কারাগার পরিদর্শন করেন তখনই কারাগারের কয়েদীদের দেখে তার শিশুমনে মানবতাবোধ জেগে উঠে। তিনি এসব কয়েদীদের জন্য কিছু করার প্রতিজ্ঞা করেন। স্কুলজীবন শেষ করে ১৮৪৭ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে তিনি লীগ অফ আলমস নামে একটি সমাজ হিতৈষী সংস্থার সাথে যুক্ত হন। এ সংস্থার কাজ ছিল দরিদ্র ও অসুস্থদের তাত্ত্বিক ও আধ্যাত্মিক সহযোগিতা প্রদান। তবে, যে মর্মস্পর্শী ঘটনা জীন হেনরী ডুনান্টকে রেড ক্রস আন্দোলনের দিকে ধাবিত করেছিল তা হলো ১৮৫৯ সালে ইতালির সলফেরিনোতে সংঘটিত ফ্রান্সঅস্ট্রিয়া যুদ্ধ। ১৮৫৯ সালের ২৪ জুন ইতালির অখ্যাত এক গ্রাম সলফেরিনো ও তার আশপাশে ১৫ ঘণ্টা ধরে চলে এ মর্মস্পর্শী যুদ্ধ। অখ্যাত সলফেরিনো হয়ে ওঠে বিখ্যাত। দুপক্ষের অংশগ্রহণকারী প্রায় ৩ লাখ সৈন্যের মধ্যে ৪০ হাজারের মতো সৈন্য হতাহত হয়। আহত সৈন্যরা কোনো সেবা না পেয়ে সারা রাত ছটফট করে কাটিয়েছে সলফেরিনো গ্রামের পথেপ্রান্তরে। ফলে অনেক আহত সৈন্য যারা একটু পানি ও সেবা শুশ্রূষা পেলে বেঁচে উঠতে পারত তারাও মৃত্যুবরণ করে অবহেলার শিকার হয়ে।
জীন হেনরি ডুনান্ট একটি আবেদন নিয়ে সলফেরিনোতে সম্রাট ৩য় নেপোলিয়নের সাথে দেখা করতে যাওয়ার পথে কাকতালিয়ভাবে এ ঘটনা প্রত্যক্ষ করেন। যুদ্ধের ভয়াবহতা আর আহতদের আর্তনাদ তার মনকে আহত করে। তিনি নিজেকে সামলিয়ে গ্রামবাসীকে অনুপ্রাণিত করে আহতদের প্রথমেই আশপাশের গ্রাম, চার্চ ও বাড়ি ঘরে এনে জড়ো করতে থাকেন। পার্শ্ববর্তী ক্যাসটিপ্যালিয়ন ও দূরে ব্রেসিয়া শহরের হাসপাতালে অনেককে পাঠানো হয়। স্থানীয়দের সহায়তায় প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদান করতে থাকেন। পাশাপাশি ভাবতে থাকেন আহতরা প্রচণ্ডভাবে ক্ষুধার্ত, তাই চিকিৎসার পাশাপাশি তাদের জন্য পানি ও খাদ্যের ব্যবস্থা করা জরুরি। গ্রামের একটি চার্চকে তিনি তার দপ্তর হিসাবে ব্যবহার করতে থাকেন। এখানেও অনেক সৈন্যের শুশ্রূষা করা হয়। এভাবে ২৭ জুন পর্যন্ত বিরামহীন সেবায় ব্যস্ত থাকেন তিনি ও তার অনুসারী এলাকাবাসী এবং তারা প্রায় ১৫ হাজার গুরুতর আহত সৈন্যকে সুস্থ করে তোলেন।
সলফেরিনো (ইতালি) থেকে ফিরে ডুনান্ট নিরন্তর ভাবতে থাকেন সলফেরিনোর স্মৃতি। তিনি ভাবেন এ স্মৃতিকে বিশ্ব বিবেকের কাছে প্রকাশ করতে হবে। ১৮৬২ সালের নভেম্বর তিনি প্রকাশ করলেন সলফেরিনোর স্মৃতিকথা নামের বই। এই বই আর এই আহ্বান এত সাড়া জাগাতে সক্ষম হয় যে, মাত্র এক মাসেই বইটির প্রথম সংস্করণের সব কপিই বিক্রি হয়ে যায়। ফলে ডিসেম্বরে ২য় সংস্করণ প্রকাশ করতে হয়। ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল, ফ্রেন্স ঔপন্যাসিক ভিকটর হুগো, সুয়েজখালের নির্মাতা ফার্ডিনাভ ডি লেসেপস– এমন সব খ্যাতনামা ব্যক্তি ডুনান্টকে ধন্যবাদ জানিয়ে পত্র পাঠান। প্রেসিডেন্ট গুস্তাভ মাইনিউর ১৮৬৩ সালের জানুয়ারিতে ডুনান্টের সঙ্গে দেখা করেন এবং একটি সেবা সংগঠন প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তার সমর্থন ব্যক্ত করেন। এ লক্ষ্যে ১৮৬৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি ভরাব নামে একটি কমিটি গঠন করা হয়। হেনরি ডুনান্টকে করা হলো কমিটির সেক্রেটারি।
আরও পড়ুন হযরত মওলানা শাহসূফী সৈয়দ কমর আলী শাহ (র.)
তিনি এরপর মানবতার সেবায় বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন যার মধ্যে আরো ৪ জন মানবসেবী যুক্ত হয়। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৬৩ সালের ২৬ অক্টোবর আন্তর্জাতিক সম্মেলন আহবান করেন এবং বিস্ময়কর সাড়া পান। এতে ১৬টি দেশ অংশগ্রহণ করে। মুগ্ধ হতে হয় এক যুবকের আহবানে ১৬ দেশের সাড়া প্রদান। এ কেমন প্রাণশক্তিতে ভরা উদ্যোগ! আপনারা আরো অবাক হবেন জেনে এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯১৯ সালের ৫ মে আন্তর্জাতিক রেডক্রস সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হয়ে জেনেভায় সদর দপ্তর স্থাপন করে।
সলফেরিনো যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করে জীন হেনরী ডুনান্টের মহান চিন্তা থেকেই উদ্ভব ঘটে বিশ্ব রেডক্রস ও রেডক্রিসেন্ট আন্দোলনের। আর্তমানবতার সেবামূলক এ আন্দোলন তার নেতৃত্বে এমনই বেগবান হয়, বিশ্বে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারটি ১৯০১ সালে ইতিহাসের সর্বপ্রথম তিনিই ফ্রেদেরিক পাসির সাথে যৌথভাবে অর্জন করেন। তার দেখিয়ে দেয়া পথে সারাবিশ্বে বর্তমানে ১৯২টি দেশে ৮ কোটির অধিক স্বেচ্ছাসেবী আর্তমানবতার সেবায় নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন।
গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করতে হবে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যিনি বলেছিলেন, ‘বিশ্ব দ্থুভাগে বিভক্ত, শোষক আর শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে’। তিনি আরো বলেছিলেন, ‘আমরা চাই, অস্ত্র প্রতিযোগিতায় ব্যয়িত অর্থ দুনিয়ার দুঃখী মানুষের কল্যাণের জন্য নিয়োগ করা হোক।’ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ও ১৯৭০ এর প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের সময় তার মানবিক কার্যক্রম সর্বজনবিদিত। বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় অবদানের জন্য তিনি ১৯৭৩ সালে পেয়েছিলেন জুলিও কুরী শান্তি পুরস্কার। এই বঙ্গবন্ধুর আমলেই তথা ১৯৭৩ সালের ৩১ মার্চ বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির কার্যক্রমের সূচনা হয়ে ২ নভেম্বর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায়। তাছাড়া তিনি ১৯৭৩ সালে ২৬ নং রাষ্টপতির আদেশমূলে একে সহযোগী ত্রাণ সংস্থা হিসেবে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেন। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনাও বর্তমানে বিশ্ব মানবতার দৃষ্টান্ত। যেখানে পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোও সাড়া দেয়নি সেখানে মায়ানমার সরকারের দমনপীড়নের মুখে বাস্তুচ্যুত প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে, খাবারের ব্যবস্থা করে তিনি বিশ্বব্যাপী মাদার অব হিউমিনিটি উপাধি পেয়েছেন। বঙ্গবন্ধু ও তার সুযোগ্য কন্যার সহযোগিতায় মহামান্য রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির ৬৮টি জেলা ও সিটি ইউনিট বর্তমানে দেশে সক্রিয়ভাবে মানবতামূলক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। মহামান্য রাষ্ট্রপতি স্বয়ং এই সংস্থার এক্স অফিসিও প্রেসিডেন্ট যিনি প্রতি ৩ বছর মেয়াদে চেয়ারম্যান নিয়োগ দেন।
মহামতি জীন হেনরী ডুনান্টের গড়ে দেয়া ৭টি মূলনীতি (১) মানবতা (২) নিরপেক্ষতা (৩) পক্ষপাতহীনতা (৪) স্বাধীনতা (৫) স্বেছামূলকসেবা (৬) মানবতা ও (৭) সর্বজনীনতা এই ৭টি মূলনীতি ধারণ করে বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশের প্রতিটি দুর্যোগে এর কার্যক্রম অগ্রগণ্য। বাংলাদেশ যুব রেড ক্রিসেন্ট, চট্টগ্রাম জেলা ও সিটি ইউনিটও এ কৃতিত্বের অংশিদার। চট্টগ্রামে যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও মানবিক সংকটে এই সংস্থা এগিয়ে এসেছে। বিগত কোভিড পরিস্থিতিতে এই সংস্থা ব্যাপকভাবে চিকিৎসা সহায়তা কার্যক্রমে সম্পৃক্ত ছিল। এমনকি কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা প্রদান কার্যক্রমেও এ সংস্থা অবদান রাখছে। সাম্প্রতিক তাপপ্রবাহে জেলার রেড ক্রিসেন্ট স্বেচ্ছাসেবকরা ক্লান্ত পথিক ও যাত্রীদের পানি, খাবার স্যালাইন ও এনার্জী ড্রিংক পান করাচ্ছে এবং সচেতনতামূলক প্রচার চালাচ্ছে।
আপনারা জেনে খুশী হবেন যে, গত বছরের শেষ দিকে তথা ২৮ নভেম্বর চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের দায়িত্বভার গ্রহণের পর পদাধিকার বলে এ বছর জানুয়ারি হতে মূলতঃ চট্টগ্রাম রেডক্রিসেন্টের দায়িত্ব নিয়ে চট্টগ্রামে রেড ক্রিসেন্ট ও এর প্রতিষ্ঠানসমূহের উন্নয়ন ও স্বচ্ছতা–জবাবদিহিতা বৃদ্ধিতে আমি সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। জেমিসন রেডক্রিসেন্ট মাতৃসদন হাসপাতাল এর উন্নয়নে জেলা পরিষদের মাধ্যমে ৪০ লাখ টাকার প্রকল্প গ্রহণ করে হাসপাতালকে আধুনিকায়ন করেছি এবং চিকিৎসা সেবাসহ সার্বিক পরিবেশের ব্যাপক উন্নয়ন করেছি। ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়ম রোধ করে এবং বাৎসরিক আয় ৩০ লাখ টাকা বৃদ্ধি করেছি। যেখানে ১৮ মাসের বিদ্যুৎ বিল এবং ডাক্তারদের ৮ মাসের বেতনসহ অন্যান্য বকেয়া ছিলো তা পরিশোধ করেছি। জনবল নিয়োগ সংক্রান্ত অনেক অনিয়ম দূর করেছি। রেড ক্রিসেন্ট মাঠে একটি ১৬তলা বিশিষ্ট ভবন নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। হোস্টেলের অবকাঠামো উন্নয়নসহ নার্স ও ধাত্রীদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের ব্যাপক মানোন্নয়ন ঘটানো হয়েছে। সার্বিকভাবে বলতে গেলে যেখানে জেমিসন রেডক্রিসেন্ট মাতৃসদন হাসপাতাল যেখানে একটি ডুবন্ত জাহাজ ছিল, এটিকে উদ্ধার করে ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এমনভাবে সক্রিয় করা হয়েছে যে, প্রসূতী মাতা সহ সেবা প্রত্যাশীদের ভীড় এখন দ্বিগুণ হয়েছে। গণমুখী কার্যক্রম গ্রহণের কারণে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, চট্টগ্রাম জেলা ইউনিটের কার্যক্রম বর্তমানে সর্বসাধারণের কাছে সমাদৃত হচ্ছে।
আসুন, জীন হেনরী ডুনান্ট ও বঙ্গবন্ধু এ দুই মহাপুরুষের আদর্শকে মনে ধারণ করে আমরা সবাই মানবসেবায় ব্রতী হই এবং দেশ গঠনে তথা দেশরত্ন শেখ হাসিনা ঘোষিত সুখীসমৃদ্ধ স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ায় সকলে আত্মনিয়োগ করি। জয় বাংলা। জয় বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।
লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি, চট্টগ্রাম জেলা ইউনিট; চেয়ারম্যান, জেলা পরিষদ, চট্টগ্রাম ও সভাপতি, বাংলাদেশ জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এসোসিয়েশন।
Leave a Reply