ডেঙ্গুর প্রকোপে চট্টগ্রামে মৃত্যু বাড়ছে। নভেম্বরের শুরুতেই জেলায় ডেঙ্গুতে ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে, যার মধ্যে পাঁচজনই শিশু। শনিবার (১২ নভেম্বর) ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ফহিমা নামে ২ বছরের এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে চট্টগ্রামে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ২৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সিভিল সার্জন সূত্র অনুসারে, ডেঙ্গু আক্রান্তের হার কমেনি। দৈনিক ৭ থেকে ৮০ জন নতুন করে এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। গতকাল আক্রান্ত হয়েছেন ৯৪ জন। এর আগে গত বুধবার চট্টগ্রামে ডেঙ্গুতে দুইজনের মৃত্যু হয়। তাদের একজনের বয়স ৮৫ বছরের বেশি, অন্যজন ছয় বছরের শিশু। মঙ্গলবার মা ও শিশু হাসপাতালে ৭ বছরের একটি শিশুর মৃত্যু হয়। তার আগে ৬ নভেম্বর দুইজন ডেঙ্গুতে মারা যান। ২ থেকে ৫ নভেম্বর পর্যন্ত তিনদিন জেলায় একজন করে ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু হয়েছে, যাদের দুইজন ছিল শিশু। আগের মাস অক্টোবরে ডেঙ্গুতে ১০ জনের মৃত্যু হয়, শনাক্ত হয় ১ হাজার ৮৬১ জন নতুন রোগী।
ডেঙ্গুতে মত্যু বাড়ছে কেন প্রশ্ন করলে সিভিল সার্জন ইলিয়াছ চৌধুরী সম্ভাব্য তিনটি কারণ দেখিয়ে বলেন, ‘ম্যাল ট্রিটমেন্ট, ওভার ট্রিটমেন্ট এবং লেট ট্রিটমেন্ট— এই তিন কারণে মৃত্যু বাড়ছে।’ জ্বর হলে পরীক্ষার পরামর্শ দিয়ে এই চিকিৎসক বলেন, ‘শুরুতেই টেস্ট করানো উচিত। পরীক্ষা না করে অনেকে ব্যথানাশক ও এন্টিবায়োটিক খাওয়া শুরু করছে। ফলে আক্রান্তরা দেরিতে হাসপাতালে আসছেন। এতে চিকিৎসার সুযোগ সঙ্কুচিত হয়ে যায়।’
তথ্য অনুসারে, চলতি বছর নতুন নতুন জেলায় ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। তবে এ রোগে চিকিৎসকরা এখনও অনভিজ্ঞ। ঢাকার বাইরে যেসব এলাকায় ডেঙ্গুতে মৃত্যু বেশি, মূলত ওইসব এলাকায় রোগটির যথাযথ চিকিৎসা হচ্ছে না। চট্টগ্রাম, বরিশাল, ময়মনসিংহ ও খুলনা অঞ্চলের পাঁচটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং একটি জেলা হাসপাতালের চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ডেঙ্গু রোগী ব্যবস্থাপনা ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে অভিজ্ঞ চিকিৎসকের বেশ সংকট। ফলে রোগীদের বিভাগীয় পর্যায়ের মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতেই চিকিৎসার জন্য আসতে হচ্ছে। কুমিল্লা, ফেনী, নোয়াখালী, বান্দরবান, খাগড়াছড়িসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসার জন্য ভর্তি হচ্ছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। জানতে চাইলে হাসপাতালটির পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসান বলেন, ‘বিভিন্ন জেলা থেকে ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রামে আসছে। এ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সব ধরনের বিশেষায়িত চিকিৎসা পাওয়া যায় বলেই এমনটি হতে পারে। আবার জেলাগুলোর হাসপাতালে জরুরি চিকিৎসা সুবিধারও কিছুটা সংকট রয়েছে। যেসব ডেঙ্গু রোগীর দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক জটিলতা রয়েছে, তারাই মূলত
বিশেষায়িত সেবার জন্য আসছেন।’
সরকারি বিশেষায়িত হাসপাতালের এক চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ‘ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলো থেকে আসা রোগীদের যে স্যালাইন দেয়া হচ্ছে তা পরিমাণে অতিরিক্ত। মাত্রা ও সময়ে ব্যাপ্তির সমন্বয় স্যালাইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে হয়নি। একই সঙ্গে কোনো রোগীর ক্ষেত্রে প্লাটিলেট লাগলে তাকে প্লাটিলেটই দিতে হবে। রক্ত থেকে প্লাটিলেট আলাদা করে দিতে হয়। জেলা পর্যায়ে এসব সুবিধার অভাব রয়েছে। আবার অভিজ্ঞতা না থাকার কারণে চিকিৎসকরা ডেঙ্গু রোগীকে রক্ত দিচ্ছেন। ফলে রোগীর শরীরে আরো জটিলতা দেখা দিয়েছে।’
সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিরায় যে স্যালাইন দেয়া হয় সেটাই হলো আইভি ফ্লুইড। এটি দেয়ার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট পরিমাপ ও বিধি রয়েছে। অতিরিক্ত স্যালাইন দেয়া হলে সেটা হূদযন্ত্র, কিডনি, ফুসফুসসহ দেহের বিভিন্ন অংশে প্রবেশ করতে পারে। এতে রোগীর অবস্থা হয় সংকটাপন্ন। আবার ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে রক্তে প্লাটিলেট কমে যায়। এতে রক্তক্ষরণ হতে পারে। তবে প্লাটিলেট কমে গেলেও তা ৯৯ শতাংশ ক্ষেত্রে আপনাআপনিই ঠিক হয়ে যায়। অথচ উপজেলা ও জেলার চিকিৎসকরা এসব রোগীর দেহে রক্ত পুশ করছেন, যা রোগীর জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. বে—নজির আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, জরুরি বা যেকোনো রোগীকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে জেলা হাসপাতালে পাঠানো হয়। জেলা হাসপাতাল থেকে আবার পাঠানো হয় মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এর মধ্যে উপজেলা হাসপাতালগুলোর বহির্বিভাগের সেবা পরিপূর্ণভাবে চলছে না। একই সঙ্গে জরুরি সেবাও সন্তোষজনক নয়। ভর্তি রোগীদের চিকিৎসার জন্য যে পদক্রমের চিকিৎসক প্রয়োজন সেসবও এখানে নেই। আবাসিক চিকিৎসক, মেডিকেল অফিসার যারাই থাকেন তারা নবীন। ফলে তাদের অভিজ্ঞতাও কম। তিনি বলেন, ডেঙ্গু রোগীর জটিলতাকে গুরুত্ব দিয়ে চিকিৎসা দিতে হয়। প্রয়োজন হয় বিভিন্ন চিকিৎসা সুবিধাও। তবে এসবের ঘাটতির সঙ্গে সঙ্গে অভিজ্ঞতার ঘাটতি চিকিৎসায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। জেলা ও উপজেলা হাসপাতালে দুপুরের পর প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা হয় না। নেই প্যাথলজিস্টও। অনেক ক্ষেত্রে জেলা—উপজেলায় রোগীর রক্তচাপ, নাড়ি পরীক্ষার বাইরে জরুরি চিকিৎসায় যেন আর কিছুই করার থাকে না।
সরকারের পক্ষ থেকে যদিও বলা হচ্ছে, ডেঙ্গু চিকিৎসার জন্য নিয়মিতভাবেই চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে । সারা দেশে উপজেলা ও জেলা হাসপাতালে বাড়ানো হয়েছে চিকিৎসা সুবিধা। একই সঙ্গে ডেঙ্গু চিকিৎসার জন্য ক্লিনিক্যাল গাইডলাইনও প্রকাশ করেছে সরকার। সে অনুযায়ীই চিকিৎসা দিচ্ছে সব পর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান।