চাটগাঁর সংবাদ ডেস্ক
মাস তিনেক আগে শুধু বাংলাদেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্র যে ভিসানীতি ঘোষণা করেছে, তা যে ভারতের পছন্দ নয়, সে কথা দিল্লি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ওয়াশিংটনকে জানিয়ে দিয়েছে। ভারত মনে করছে, এই ধরনের ‘নিষেধাজ্ঞামূলক পদক্ষেপ’ সে দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে সহায়ক তো হবেই না, বরং হিতে বিপরীত হতে পারে, যা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার জন্য কখনোই কাঙ্ক্ষিত নয়।
চলতি বছরের ২৪ মে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ঘোষণা করেছিলেন, বাংলাদেশে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন আয়োজনের প্রক্রিয়াকে যারা বাধা দেবেন, যুক্তরাষ্ট্র তাদের ভিসা প্রত্যাখ্যান করবে। পরে তার মন্ত্রণালয় আরও স্পষ্ট করে জানিয়ে দেয়, এই নীতি বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন বা বিরোধী দলের রাজনীতিবিদদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। এ ঘোষণার পর থেকেই দেশটিতে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক বিতর্ক চরমে উঠেছে।
বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী ভারত তৃতীয় আরেকটি দেশের ভিসানীতি নিয়ে সংগত কারণেই আনুষ্ঠানিকভাবে কোনও মন্তব্য করেনি। ভিসানীতির পক্ষে-বিপক্ষে মুখ না খুললেও দিল্লিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচী একটি কথা বারবার স্পষ্ট করে দিয়েছেন, তারা আশা করবেন বাংলাদেশের সংবিধান ও দেশের মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে মর্যাদা দিয়ে সে দেশে নির্ধারিত সময়ে ও শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
কিন্তু ভারতের এই প্রত্যাশার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি যে মোটেই সংগতিপূর্ণ নয়, দিল্লির সাউথ ব্লকে এই উপলব্ধি ক্রমেই বদ্ধমূল হয়েছে। বাংলা ট্রিবিউন জানতে পেরেছে, গত তিন-চার সপ্তাহের ভেতরে দিল্লির তরফে রীতিমতো যুক্তি দিয়ে মার্কিন প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে এই বার্তাই দেওয়া হয়েছে যে বাংলাদেশের জন্য তাদের ভিসানীতি ‘কাউন্টার প্রোডাক্টিভ’ হবে বলেই ভারতের বিশ্বাস।
মার্কিন সেক্রেটারি অব স্টেট অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনমার্কিন সেক্রেটারি অব স্টেট অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন
আগামী সপ্তাহে দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনের অবকাশে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আলাদা বৈঠকের সম্ভাবনা আছে। আবার তার দিন পনেরোর মধ্যেই দিল্লিতে জি-টোয়েন্টি সামিটে বিশেষ আমন্ত্রিত হিসেবে আসছেন প্রধানমন্ত্রী হাসিনা, যেখানে তিনি প্রেসিডেন্ট বাইডেন ও প্রধানমন্ত্রী মোদিসহ অন্য বিশ্বনেতাদের সঙ্গে একই মঞ্চ শেয়ার করবেন। দিল্লিতেও এ সময় আরও একবার মোদি-হাসিনা একান্ত বৈঠক হবে বলেও কথাবার্তা চলছে।
নরেন্দ্র মোদি সরকার চাইছে, এই গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকগুলোতেই মার্কিন ভিসানীতির ব্যাপারে তাদের অবস্থান বাংলাদেশ সরকারের কাছে স্পষ্ট করে দিতে। বিষয়টি নিয়ে দিল্লি কীভাবে ওয়াশিংটনের সঙ্গে অতি সাবধানে ও কূটনৈতিক পদ্ধতিতে ‘ডিল’ করছে, সে বিষয়েও প্রধানমন্ত্রী হাসিনাকে অবহিত করা হবে বলে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।
তবে এরপরও প্রশ্নটা থাকছেই—যুক্তরাষ্ট্রের এই আলোচিত ভিসানীতির বিরুদ্ধে ভারত ঠিক কী কী যুক্তি দিচ্ছে?
যুক্তরাষ্ট্রের এই ভিসানীতি ঘোষণার দিন কয়েকের মধ্যেই বিষয়টির নানা দিক নিয়ে বিশ্বের দুই প্রান্তে থাকা দুজন বিশেষজ্ঞ দুটি নিবন্ধ লিখেছিলেন। তার একটি ছিল মার্কিন থিংকট্যাংক আটলান্টিক কাউন্সিলে তাদের সাউথ এশিয়া সেন্টারের সিনিয়র ফেলো আলি রিয়াজের, অপরটি টোকিও-ভিত্তিক নিক্কেই এশিয়া পোর্টালে ভারতীয় স্ট্র্যাটেজিক বিশেষজ্ঞ ব্রহ্ম চেলানির।
বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত অ্যাকাডেমিয়ান ড. আলি রিয়াজ তার নিবন্ধের একটি অংশে লিখেছিলেন, অতীতে নাইজেরিয়া, সোমালিয়া, উগান্ডা বা নিকারাগুয়ার মতো বিভিন্ন দেশে যুক্তরাষ্ট্র অনুরূপ পদক্ষেপ নিলেও, তা বিশেষ কাজে আসেনি। তবে সেসব দেশে সেগুলোর সবই নেওয়া হয়েছিল নির্বাচনের পরে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নেওয়া সিদ্ধান্তটি যেহেতু নির্বাচনের অন্তত সাত মাস আগে, তাই সেটিকে একটি ‘ইতিবাচক লক্ষণ’ বলেই বর্ণনা করেছিলেন তিনি। তা ছাড়া এই সিদ্ধান্তে বাংলাদেশের রাজনীতি ও অর্থনীতির ‘এলিট’রা অবধারিতভাবে চাপের মুখে পড়বেন বলেও মন্তব্য করেছিলেন তিনি।
অন্যদিকে ব্রহ্ম চেলানির যুক্তি ছিল, দক্ষিণ এশিয়ারই দুটি দেশ পাকিস্তান ও বাংলাদেশে গণতন্ত্রের হাল নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যে রকম দ্বিমুখী নীতি নিয়ে চলছে, সেটা দ্বিচারিতা ও ভণ্ডামি ছাড়া কিছুই নয়। একদিকে তারা বাংলাদেশে গণতন্ত্রের স্বার্থে আগাম ভিসা প্রত্যাখ্যানের হুঁশিয়ারি দিয়ে রাখছে, আর অন্যদিকে পাকিস্তানে ‘অঘোষিত মার্শাল ল’ চললেও, যুক্তরাষ্ট্র চোখ-কান বন্ধ করে রেখেছে। মিয়ানমার, ইরান, বেলারুশ বা কিউবা—কোনও দেশেই যে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা রাজনৈতিক কোনও পরিবর্তন আনতে ব্যর্থ হয়েছে, সে কথাও চাঁছাছোলা ভাষায় মনে করিয়ে দিয়েছিলেন তিনি।
ওয়াশিংটনকে দিল্লির বার্তা
গত মাসখানেকের ভেতরে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে বাইডেন প্রশাসনকে এ বিষয়ে একাধিক ডিপ্লোম্যাটিক নোট বা কূটনৈতিক বার্তা পাঠানো হয়েছে বলে দিল্লিতে এই প্রতিবেদককে আভাস দেওয়া হয়েছে। তা ছাড়া দুই দেশের শীর্ষ কর্মকর্তাদের মধ্যে আলোচনাতেও প্রসঙ্গটি ভারতের দিক থেকে বারবার উত্থাপন করা হয়েছে। আর এর সবগুলোই হয়েছে জুনের তৃতীয় সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী মোদির বহুল আলোচিত যুক্তরাষ্ট্র সফরের পর, কারণ দিল্লি চায়নি তার আগে বাংলাদেশের প্রসঙ্গটি ওই সফরে ছায়া ফেলুক।
ওই সব নোটে ও আলোচনায় ভারতের পক্ষ থেকে যা বলা হয়েছে, তার মোদ্দাকথা হলো—
ক. যুক্তরাষ্ট্রের মতো ভারতও চায় বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণভাবে একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন হোক। কিন্তু আগাম ভিসা খারিজের হুঁশিয়ারি সেই লক্ষ্য অর্জনে কিছুতেই সহায়ক হতে পারে না। বরং এই সিদ্ধান্ত ঘোষণা ও তার টাইমিং থেকে এটাই মনে হচ্ছে যে এই পদক্ষেপ বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে—যিনি ১৫ বছর ধরে সে দেশে একটি ধর্মনিরপেক্ষ ও স্থিতিশীল সরকারের নেতৃত্ব দিচ্ছেন এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে দেশকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন—সুস্থিতিকে অযথা বিচলিত করতে পারে।
খ. হাতের কাছেই রয়েছে মিয়ানমারের উদাহরণ, যেখানে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা কোনও কাজে তো আসেইনি, বরং সে দেশে গণতন্ত্রকে আরও বিপন্ন করে তুলেছে। এমন একটা ধারণাও আছে যে মিয়ানমারের সেনাপ্রধান মিন অং হ্লেইং ও আরও তিন সিনিয়র সেনা কমান্ডারের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের স্যাংশনই সে দেশে সামরিক অভ্যুত্থানকে ট্রিগার করেছিল। কারণ তারা ধরেই নিয়েছিল তাদের নতুন করে হারানোর কিছু নেই। শুধু তা-ই নয়, ওই নিষেধাজ্ঞা মিয়ানমারকে আরও বেশি করে ঠেলে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বৈরী দেশ চীনের দিকে। মিয়ানমারে এই বিরূপ অভিজ্ঞতার পরও যুক্তরাষ্ট্র কেন বাংলাদেশেও একই ধরনের এক্সপেরিমেন্টের পথে হাঁটছে, ভারতের পক্ষ থেকে সে প্রশ্নও তোলা হয়েছে।
গ. এমনকি পাকিস্তানের সঙ্গে তুলনা টেনেও বলা হয়েছে, ভারতের পূর্ব ও পশ্চিমের দুই প্রতিবেশীর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্রের দুই রকম মাপকাঠি প্রয়োগ করছে বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে। পাকিস্তানে যেখানে গুম, নির্যাতন বা গণগ্রেফতারি যথেচ্ছভাবে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, সেখানে যুক্তরাষ্ট্র একটি শব্দও খরচ করছে না। অথচ বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তারা অতি-সক্রিয়তা দেখাচ্ছে। এই দ্বিচারিতা বাংলাদেশের ভেতরেও যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে কোনও ভালো ছবি তুলে ধরবে না বলেই ভারত মনে করছে।
ঘ. ভয় দেখিয়ে বা জোর করে কোনও দেশে গণতন্ত্রের প্রসার সম্ভব নয়, বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র হিসেবে ভারতের এই বিশ্বাসের কথাও যুক্তরাষ্ট্রকে মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশেও ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে গেলে তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে এবং তাতে সে দেশে মার্কিন স্বার্থের ক্ষতি ছাড়া কোনও লাভ হবে না। বরং যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ার অন টেররে (সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ) এবং এশিয়া-প্যাসিফিকের শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ যে কত গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী হয়ে উঠতে পারে, সেদিকে দৃষ্টি দেওয়াই ভারত বেশি সমীচীন মনে করছে।
তবে একবার মার্কিন ভিসানীতি ঘোষণা হয়ে যাওয়ার পর তা নির্বাচনের আগে তুলে নেওয়া হবে, সেটা যে সম্ভব নয়, ভারতও তা জানে। কিন্তু ঘনিষ্ঠ বন্ধুদেশ নিয়ে ভারতের মনোভাব জানার পর ওয়াশিংটন সেই নীতি প্রয়োগের ক্ষেত্রে শিথিল ও সংযত হবে, এটাই আপাতত দিল্লির প্রত্যাশা।