মহান আল্লাহতায়ালা দীন ইসলামকে হেফাজতের জন্য যুগে যুগে সংস্কারক প্রেরণ করেন যিনি দীন ইসলামকে যাবতীয় কুসংস্কার থেকে মুক্ত করে প্রকৃত আদর্শের উপর পূনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক হাদীসে এ বার্তা দিয়েছেন বলেন আল্লাহতায়ালা এ উম্মতের (কল্যাণে) প্রত্যেক শতাব্দীতে এমন এক ব্যক্তিকে পাঠাবেন যিনি তাদের দীনকে সংস্কার করবেন। তারই ধারাবাহিকতায় আগমন ঘটে তরিকার বাদশাহ হযরত শায়খ আহমদ ফারুকী সিরহিন্দি (রহ.)। তিনি ছিলেন ইমামে রাব্বানী মুজাদ্দিদে আলফেসানী।
মুজাদ্দিদে আলফেসানী রাহমাতুল্লাহ আলাইহি এর নাম আবুল বারাকাত বদরুদ্দীন,আহমদ সিরহিন্দি। তিনি ৯৭১ হিজরি মোতাবেক ১৫৬১ খৃস্টাব্দে ভারতের পাঞ্জাব শহরের সিরহিন্দে জন্মগ্রহন করেন। পিতার নাম আব্দুল আহাদ। তার বংশানুক্রম হজরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছে। মুজাদ্দিদে আলফেসানী (রহ.)-ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের একজন ইসলামি পন্ডিত। তিনি ফিকহের হানাফি ধারা ও নকশবন্দি সুফি তরিকার অনুসারী ছিলেন। তাকে মুজাদ্দিদে আলফেসানি বলা হয় যার অর্থ “দ্বিতীয় সহস্রাব্দের সংস্কারক”। মুঘল সম্রাট আকবরের সময় ইসলাম বিরোধী কাজের বিরোধীতার জন্য তিনি অধিক পরিচিত। মুজাদ্দিদ অর্থ হচ্ছে সংস্কারক। আলফ মানে হাজার আর সানী অর্থ হচ্ছে দ্বিতীয়। অতএব মুজাদ্দিদে আলফেসানি অর্থ হচ্ছে দ্বিতীয় সহস্রাব্দের মুজাদ্দিদ বা সংস্কারক। শাইখ আহমদ ফারুকী সিরহিন্দি (রহ.)-ছিলেন দ্বিতীয় হাজার বছরের মুজাদ্দিদ।
মুজাদ্দিদে আলফেসানী (রহ.)-এর মিশন ছিলো সম্রাট আকবরের দীনে ইলাহীকে প্রতিহত করে তদ্বস্থলে ইসলামী আদর্শের পূনঃপ্রতিষ্ঠা করা। তার প্রচেষ্ঠার ফলে আকবরের পরবর্তী সম্রাটগণ ইসলামের দিকে ধাবিত হতে থাকে। বাদশাহ আওরঙ্গজেব আলমগীর হচ্ছেন যার উজ্জ্বল নমুনা। বাদশা আওরঙ্গজেব আলমগীর শুধু একজন সম্রাট বা বাদশাই ছিলেন না বরং একজন বিজ্ঞ আলেমও ছিলেন। মুজাদ্দিদে আলফেসানী (রহ.)-জন্মের সময় জালালুদ্দীন আকবর ছিলো ভারতবর্ষের শাসক। আকবরের পিতা হুমায়ূন,আকবরের জন্মের পর থেকে প্রতিপক্ষের আক্রমনে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পালিয়ে বেড়িয়েছিলো। তাই ভারতবর্ষের এই ভাবী সম্রাটের লেখা-পড়ার সুযোগ হয়নি। অশিক্ষিত এই ব্যক্তি অতিঅল্প বয়সেই পিতার সিংহাসনে বসে। সম্রাট নিজে অশিক্ষিত থাকলেও জ্ঞানের প্রতি তার বিশেষ আকর্ষণ ছিলো। তাই সে তার দরবারে জ্ঞানী-গুণীদের সমাবেশ ঘটালো। ওই সময় জ্ঞানী বলতে ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তিরাই ছিলো ; যাদেরকে সমাজ আলেম হিসেবে জানত। সাধারণত রাজা-বাদশাদের পাশে দুনিয়াদার আলেমরাই জমা হয়। সম্রাট আকবরের কাছে বিতর্ক ছিলো একটি প্রিয় বিষয়। তাই সম্রাট দরবারী আলেমদের দিয়ে বিতর্ক অনুষ্ঠান করতো। অপরিণামদর্শী দুনিয়াদার ওই আলেমরা শরয়ীর বিভিন্ন বিষয়ে বিতর্ক করতো। একজন একটি বিষয় প্রমাণ করেছে তো আরেকজন ওই বিষয়টিকে প্রতিহত করেছে। এর দ্বারা ধীরে ধীরে আকবরের মনে ইসলাম সম্পর্কে সন্দেহ সংশয় বাসা বাঁধতে থাকে। আলেমদের মধ্য থেকে একশ্রেণীর প্ররোচনায় প্রথমে সে নিজেকে মুজতাহিদ দাবী করে এবং বলে নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নবুওয়াতের সীমা ছিলো একহাজার বছর পর্যন্ত। এখন নতুন যুগের সূচনা হয়েছে। এখন থেকে চলবে সম্রাটে আকবরের দীনে ইলাহী। এভাবে সে দীন ইসলামকে রহিত করে দীনে ইলাহী নামে নতুন ধর্মের প্রবর্তন করে।
সম্রাট আকবরের দীনে ইলাহী প্রবর্তন নিছক একজন ব্যক্তির ব্যক্তিগত অবস্থান,পরিবর্তন ছিলো না। বরং তা ছিলো ইসলামী বিশ্বের বড় এক অংশের পরিবর্তন। যার শাসক ছিলো সমকালীন প্রতাপশালী একজন ব্যক্তি। যে শাসকের দরবারে ছিলো যুগের সূর্যসন্তানেরা। দীন ইসলামের এই সংকটময় মুহূর্তে প্রয়োজন ছিলো মুজাদ্দিদেও ; যিনি আকবরের এই ফেতনার মোকাবেলায় দীন ইসলামের প্রকৃত শিক্ষাকে আঁকড়ে ধরে হকের মশাল জ্বালাবেন। তাই আল্লাহতায়ালা প্রেরণ করলেন শাইখ আহমদ ফারুকী সিরহিন্দি (রহ.) কে। তিনি স্বীয় পিতার কাছ থেকে চিশতিয়া তরীকায় দীক্ষা গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন রাসুলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পূর্ণ অনুসারী। মানুষে মানুষে তিনি কোনো পার্থক্য করতেন না।
দীনে ইলাহির বিরুদ্ধে সংগ্রাম : ইতিপূর্বে আলোচনা হয়েছে মুজাদ্দিদ আলফেসানী (রহ.)-এর জন্মের সময় বাদশা আকবর দীনে ইলাহী নামে এক নতুন মনগড়া ধর্ম প্রবর্তনের চেষ্টা করছিলো। দাওয়াত ও ইসলামের ময়দানে মুজাদ্দিদে আলফেসানী (রহ.)-কঠোর কোনো কর্মসূচি দেননি। প্রথমে তিনি নিজের ভেতর থেকে সম¯ত রকমের জাগতিক স্বার্থকে বের করলেন। একমাত্র সংশোধন ও ইসলামের নিয়তে রাজ্যের কর্মকর্তাদের কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। তারপর তিনি রাজ্যের সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের কাছে যাতায়াত শুরু করলেন। শুরুতে তাকে অন্যদের মতোই ধান্দাবাজ মনে করলেও খুব দ্রুতই তার ব্যাপারে তাদের ধারণা পাল্টে যেতে থাকে। তারা দেখতে পেলো তিনি শুধু রক্তে মাংসে গড়া একজন মানুষ ; বরং তার ভেতর রয়েছে মনুষ্যত্বের যাবতীয় গুণাবলী। তার উপর ব¯তুর কোনো কর্তৃত্ব চলে না ; তিনিই ব¯তুর উপর কর্তৃত্ব করেন। তখন তারা শাইখের সামনে নিজেদেরকে সোপর্দ করে দিলো। তার এই তৎপরতার সময় সম্রাট আকবর জীবিত ছিলেন। এর কিছু দিন পরেই আকবর মারা যায় আর ক্ষমতায় বসে সম্রাট জাহাঙ্গীর। সম্রাট জাহাঙ্গীর মুজাদ্দিদে আলফেসানী (রহ.)-কে আকবরের তুলনায় বেশি সম্মান করতো। কিন্তু তার পাশের লোকেরা মুজাদ্দিদ আলফেসানী (রহ.)-কে ভালো চোখে দেখতো না। তাই ওরা সম্রাটকে কানপড়া দিতে শুরু করলো। পরামর্শ দিলো তাকে পরীক্ষা করে দেখা দরকার। এ জন্য সম্রাট একবার তাকে দরবারে ডেকে পাঠালো। ওই সময় নিয়ম ছিলো যারা রাজ দরবারে আসবে সম্রাটকে সম্মানের সেজদা করবে। এ ব্যাপারে ইসলামের রীতি হচ্ছে আগন্তুক সালাম দিবে সেজদা নয়। তাই মুজাদ্দিদে আলফেসানী (রহ.)-দরবারে প্রবেশের পর সেজদা না করে সালাম দিলেন। এতে সম্রাট ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে জেলে বন্দি করে। জেলে আটক করা মুজাদ্দিদ আলফেসানী (রহ.)-এর জন্য শাপেবর হলো। তিনি সুযোগকে কাজে লাগালেন। জেলখানায় তিনি দাওয়াতি কাজ শুরু করে দিলেন। এতে কয়েকজন অমুসলিম তার হাতে মুসলমান হয়। অসংখ্য অপরাধী তওবা করে গোনাহ থেকে ফিরে আসে। ইতোমধ্যে শাইখ (রহ.)-এর মুরিদরা মুক্তির জন্য বিভিন্ন আন্দোলন শুরু করেন এবং সম্রাট নিজেও স্বীয় কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়ে মুজাদ্দিদ আলফেসানী (রহ.)-কে জেল থেকে মুক্তি দেয়। মুক্তির পর রমজান মাসে তিনি সম্রাটের নিকট কাটান। সম্রাট শাইখের পেছনে তারাবির নামাজ আদায় করেন। ওই সময় তিনি সম্রাটকে বিভিন্ন বিষয়ে উপদেশ দেন। মৃত্যুকালে তাঁর কণ্ঠে অনুরণিত হচ্ছিল একটি ফার্সি কবিতার ¯তবক, যার ভাবার্থ হলো,আজ ওই প্রিয়তমের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হবে-যাঁর জন্য আমি পুরো দুনিয়াকে উৎসর্গ করে দিতে প্রস্তুত।
গারাংগিয়ার মহান দুই পীরে কামেল হযরতে বড় হুজুর ও হযরতে ছোট হুজুর কেবলা (রহ.), মুজাদ্দেদিয়া তরিকার এই ধারাবাহিকতায় চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার শাকপুরায় শাহ মাওলানা মীর রশিদ আহমদ (রহ.)-ছিলেন মুজাদ্দেদিয়া তরিকার খেলাফতপ্রাপ্ত এবং হযরত আব্দুস সালাম আরকানী (রহ.) ঁর সরাসরি খলিফা! তারই ধারাবাহিকতায় প্রতিবছর শাকপুরা দারুসুন্নত কামিল মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে খতমে কোরান, মিলাদ মাহফিল এবং বিশেষ মুনাজাত এর আয়োজনে পীরে কামেল শাহ মাওলানা নূর মোহাম্মদ মোজাদ্দেদীর সরাসরি তদারকিতে অনুষ্ঠিত হয় মুজাদ্দেদিয়া তরিকার এই বিশাল মহাসম্মেলন!
পরিশেষে : হযরত আজ আমাদের মধ্যে নেই,কিন্তু তার দেয়া কুরআন সুন্নাহর জীবন নির্দেশকা রয়ে গেছে। আল্লাহতায়ালা আমাদেরকে হযরতের দেখানো পথ অনুসরণ করে দুনিয়া ও আখিরাতের মুক্তি অর্জন করার তৌফিক দান করুক। মুজাদ্দিদে আলফেসানী (রহ.) ঁর ইসলামের অসামান্য খেদমতকে কবুল করুন। মুসলিম উম্মাহকে তাঁর রূহানি ফায়েজ এবং বরকত দান করুন। আল্লাহতায়ালা তাকে জান্নাতে উচুঁ মাকাম দান করুন। আমীন।
লেখক : ফখরুল ইসলাম নোমানী, ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট