পারিবারিক পরিচিতি:
পটিয়া উপজেলা ধলঘাট ইউনিয়নের তেকোটা গ্রামে এক মুসলিম সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ৫ ভাই ৪ বোনের মধ্যে তৃতীয় তাহার পিতার নাম মনোহর আলী, মাতার নাম ছবুরা খাতুন। তাঁহার মাতা ছিলেন একজন গৃহিনী। ১৯৬৮ সালে ১লা আশ্বিন তাঁহার পিতা মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৮৫ সালের ১৭ জানুয়ারী, ২০ মাঘ তাঁহার মাতা মৃত্যুবরণ করেন।
জন্মগ্রহণ:
বীর গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা ফজল আহমদ ১৯৫৫ সালের ১৯ মে সোমবার ভোর ৫টায় জন্মগ্রহণ করেন।
শিক্ষাজীবন :
বীর গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা ফজল আহমদ স্থানীয় গৈড়লা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং গৈড়লা কে.পি. উচ্চ বিদ্যালয় হতে মেট্রিক পাশ করেন। ১৯৭২ সালে পটিয়া কলেজ উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হন ’৭৪ সালে এইচ.এস.সি. পাশ করেন। এইচ.এস.সি. পাশের পর পটিয়া কলেজেই ডিগ্রীতে ভর্তি হন। ১৯৭৭ সালে ডিগ্রী পাশ করেন। ১৯৭৮ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এম.এ (রাষ্ট্র বিজ্ঞানে) ভর্তি হন ১৯৮০ সালে এম.এ পাশ করেন। এম.এ পাশ করেই তিনি চট্টগ্রাম আইন কলেজে ভর্তি হন এবং আইন বিষয়ে পড়াশোনা করেন। আইন কলেজে পড়াশোনা শেষ করেই অন্য কোন পেশায় না গিয়ে তিনি চাকুরী করার সিদ্ধান্ত নেন।
পেশাগত জীবন :
পড়াশোনা শেষ করে তিনি প্রথমে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষে চাকুরী গ্রহণ করেন সেখানে দুই বছর চাকুরী করার পর চাকুরী ছেড়ে দিয়ে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে চাকুরী গ্রহণ করেন সেখানে ১৯৮৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চাকুরী করার পর কাস্টমসের চাকুরী ছেড়ে দিয়ে ১৯৮৩ সালেই বাংলাদেশ ব্যাংকে যোগদান করেন। ২০১৪ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক হতে যুগ্ম-পরিচালক পদ হতে অবসর গ্রহণ করেন।
বিবাহিত জীবন :
১৯৮৭ সালে ৬ মার্চ শুক্রবার। বোয়ালখালী ঘোষখীল গ্রামের সম্ভ্রান্ত পরিবার বাংলাদেশ ডাক বিভাগের কর্মকর্তা আবদুল লতিফ মহোদয়ের ১ম কন্যা জেসমিন আরা বেগমকে বিবাহ করেন। জেসমিন আরা বেগম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হতে ইসলামের ইতিহাস বিভাগে এম.এস পাশ করেন এবং বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকে সহকারী জেনারেল ম্যানেজার।
পরিবারের সন্তানগণ :
বীর গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা ফজল আহমদ ৪ (চার) কন্যা সন্তানের জনক।
১ম সন্তান : প্রকৌশলী সাবরিনা বিনতে আহমদ সাকী একজন আই.টি বিশেষজ্ঞ। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সরকারি প্রতিষ্ঠানে আইটি বিশেষজ্ঞ হিসেবে চাকুরীতে আছে। তিনি ঢাকা বিশ্ব বিশ্ববিদ্যালয় ও ভার্জিনিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ইঞ্জিনিয়ারিং এ পড়াশোনা করেন।
২য় সন্তান : ডাক্তার সায়মুনা জেসমিন পিংকি, এম.বিবিএস, বিসিএস (স্বাস্থ্য), চট্টগ্রাম পটিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এ কর্মরত আছেন।
৩য় সন্তান : প্রকৌশলী ইফফাত বিনতে ফজল (ইমু) আমেরিকান মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটি হতে কম্পিউটার সাইন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ার এম.এস করে ১ম শ্রেণিতে ১ম হয়েছে এবং বর্তমানে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক হিসাবে কর্মরত আছেন।
৪র্থ সন্তান : ফারিয়া জেসমিন প্রিমা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজম্যান্টে অনার্স করছেন।
রাজনৈতিক জীবন :
বীর গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা ফজল আহমদ স্কুল জীবন থেকেই ছাত্র রাজনীতিতে যুক্ত হন। তিনি ১৯৬৭ সাল হতে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নেরকর্মী ছিলেন। ১৯৭০ সালে গোপন কমিউনিস্ট পার্টি সাথে যুক্ত হন মেম্বারশীপ পান এবং সমাজতন্ত্রের মূল মন্ত্রে উদ্বোদ্ধ হয়ে সক্রিয়ভাবে পার্টি কাজে অংশগ্রহণ করেন। তিনি পটিয়া থানা ছাত্র ইউনিয়নের নেতা ছিলেন। ’৭৫ পরবর্তী সময়ে ছাত্র ইউনিয়ন চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা সংসদের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। বর্তমানে চাকুরী জীবন শেষে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন এবং মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, প্রাতিষ্ঠানিক কমান্ড চট্টগ্রামের কমান্ডার হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। একই সাথে তিনি ‘মুক্তিযুদ্ধকালিন ন্যাপ- কমিউনিস্ট পার্টি ছাত্র ইউনিয়ন’ বিশেষ গেরিলা বাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধা সমন্বয় পরিষদ চট্টগ্রামের সদস্য সচিব এবং বঙ্গবন্ধু সমাজ কল্যান পরিষদ চট্টগ্রাম মহানগরে সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি চট্টগ্রাম প্রাতিষ্ঠানিক বীর মুক্তিযোদ্ধা সমবায় সমিতি লি: চট্টগ্রামের সভাপতি। তিনি আরো অনেক সংগঠনের নেতৃত্বে আছেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধে রণাঙ্গনের স্মৃতিকথা :
বীর গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা ফজল আহমদ ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে অসহযোগ আন্দোলনের সময় প্রতিদিন এলাকায় সভা-সমাবেশ-মিছিল সংগঠিত করেছে। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষনার পর গৈড়লা কে.পি. উচ্চ বিদ্যালয়ে স্থানীয় যুবকদের নিয়ে নিয়মিত ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করেন। ইহাতে তেকোটো, গৈড়লা, করনখাইন, মুকুটনাইট, নাইখাইন, উইনাইনপুরা, লড়িহরা, পাইরোল গ্রামের শতশত যুবক অংশ গ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালে ১৬ এপ্রিল, শুক্রবার সকাল ১১টায় পটিয়া থানা এলাকায় পাক বাহিনী ব্যাপক বিমান হামলা করলে ঐ দিন থেকে স্থানীয় প্রশিক্ষণ বন্ধ করে দেন এবং নেতৃবৃন্দের পরবর্তী আদেশের জন্য অপেক্ষা করছিলেন, ইহার দুই একদিন পর কমরেড পূর্নেন্দু কানুনগোয় তেকোটা বৌদ্ধ মন্দিরে বৈঠক করে জানালেন যে, পার্টির কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ ইতি মধ্যে ভারত চলে গেছেন। তাদের সিদ্ধান্ত মোতাবেক মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য কর্মীদের ভারতে প্রেরণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। কাজেই ফজল আহমদ ও সুজিত বড়ুয়াকে ভারতে প্রেরণের কথা জানান। তাহার পরামর্শ মোতাবেক আমি ১ মে ১৯৭১ ভারতের উদ্দেশ্যে এলাকা ত্যাগ করি। নেতার নির্দ্দেশ মোতাবেক মিরেশ্বরাই আবুর হাট হয়ে চৌদ্দ গ্রাম হয়ে আমরা ১০/১২ জন বেলোনিয়া (ত্রিপুরা)’য় প্রবেশ করি। সেখানে থেকে আগরতলা, ক্রেপ্ট হোস্টেলে যায়, সেখানে আমাদের নেতৃবৃন্দ ছিলেন। সেখান থেকে বরদোয়ালী স্কুলে ১০/১২ দিন অপেক্ষার পর দেশ থেকে আসা স্কুল নেতা-কর্মীর ইন্টারভিউ হয়। ইন্টারভিউ শেষে বি.এম হোস্টেলে প্রেরণ করেন। সেখানে দুই দিন অপেক্ষার পর আমাদের হোস্টেলের নিচে নামানো হয়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন শ্রমিক নেতা চৌধুরী হারুণ রশিদ, তিনি আমাদের জাতীয় পতাকা হাতে শপথ বাক্য পাঠ করালেন। ইহার পর ভারতীয় সেনাবাহিনীর ট্রাকে তুলে আগরতলা বিমান বন্দরে নিয়ে আসা হয়। সেখানে আগে থেকে অপেক্ষমান ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের কার্গো বিমান। উক্ত বিমানে করে আমাদের আসাম তেঁজপুর সেনা বিমান ঘাটিতে নিয়ে আসা হয়। সেখান থেকে ভারতীয় বাহিনীর ট্রাকে করে সেনানিবাসে এলাকায় নিয়ে আসা হয়। সেখানেই আমাদের বিশেষ গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ হয়। আমাদের চট্টগ্রাম দক্ষিণাঞ্চলীয় গেরিলা বাহিনীর লিডার ছিলেন কমরেড মোহাম্মদ শাহ আলম। আমরা ভারত থেকে প্রশিক্ষণ দেশে প্রবেশ করি ১৯ জন। পরে আরো যুক্ত হন ৩ জন। আমরা ভারতে যুবকদের প্রেরণ না করে স্থানীয় ভাবে ট্রেনিং সিদ্ধান্ত নিই। সেই সিদ্ধান্ত মোতাবেক বোয়ালখালী করলডেঙ্গা পাহাড়ে চালতাছড়িতে প্রশিক্ষণ শিবির স্থাপন করি। সেখানে শতশত যুবককে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।
সেখানে ২ মাস ১০ দিন বিশেষ গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ শেষে বাংলাদেশে প্রবেশ করি। আমার গেরিলা দলের লিডার ছিলেন কমরেড মোহাম্মদ শাহ আলম ডেপুটি লিডার উদয়ন নাগ। আমাদের দল ছিল ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের বিশেষ গেরিলা বাহিনী।
প্রশিক্ষণ শেষে মাতৃভূমিতে ফিরে আসা : আমরা বাংলাদেশে সাবরুম রামগড় হয়ে ফটিকছড়ি হয়ে বোয়ালখালী প্রবেশ করি।
১ম যুদ্ধ : সরাসরি যুদ্ধ হয় কেলিশহর গোপাপাড়া, ২য় যুদ্ধ ধলঘাট রেল স্টেশন দখলের যুদ্ধ, বোয়ালখালী কালাইয়ার হাট রাজাকার ক্যাম্প দখলের যুদ্ধ ৩য় যুদ্ধ : চট্টগ্রাম কক্সবাজার মহাসড়কে ১৮ নভেম্বর ইন্দ্রপোল দখল ও সেতু ধ্বংস করে দেয়া ৪র্থ সম্মুখ যুদ্ধ : ৯ ডিসেম্বর গৈড়লার টেকে ঐতিহাসিক সম্মুখ যুদ্ধ সেই যুদ্ধে পাক বাহিনীর ১৪ জন নিহত হয় এবং শতাধিক আত্মসমার্পন করেন বিপুল পরিমাণ অস্ত্রসস্ত্র দখলে আসে। ১৩ ডিসেম্বর পটিয়া থানায় বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন। মূলত : ৯ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা হানাদার মুক্ত হয়।
উল্লেখ্য যে, গেরিলা বাহিনীর উদ্যোগে কড়লডেঙ্গা পাহাড়ে চালতাছড়ি নামক স্থানে প্রশিক্ষণ শিবির স্থাপন করা হয়, সেখানে শতশত যুবককে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। আমাদের গেরিলা বাহিনী ছিল ‘‘মুক্তিযুদ্ধকালীন-ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়ন’’ বিশেষ গেরিলা বাহিনী।
Leave a Reply