নুরুল আবছার চৌধুরীঃ ১১টি বছর কেটে গেলেও প্রিয় নেতা শ্রদ্ধেয় বাবু ভাইকে ভুলার মতো নয়। আপনি মরেও অমর। স্মৃতির অতল গহ্বরে অনেক স্মৃতি হারিয়ে যায়। কিন্তু পরম শ্রদ্ধেয় নেতা বাবু ভাই আপনার স্মৃতি আমার ভেতর থেকে কোনো দিনও মুছে যাওয়ার মতো নয়। রক্তের উত্তরাধিকার না হলেও আদর্শের উত্তরাধিকার হিসেবে আপনার কর্ম-আদর্শ যুগ যুগ ধরে আমিসহ অগণিত নব প্রজন্মের প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।
তখন ২০১২ সাল। সাতকানিয়ার আমিলাইশ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সম্মেলনের আগে বাবু ভাই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। বিশৃংখলার আশংকা করছিলেন তাই আমাকে ও চন্দনাইশ -সাতকানিয়া (চট্টগ্রাম-১৪) আসনের সাংসদ বীর মুক্তিযোদ্ধা নজরুল ইসলাম চৌধুরীকে সেই সম্মেলন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে যাওয়ার জন্য নির্দেশ প্রদান করেছিলেন। সম্মেলন শেষে দুজনেই বাবু ভাইকে সার্বিক পরিস্থিতি অবহিত করতে তাঁর সার্সন রোডের বাসভবনে উপস্থিত হই। সেটাই ছিলো বাবু ভাই জীবিত থাকাকালীন উনার সাথে শেষ দেখা। এরপর চিকিৎসার জন্য তাঁকে সিঙ্গাপুরে নিয়ে যাওয়া হয়। মনে পড়ছে আজ, আমার সম্পাদিত ‘চাটগাঁর সংবাদ’ পত্রিকার মোড়ক উম্মোচন করতে চেয়েছিলাম বাবু ভাইকে দিয়ে। যেদিন তিনি পরলোক গমন করলেন সেদিনই চাটগাঁর সংবাদ পত্রিকার প্রথম মুদ্রণ ভার্সন প্রকাশিত হয়। বাবু ভাইয়ের পরিবর্তে শেষ পর্যন্ত ৫ নভেম্বর তৎকালীন সড়ক ও সেতুমন্ত্রী জননেতা ওবায়দুল কাদেরকে দিয়ে পত্রিকাটির মোড়ক উম্মোচন করা হয়। ৪ নভেম্বর বাবু ভাইয়ের মৃত্যুবার্ষিকীর দিন আমার জন্য শোক দিবস বিধায় আজ পর্যন্ত বর্ষপূর্তিকে কেন্দ্র করে কোনো আনন্দ উৎসব চাটগাঁর সংবাদ করে না। পরবর্তীতে নভেম্বরের শেষার্ধে বর্ষপূর্তি পালন করা হয়।
এভাবেই আমার স্মৃতিতে স্মরণীয়-বরণীয় ব্যক্তিত্ব হয়ে আছেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম জননেতা আলহাজ্ব আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু এম.পি।
তিনি একজন দেশ বরেণ্য শিল্পপতি, দেশের ব্যবসায়ী সংগঠনের সর্বোচ্চ শিখরে আরোহন করার পরও নিজেকে একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী শিল্পপতি হিসেবে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন না। দেশ ও মানুষকে ভালবাসতেন বিধায় কেউ তাঁকে কথায় বা সভা-সমাবেশে একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে আখ্যায়িত করলে নিজেকে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন।
তাঁর জন্য যে কোনো সংগ্রামে জড়িয়ে পড়তে পিছ পা হতাম না আমি। তৎকালে আমি চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি হওয়ার সুবাদে তার স্নেহাশীষ ও সান্নিধ্য পেয়ে তার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলাম। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করার পর তাঁর আদর্শের সৈনিকদের চিরতরে বিলীন করে দিতে চেয়েছিলো এ দেশের স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি। শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পরও বাবু ভাইকে নিয়ে কম ষড়যন্ত্র করা হয়নি। স্বৈরাচার আমলে পরিকল্পিতভাবে তাঁকে হুমায়ুন জহির হত্যা মামলার সাথে জড়ানো হয়েছিলো। আমরা তখন মাননীয় নেত্রী শেখ হাসিনার সাথে ঢাকায় মিন্টু রোডে দেখা করলে নেত্রী আমাদেরকে মিন্টু রোড থেকে তাঁর গাড়ীর পিছনে করে সংসদ ভবনে নিয়ে গিয়ে বৃটিশ হাই-কমিশনারের সাথে সাক্ষাতের পূর্বক্ষণে নির্দেশ দেন তোমরা বাবু সাহেবের মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে আন্দোলন সংগ্রাম গড়ে তোলো। তখন মুসলিম ভাইয়ের নির্দেশে দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের উদ্যোগে বোয়ালখালীর শাকপুরায় রোড ব্যারিকেড গড়ে তুলি, অবস্থান ধর্মঘট চলাকালে জামিনের খবর পাওয়ার পর জানতে পারি বোয়ালখালী থানার তৎকালীন ওসি সিরাজুল ইসলাম বাদি হয়ে আমাকে ১নং আসামী করে বোয়ালখালীর ৯ জনসহ ১০জনের বিরুদ্ধে থানায় সন্ত্রাস দমন মামলা (নন-বেইলেবল) দায়ের করলে হাজত কাটতে হয়। আইন পরীক্ষার প্রবেশপত্র ও চিটাগাং চেম্বারের চাকুরির নিয়োগপত্র আদালতে দাখিল করে জামিন লাভে সক্ষম হই। প্রতি সপ্তাহে আদালতে হাজিরা দিতে হতো। মামলার কথা পত্র-পত্রিকায় চলে আসায় আমেরিকান এক্সপ্রেস ব্যাংকে মার্কেটিং অফিসার হিসেবে হওয়া চাকরিতে যোগদান দুরূহ হয়ে পড়লে চাকুরী নিয়ে বিদেশে চলে যাই। এবং সেই সময় বিসিএস পরীক্ষায়ও অংশগ্রহণ করতে পারিনি। পরবর্তীতে দেশে আসলে দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের ১৯৯৭ সালের সম্মেলনে কার্যকরী সংসদের সদস্য করে পুনরায় রাজনীতি করার পথ সুগম করে দেন তিনি। ১৯৯১ সালের সম্মেলনেও আমাকে আওয়ামী লীগের জেলা কমিটিতে নিয়ে নিতে চেয়েছিলেন কিন্তু দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি পদে শূন্যতা হবে চিন্তা করে সিনিয়র নেতাদের পরামর্শে নেয়নি। ১৯৯৭ সালে যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ সেলিম ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউশন এসে মিটিং-এর পর ঢাকা থেকে ঘোষিত আহবায়ক কমিটিতে দায়িত্ব নেয়ার কথা হলেও শেয়ার মার্কেটে টাকা-পয়সা হারিয়ে পুনরায় চাকুরী নিয়ে বিদেশে চলে যাই। আবার যখন ২০০৪ সালে মেয়র নির্বাচনের আগ মুহুর্তে আমার শ্রদ্ধাভাজন দুই নেতা (বাবু ভাই-মুসলিম ভাই) উভয়ে বাবু ভাইয়ের ড্রয়িং রুমে দক্ষিণ জেলা যুবলীগের সভাপতি প্রার্থী হওয়ার কথা বললে আমার অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজী হলাম। নেতার নির্দেশ মানলাম কিন্তু মেয়র নির্বাচনের কারণে যথাসময়ে সে সম্মেলন হয়নি। আমাকে
আমার নেতা বিশ্বাস করতেন, সে বিশ্বাসের সাথে কোনদিন বেঈমানী করিনি। ২০০৮ সালে সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে এম.পি মনোনয়ন চাওয়ার আগ্রহ ব্যক্ত করলে সুদূর আমেরিকা থেকে ফোনে বললেন-ছালেহ ভাই, ছিদ্দিক মিয়া তোমাকে উপজেলা নির্বাচন করানোর কথা বলেছে। তিনি আমাকে এম.পি নয় উপজেলা নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিতে ও মনোনয়নপত্র দাখিল করতে বলেন। কিন্তু পরবর্তীতে ৫জন প্রার্থী হয়ে গেলে কেউ নির্বাচিত না হলে দলের ক্ষতি হবে চিন্তা করে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নিই। এরপর থেকে একটু অভিমানী হয়ে জেলা-উপজেলা ছাত্রলীগ সংক্রান্ত দায়িত্ব পালন করতে বললে আগ্রহ হারিয়ে ফেলি। বাবু ভাই
চাইতেন কর্মীরাই নেতা হউক। কিন্তু অনেক নেতা দলে ভুঁইফোড় আগন্তুকদের সুযোগ দিতে আগ্রহী। নেতা আমাকে বলতেন, কোনো পরিশ্রম বৃথা যায় না। তিনি প্রেসিডিয়াম সদস্য হওয়ার পর ২১ ফেব্রুয়ারি মিটিং-এর পর আমি যখন জানতে চাইলাম, আপনিতো প্রেসিডিয়ামে চলে গেছেন আমরা কীভাবে কাজ করবো? উত্তরে বললেন, তুমি এগিয়ে যাও। আমি বললাম, সিনিয়ররা কীভাবে নিবে? বললেন, তুমি যে মাঠে-ময়দানে কাজ করেছ জেল খেটেছ সবাই কি জানে না? তিনি আমাকে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আ. লীগের সাধারণ সম্পাদক পদের প্রার্থী হওয়ার সম্মতি প্রদান করলেন। প্রেসিডিয়াম সদস্য হওয়ার পর চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগকে গোছানোর ইচ্ছা অপূর্ণ রয়ে গিয়েছিল উনার। তাঁর মৃত্যুতে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে যা আজও পূরণ হওয়ার নয়। ২০১২ সালের ২৮মার্চ পলোগ্রাউন্ডে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জনসভার মূল সমন্বয়কারীর দায়িত্ব পালন করে স্মরণকালের বৃহত্তম জনসভা চট্টগ্রামবাসীকে উপহার দিয়েছিলেন। প্রিয় নেতা বাবু ভাইয়ের নির্দেশে আমি বাণিজ্য মেলার মাঠকে জনসভার মাঠ হিসেবে পলোগ্রাউন্ডকে প্রস্তুত করি।
আজ মনে পড়ছে ২০১২ সালের কথা। সে বছর বাবু ভাই ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয়ের ৪১ বছর উদযাপন উপলক্ষ্যে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের উদ্যোগে চট্টগ্রামে সর্ববৃহৎ আনন্দ র্যালি বের করে চট্টগ্রামবাসীকে তাক
লাগিয়ে দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গণে বাবু ভাই যে সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি ছিলেন এবং তিনি অভিভাবকের স্নেহের ছায়ায় তাঁর সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে সকলকে যে আগলে রেখেছিলেন সে প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিলো তাঁর মৃত্যুর পাঁচটি জানাজায়। তিনি যে কত বড় মাপের নেতা ছিলেন তা উনার জানাজার জনসমুদ্র প্রমাণ করে। কোনো রাজনীতিবিদের জানাজায় এত বেশি মুসল্লির সমাগম হয়েছে কী না আমার জানা নেই।
স্বৈরশাসক, সামরিক শাসক তাঁকে অত্যাচার-নির্যাতন করেছে, দলে ভিড়াতে চেয়েছে, মন্ত্রীত্ব দিতে চেয়েছে কিন্তু বঙ্গবন্ধুর রক্তের সাথে বেঈমানী করে তিনি প্রলোভনের সামনে নত স্বীকার করেননি।
সমাজসেবা, শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অকাতরে দান করে, কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে, দক্ষ মানব সম্পদ গড়তে, বিদেশী বিনিয়োগ শিল্পায়ন ইত্যাদি ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়। বৃহত্তর চট্টগ্রামের সমস্যা, সম্ভাবনা ও করণীয় জাতীয়ভাবে তুলে ধরে চট্টগ্রামের উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছেন।
ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, রাজনৈতিক কর্মীসহ সর্বস্তরের মানুষের সমস্যা সমাধানে দল-মতের ঊর্ধ্বে উঠে সহযোগিতা করতেন। তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই। উনার ছেলে-মেয়ে হারিয়েছেন পিতাকে, আর আমরা হারিয়েছি আমাদের শ্রদ্ধাভাজন প্রিয় নেতাকে, আর চাটগাঁ হারিয়েছে তার প্রিয় অভিভাবককে।
লেখক: সম্পাদক, চাটগাঁর সংবাদ ও
প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ।
Leave a Reply