আবদুল মান্নানঃ মাহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন, ‘তিনজনই পারেন একটি দেশ বা জাতিকে বদলাতে, তারা হলেন মা, বাবা ও শিক্ষক’।
শিক্ষা, শিক্ষার্থী ও শিক্ষক তিনশব্দ এক অবিমিশ্র সমাহার। একটির অনুপস্থিতিতে অন্যটি মুল্যহীন। কথায় আছে, সুশিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। আর এ মেরুদণ্ডের ধারক বা কান্ডারী হলো সুশিক্ষক। শিক্ষার্থী তার প্রধান অনুষঙ্গ। শিক্ষাদানের মত মহান দায়িত্ব যার কাজ তাকেই সমাজে শিক্ষক বলা হয়। আনুষ্টানিক অর্থে বিভিন্ন শিক্ষা
প্রতিষ্টানে যেমন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাদানের কাজে নিয়োজিতরাই শিক্ষক। তারা শিক্ষার্থীর কাছে মা-বাবার চেয়েই অনুকরনীয় ব্যাক্তিত্ব।
শিক্ষক কি শুধু পাঠ্যপুস্তকের অধ্যায়ন ও অনুশীলন করিয়েই শিক্ষাক্রমে বর্ণিত বিষয়বস্ত অর্জনে সহায়তা করে? কেবল শ্রেণি পাঠই শেখায়? আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় তাই এবং এটাই শিক্ষকের দায়িত্ব। কিন্তু একজন সুশিক্ষক শুধু শ্রেণি পাঠই শেখান না। তার আচরণ, দৃষ্টিভঙ্গি ও ব্যক্তিত্ব ইত্যাদির মাধ্যমে নিজের অগোচরেই আরো অনেক কিছু শিক্ষার্থীদেরকে শিখিয়ে যান। যা শিক্ষার্থীদের দৈনন্দিন জীবনে যাপনের জন্য প্রয়োজনীয় গুণাবলি, যোগ্যতা ও দক্ষতাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়ে তাকে সামাজিক, দেশপ্রেমিক ও একজন যোগ্য নাগরিক হতে সহায়তা করেন। একজন শিক্ষক যখন যথাসময়ে শ্রেণিকার কার্যক্রমে উপস্থিত হয় এবং যথাসময়ে প্রস্থান করেন শিক্ষার্থী তার কাছ থেকে নিয়মানুবর্তিতা শিখে নেয়। শিক্ষক যখন তার শিক্ষার্থীদের মতামত প্রদানের সুযোগ দেয় এবং তাদের মতামতকে প্রাধান্য দেয়, তখন শিক্ষার্থীর মধ্যে পরমতসহিষ্ণুতার প্রভাব দেখা যায় এবং গণতান্ত্রিক মনোভাব তৈরী হয়। শিক্ষকের সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ, তার শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রভাব বিস্তার করে। যেমন-শ্রেণিতে পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীকে বিশেষ সহায়তা, টিফিন নষ্ট হয়ে যাওয়া বা নিয়ে না আসা শিক্ষার্থীর সাথে টিফিন ভাগাভাগি, আর্তপীড়িতদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া ইত্যাদি। তখন শিক্ষার্থী শিক্ষকের অগোচরেই মানবতাবোধের এই গুণ অর্জন করে নেয়। সঠিকভাবে নিয়ম- নীতি, আইন-কানুন মেনে নিয়মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল শিক্ষক তার শিক্ষার্থীর মধ্যে ভালো-মন্দের বোধকে জাগ্রত করেন। শিক্ষার্থীও নৈতিকতার মত উত্তম গুণের অধিকারী হয়ে গড়ে ওঠে।
যখন বিদ্যালয়ের আঙ্গিনা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে উৎসাহী শিক্ষার্থী দলকে নিয়ে কাজ করেন শিক্ষকেরা, পরবর্তীতে তাদের যখন কোনো পুরস্কার যেমন- খাবার, শিক্ষা সামগ্রী উপহার দেয়া হয়, তখন শিক্ষার্থীর মধ্যে শ্রমের মর্যাদা ও পরিষ্কার
পরিচ্ছন্নতা এবং পরিবেশ সচেতনতার মত আদর্শ গুণাবলী বিকশিত হয়।
আরও পড়ুন স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে চট্টগ্রামকে বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে গেজেটভুক্ত করার দাবি
বিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে শিক্ষক যখন শিক্ষার্থীদের নিয়ে দল গঠন পূর্বক তাদের মাধ্যমে কার্য পরিচালনার সুযোগ করে দেয় তখন একজন শিক্ষার্থী একাধারে সমস্যার সমাধান, নিয়ন্ত্রণ, আত্মবিশ্বাস ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার মাধ্যমে নেতৃত্বের মতো গুণ অর্জন করে যা তার জীবন দক্ষতাকে বহুগুণে বাড়িয়ে তোলে।
বিভিন্ন পাঠচক্রে, ঘটনাক্রমে বিভিন্ন বৈশ্বিক চলমান ঘটনার বিবৃতি ও করণীয় নিয়ে যখন শিক্ষক মতামত দেয় এবং শিক্ষার্থীদের করণীয় সম্পর্কে সজাগ করে ভাবিয়ে তোলে তখন তার মাঝে বৈশ্বিক চেতনা সমুন্নত হয়ে নিজের মধ্যে বিশ্ব নাগরিকত্বের মনোভাব গড়ে ওঠে।
এছাড়াও বিভিন্ন উপায়ে শিক্ষক তার নিজের অজান্তেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে উপরে উল্লেখিত গুণাবলীসহ আরো অনেক দক্ষতার বিকাশ ঘটিয়ে যান। যা শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন অসামাজিক কর্মকাণ্ড থেকে দূরে রাখে। যেমন- উগ্রবাদ, সহিংসতা, মাদকাসক্তি, ইভটিজিং ও মানসিক অশান্তির মত সামাজিক ব্যাধি থেকে সরিয়ে এনে দক্ষ অবসর যাপনে যোগ্য করে তোলেন।
বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই দেখছি, এভাবেই একজন শিক্ষক তার শিক্ষণ কার্যক্রমকে শুধু শ্রেণীর চার দেওয়ালের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রাখেন না। তার বাইরেও কার্যক্রম পরিচালনা করে পরিবার, সমাজ ও দেশের ভাবমূর্তিকে সমুন্নত রেখে উৎপাদনশীল, সুখী ও বিশ্ব নাগরিক তৈরিতে ভুমিকা রেখে যাচ্ছেন আদর্শ শিক্ষকেরা।
লেখকঃ এম.ফিল (গবেষক), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বি.এড (অনার্স) এম.এড (প্রথম শ্রেণিতে প্রথম)
শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউট, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।