প্রতি বছর জুন থেকে অক্টোবর এ সময়ের মধ্যে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেড়ে যায়। জুলাই থেকে অক্টোবর নাগাদ সময়কে ডেঙ্গুর জন্য সর্বোচ্চ বিস্তারের মৌসুম হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। সে হিসেবে অক্টোবর মাস পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই যেটা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তা হচ্ছে জনসচেতনতা। একটু সচেতন হলে এ রোগের বিস্তার ঠেকানো সম্ভব এবং আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও কমানো সম্ভব। এখন ডেঙ্গু জ্বরের মৌসুম হওয়ায় এ রোগের বিস্তার আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। এর ভেতর যদি বৃষ্টি হয় তাহলে ডেঙ্গুর বিস্তার আরও মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। ফলে জনসচেতনতার বিষয়টি অধিক গুরুত্বপূর্ণ। জনসচেতনতা ছাড়া এ রোগের বিস্তার, আক্রান্তের হার এবং মৃত্যুর হার কমানো অসম্ভব হয়ে পড়ে।
ডেঙ্গু জ্বরের উৎপত্তি ডেঙ্গু ভাইরাসের মাধ্যমে এবং এই ভাইরাসবাহিত এডিস ইজিপ্টাই নামক মশার কামড়ে হয়ে থাকে। ডেঙ্গু জ্বরের জীবাণুবাহী মশা কোনো ব্যক্তিকে কামড়ালে সেই ব্যক্তি চার থেকে ছয়দিনের (৩-১৩ ক্ষেত্রে) মধ্যে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়।
এবার এই আক্রান্ত ব্যক্তিকে কোনো জীবাণুবিহীন এডিস মশা কামড়ালে সেই মশাটি ডেঙ্গু জ্বরের জীবাণুবাহী মশায় পরিণত হয়। এভাবে একজন থেকে অন্যজনে মশার মাধ্যমে ডেঙ্গু ছড়িয়ে থাকে। তা ছাড়া আক্রান্ত ব্যক্তির যত্রতত্র কফ থুথু ফেলার মাধ্যমেও ডেঙ্গু ভাইরাস ছড়াতে পারে। ডেঙ্গু ভাইরাস চার ধরনের হয়। তাই ডেঙ্গু জ্বরও চারবার হতে পারে। তবে যারা আগেও ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে পরবর্তী সময়ে রোগটি হলে সেটি মারাত্মক হওয়ার ঝুঁকি থাকে। ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু জ্বরে সাধারণত তীব্র জ্বর ও সেই সঙ্গে শরীরে প্রচন্ড ব্যথা হয়। জ্বর ১০৫ ফারেনহাইট পর্যন্ত হয়। শরীরে বিশেষ করে হাঁড়, কোমর, পিঠসহ অস্থিসন্ধি ও মাংসপেশিতে তীব্র ব্যথা হয়। এ ছাড়া মাথাব্যথা ও চোখের পেছনে ব্যথা হয়। অনেক সময় ব্যথা এত তীব্র হয় যে মনে হয় হাঁড় ভেঙে যাচ্ছে। তাই এই জ্বরের আরেক নাম 'ব্রেক বোন ফিভার'। জ্বর হওয়ার চার বা পাঁচদিনের সময় সারা শরীরজুড়ে লালচে দানা দেখা যায়। যাকে বলা হয় স্কিনর্ যাশ, অনেকটা অ্যালার্জি বা ঘামাচির মতো। এর সঙ্গে বমি বমি ভাব এমনকি বমি হতে পারে। রোগী অতিরিক্ত ক্লান্তিবোধ করে এবং রুচি কমে যায়। ডেঙ্গু জ্বর একটি এডিস মশা বাহিত ডেঙ্গু ভাইরাসজনিত গ্রীষ্মমন্ডলীয় রোগ। এডিস মশার কামড়ের মাধ্যমে ভাইরাস সংক্রমণের তিন থেকে পনেরো দিনের মধ্যে সচরাচর ডেঙ্গু জ্বরের উপসর্গগুলো দেখা দেয়। দুই থেকে সাত দিনের মধ্যে সাধারণত ডেঙ্গু রোগী আরোগ্য লাভ করে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে রোগটি মারাত্মক রক্তক্ষরী রূপ নিতে পারে যাকে ডেঙ্গু রক্তক্ষরী জ্বর (ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার) বলা হয়। এর ফলে রক্তপাত হয়, রক্ত অনুচক্রিকার মাত্রা কমে যায় এবং রক্ত পস্নাজমার নিঃসরণ ঘটে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে কখনোবা ডেঙ্গু শক সিনড্রোম দেখা দেয়। ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে রক্তচাপ বিপজ্জনকভাবে কমে যায়। কয়েক প্রজাতির এডিস মশকী (স্ত্রী মশা) ডেঙ্গু ভাইরাসের প্রধান বাহক। যেগুলোর মধ্যে এডিস ইজিপ্টি মশকী প্রধানতম। ভাইরাসটির পাঁচটি সেরোটাইপ পাওয়া যায়। ভাইরাসটির একটি সেরোটাইপ সংক্রমণ করলে সেই সেরোটাইপের বিরুদ্ধে রোগী আজীবন প্রতিরোধী ক্ষমতা অর্জন করে, কিন্তু ভিন্ন সেরোটাইপের বিরুদ্ধে সাময়িক প্রতিরোধী ক্ষমতা অর্জন করে।
ডেঙ্গু ও করোনার যে পরিস্থিতি এখন বাংলাদেশে সাধারণত জুন থেকে সেপ্টেম্বর, অক্টোবর মাস পর্যন্ত ডেঙ্গু জ্বরের মৌসুম। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে প্রতিদিন প্রায় ২০০ জন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে নতুন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়। ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরোধী টিকা কয়েকটি দেশে অনুমোদিত হয়েছে। তবে এই টিকা শুধু একবার সংক্রমিত হয়েছে এমন ব্যক্তির ক্ষেত্রে কার্যকর। মূলত এডিস মশার কামড় এড়িয়ে চলাই ডেঙ্গু প্রতিরোধের প্রধান উপায়। তাই মশার আবাসস্থল ধ্বংস করে মশার বংশবিস্তার প্রতিরোধ করতে হবে। এ জন্য এডিস মশার বংশবিস্তারের উপযোগী বিভিন্ন আঁধারে, যেমন- কাপ, টব, টায়ার, ডাবের খোলস, গর্ত, ছাদ ইত্যাদিতে আটকে থাকা পানি অপসারণ করতে হবে। শরীরের বেশির ভাগ অংশ ঢেকে থাকে এমন পোশাক পরিধান করতে হবে। রাতে ঘুমানোর সময় মশারি টাঙিয়ে ঘুমাতে হবে। বাড়ির আশপাশের আঙিনা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে এবং এডিস মশা নিধনের স্প্রে বাড়ির আশপাশে ব্যবহার করতে হবে। ডেঙ্গু জ্বর হলে পরিপূর্ণ বিশ্রাম নিতে হবে এবং বেশি করে তরল খাবার গ্রহণ করতে হবে। জ্বর কমাতে প্যারাসিটামল দেওয়া হয়। প্রায়ই রোগীর শিরায় স্যালাইন দিতে হতে পারে। মারাত্মক রূপ ধারণ করলে রোগীকে রক্ত দিতে হতে পারে। ডেঙ্গু জ্বর হলে কোনো ধরনের এন্টিবায়োটিক ও ননস্টেরয়েডাল প্রদাহপ্রশমী ওষুধ সেবন করা যাবে না, করলে রক্তপাতের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীকালে ডেঙ্গু একটি বৈশ্বিক আপদে পরিণত হয়েছে। এশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকা ও অন্যান্য মহাদেশের ১১০টির অধিক দেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব লক্ষ্য করা যায়। প্রতি বছর পাঁচ থেকে পঞ্চাশ কোটি মানুষ ডেঙ্গুতে সংক্রমিত হয় এবং তাদের মধ্যে দশ থেকে বিশ হাজারের মতো মারা যায়। ১৭৭৯ সালে ডেঙ্গুর প্রথম উলেস্নখ পাওয়া যায়। বিংশ শতকের প্রথমভাগে ডেঙ্গুর ভাইরাস উৎস ও সংক্রমণ বিশদভাবে জানা যায়। মশক নিধনই বর্তমানে ডেঙ্গু প্রতিরোধের প্রধান উপায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিশটি অবহেলিত গ্রীষ্মমন্ডলীয় রোগের একটি হিসেবে ডেঙ্গু চিহ্নিত করেছে। তাই অধিক জনসচেতনতা এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও মশা নিধন স্প্রে ব্যবহারের মাধ্যমে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ ও নিধন করা সম্ভব।