২৩ সফর চুনতী হযরত শাহ ছাহেব কেবলার বাৎসরিক ইছালে ছওয়াব মাহফিল। তিনি ১৯৮৩ সালের এ দিনে ইন্তেকাল করেন। এ মহান আশেকে রসুল সম্ভ্রান্ত ও জমিদার পরিবারে জন্ম নেন। তার নিজ জন্মস্থান চুনতীতে ১৯ দিন ব্যাপী মাহফিলে সীরতুন্নবী (স.) প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। তার ইন্তেকালের দীর্ঘ ৪১ বছর পর আজও সুন্দর সুচারুভাবে মাহফিল চলমান। দেশ বিদেশে ঘরোয়াভাবে ৪০ দিন, ৬৩ দিন ব্যাপী ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদির কথা শোনা গেলেও বৃহত্তর পরিসরে বিশাল আয়োজনে দীর্ঘ ১৯ দিন ব্যাপী ধর্মীয় মাহফিল বাংলাদেশ ত নয়ই, বিশ্বে আর কোথাও আছে কিনা জানা নেই। হযরত শাহ ছাহেব কেবলার মূল নাম হযরত আলহাজ শাহ মাওলানা হাফেজ আহমদ (রহ.)। তিনি চট্টগ্রাম দারুল উলুম মাদরাসা থেকে কৃতিত্বের সাথে ফাজিল পাস করেন। অতঃপর কলকাতা আলিয়া মাদরাসায় ভর্তি হন এবং আরও উচ্চ ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ১৯০৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন। এই বছর তাঁর দাদা বিখ্যাত জমিদার হযরত শাহ মাওলানা ইউসুফ আলী, তার পুত্র (হযরত শাহ ছাহেব কেবলার পিতা) হযরত সৈয়দ আহমদকে সাথে নিয়ে হজে গমন করেন। তথায় তার দাদা হযরত ইউসুফ আলী ইন্তেকাল করেন। ফলে হযরত শাহ ছাহেব কেবলার জেঠা তথা দাদার প্রথম সন্তান হযরত শাহ মাওলানা ফয়েজ আহমদ (রহ.) পিতার জমিদারি এস্টেট দেখভাল করার জন্য ঘন ঘন আরাকান যাওয়া–আসা করতেন।
এ সময় আরাকানে ভারতীয় উত্তর প্রদেশের মহান সূফী দরবেশ পীর হযরত আলহাজ্ব শাহ মাওলানা হামেদ হাসান আলভী (রহ.)’র মোলাকাত পান। যিনি আজমগড়ী হযরত হিসেবে এতদঅঞ্চলে সমধিক পরিচিত। তাঁর নিকট মুরিদ হন। আজমগড়ী হযরত চট্টগ্রাম শহরে তরিকতের সফরে আসলে হযরত শাহ ছাহেব কেবলার জেঠা জমিদারি এস্টেটের প্রধান হযরত মাওলানা ফয়েজ আহমদ তার পীর আজমগড়ী হযরতকে চাকতাই থেকে বৃহদাকৃতির গদু নৌকা যোগে ঢলু নদীর গাটিয়াডাংগা ঘাটে পৌছান। তথা হতে ছোট নৌকায় আধুনগর নৌঘাটে নিয়ে যান। তথা হতে ঘোড়া/তাঞ্জান করে চুনতী হযরত শাহ ছাহেব কেবলার পৈতৃক বাড়িতে পৌছেন। হযরত শাহ ছাহেব কেবলাও আজমগড়ী হযরতের সুদৃষ্টি পেতে পেতে ধন্য হতে থাকেন। হযরত শাহ ছাহেব কেবলা ছিলেন অসাধারণ স্মৃতিশক্তির অধিকারী। পরিণত বয়সে তিনি ৫০/৬০ বছর আগের ছাত্র জীবনের জ্ঞানার্জন করা আরবি, ফার্সি, কবিতা, এমনকি তফসীর, হাদীস, ফিকাহসহ বিভিন্ন বিষয় মুখস্থ বলতে পারতেন। দেশ বিদেশের প্রখ্যাত আলেমগণ যখনই তার সান্নিধ্যে আসতেন ওনার কোরআন হাদীসের আলোচনা শুনে তারা মুগ্ধ হয়ে একাগ্রচিত্তে তার পানে চেয়ে থাকতেন। হযরত শাহ ছাহেব ছিলেন দুনিয়ার সব ভয় ভীতির উর্ধ্বে। অর্থ সম্পদের উপর তার কোন মোহ ছিল না। ভক্তদের দেয়া অর্থও তিনি গরীব–দুঃখীদের মাঝে বিতরণ করে দিতেন। ইন্তেকালের সময় তার সঞ্চয় বলতে এক কপর্দকও ছিল না। হযরত শাহ ছাহেব কেবলার শারীরিক গঠন ছিল রাজাধি রাজের মত। তেমনি ছিল তার জ্যোতির্ময় চেহারা। তার দাদা হযরত কাজী ইউসুফ আলী (রহ.)’র বিশাল জমিদারী এস্টেট ছিল আরাকানে। হযরত শাহ ছাহেব কেবলা আরাকানে থাকা অবস্থায় শবে কদরের রাতে ফানাফির রাসূল হিসেবে নিজেকে নিজে হারিয়ে ফেলেন। দীর্ঘ প্রায় ৩৭ বছর পাহাড়ে পর্বতে লোকালয়ে বিচরণ করতে থাকেন রাত দিন, নিম্নলিখিত পঙক্তি আউড়াতে থাকতেন। তা হল
হাম মাজারে মুহাম্মদ (স.) পে মর জায়েঙ্গে, জিন্দেগি মে য়াহি কাম কর জায়েঙ্গে। (অর্থাৎ) হযরত মুহাম্মদ (স.)’র উদ্দেশ্যে আমার জীবন উৎসর্গীত, সারা জীবন তার ধ্যানেই আমি থাকব নিয়োজিত। এ দীর্ঘ সময় তার পুণ্যবতী স্ত্রী (চাচাত বোন), ১ পুত্র ১ কন্যা সন্তানকে নিয়ে জীবন অতিবাহিত করেন। ১৯৬০ এর দশকে এসে তিনি পর্যায়ক্রমে অনেকটা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে থাকেন। তাও কিন্তু শতভাগ নয়। এমনি অবস্থায় তিনি পৈতৃক বাড়ী থেকে ৩/৪ শত মিটার দক্ষিণে নতুন বাড়ী নির্মাণ করে চলে আসেন। যা শাহ মঞ্জিল হিসেবে সর্বজনের কাছে প্রসিদ্ধ।
তিনি ১৯৭২ সালে শাহ মঞ্জিলের দক্ষিণ পাশে মাহফিলে সীরতুন্নবীর আয়োজন করেন ১ দিনব্যাপী। ১৯৭৩ সালে ৩ দিন, ১৯৭৪ সালে ৫দিন, ১৯৭৬ সালে ১০ দিন, ১৯৭৯ সালে ১২ দিন, ১৯৭৮ সালে ১২ দিন, ১৯৭৯ সালে ১৫ দিন সে সময় আরও ২ দিন বাড়িয়ে ১৭ দিন, আবার আরও ২ দিন বাড়িয়ে ১৯ দিনে গিয়ে মাহফিল সমাপ্ত হয়। ১৯৮০ সাল থেকে অদ্য অবধি ১৯ দিনব্যাপী এ মাহফিলে সীরতুন্নবী আজিমুশশান হিসেবে চলমান। রবিউল আউয়াল মাসের চাঁদ উঠার পর হতে তিনি বেহাল হয়ে পড়তেন। মাহফিলে সীরতুন্নবীর আখেরী মোনাজাতের পর বেশ কিছুদিন তিনি শোকাহত মনে কান্না জড়িত অবস্থায় থাকতেন। তিনি জীবদ্দশায় মাহফিলে মেহেরাজুন্নবী চালু করেন। সাথে সাথে শবে বরাত, শবে কদর, আশুরা দিবস, ফাতেহা–ই–ইয়াজদাহম আয়োজন করে ছিলেন। শাহ মঞ্জিলের পশ্চিম দিকে প্রায় ১৩ একর এরিয়া নিয়ে বিশাল আকারে মাহফিলে সীরতুন্নবীর ময়দান প্রতিষ্ঠা করেন। এই ময়দানের পশ্চিম পাশে মসজিদে বায়তুল্লাহ নির্মাণ শুরু করে দেন। তিনি ছিলেন মানব দরদী, মানুষকে ভালবাসতেন। শিশুদের প্রতি তাঁর ভালবাসা ছিল অপরিসীম। ১৯ দিনব্যাপী মাহফিলে সীরতুন্নবীতে শিশুদের আলাদা খাবারের ব্যবস্থা থাকায় সচ্ছল গরীব হাজার হাজার পরিবারের শিশু এ খাবার খেয়ে থাকেন। তিনি যেমন আত্মীয়ের হকের প্রতি খবর রাখতেন, তেমনি তার অসংখ্য গুণাগুণের মধ্যে অন্যতম একটি হল কৃতজ্ঞতাবোধ। অর্থাৎ অতীতের মূল্যবোধ তার দিলে জাগরুক থাকত। একালে শত ত নয়ই হাজারে কয়জনই বা অতীতকে মনে রাখে। মানুষ কতই না স্বার্থপর। আর হযরত শাহ ছাহেব কেবলা ছিলেন তার সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। অতীতকে মনে রাখতেন।
তাঁর দাদার জমিদার বাড়ী ইউসুফ মঞ্জিল মেহমানদারীর জন্য প্রসিদ্ধ। সেই সময় রাতে মুসাফিরকে খাবার প্রদানের জন্যও প্রসিদ্ধ ছিল। এ শাহ মঞ্জিল নতুন বাড়ীতে আজও নিয়মিত মেহমান আসা–যাওয়া জারি রয়েছে। চুনতীর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির প্রতিও ছিল তার দরদ। সেই সাথে অবদান। বিশেষ করে চুনতী হাকিমিয়া কামিল মাদ্রাসা, ফাজিল থেকে কামিল স্তরে প্রতিষ্ঠা করা, মাদ্রাসার অবকাঠামোগত উন্নয়নে হযরত শাহ ছাহেব কেবলার অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে। চুনতী প্রাইমারী স্কুল, হাই স্কুল, মহিলা মাদ্রাসা, ডিগ্রী কলেজে তার কোন না কোনভাবে অবদান খাট করে দেখার সুযোগ নেই। প্রায় ১৩ একর বিশাল এরিয়ার ময়দানে মাহফিলে সীরতুন্নবী বাংলাদেশ পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সাড়া জাগায়। বিশ্বে ১৯ দিনব্যাপী ধর্মীয় মাহফিল হযরত শাহ ছাহেব কেবলা প্রথম প্রবর্তন করেন। এই মাহফিলে রাষ্ট্রপতি, বিচারপতি, স্পিকার, মন্ত্রীসহ দেশ বিদেশের অনেকে অতিথি হয়ে আগমন করেন। অপরদিকে, আলোচক হিসেবে আসেন সৌদি আরবের প্রধান বিচারপতি, রাষ্ট্রদূত সহ বিভিন্ন দেশ থেকে আসা অতিথিবৃন্দ, সারাদেশ থেকে অলি, পীর মাশায়েখ মোফাসসের, মোহাদ্দেস, মুফতিগণ। চুনতীতে রয়েছে যেমনি বাঘাবাঘা শিক্ষাবিদ, তেমনি রয়েছেন মহান আল্লাহর অলি দরবেশ। বিশেষ করে হযরত মাওলানা আবদুল হাকিম, তাঁর সহোদর ভ্রাতা নাসির উদ্দিন ডেপুটি, শুকুর আলী মুন্সেফ, মাওলানা ফজলুল হক, মাওলানা নজির আহমদ, মাওলানা হাকীম মুনির আহমদসহ অনেকে । কিন্তু ১৯৭০ এর দশক থেকে মাহফিলে সীরতুন্নবীসহ হযরত শাহ ছাহেব কেবলার কর্ম তৎপরতায় চুনতী গ্রামকে দেশ পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রসিদ্ধতা এনে দেয়। এ মহান আশেকে রাসূল হযরত আলহাজ্ব শাহ মাওলানা হাফেজ আহমদ (রহ.) ১৯৮৩ সালে ২৯ নভেম্বর তথা ২৩ সফর মাহফিলে সীরতুন্নবীর মাত্র ১৬ দিন আগে নিজ বাড়ীতে ইন্তেকাল করেন। সীরত ময়দানে জানাযার পর বায়তুল্লাহ এর দক্ষিণ পাশে তাকে সমাহিত করা হয়। তিনি ইন্তেকাল করে গেছেন ৪১ বছর হল। কিন্তু ১৯ দিনব্যাপী মাহফিলে সীরতুন্নবী সুন্দর সুচারুভাবে চলমান। ১৯ দিনব্যাপী মাহফিলে হাজার হাজার নবী প্রেমিক আর্থিক সহায়তা দিয়ে আসছেন। প্রতি বছর যার অংক হয়ত সর্বসাকুল্যে কয়েক কোটি টাকা হবে। তিনি জীবনে ৬ বার হজব্রত পালন করেন। প্রথমবার ১৯৭০ সালে, ২য় বার ১৯৭২, ৩য় বার ১৯৭৪, ৪র্থ বার ১৯৭৬, ৫ম বার ১৯৭৮, ৬ষ্ঠ বার ১৯৭৯ সালে। তিনি একাধিকবার ভারত সফর করেন। যেয়ারতের উদ্দেশ্যে গমন করেন কলকাতা, বান্ডেল, আজমগড়, দিল্লি, আজমীর, মুম্বাইসহ অনেক স্থানে।
ইন্তেকালের ২/৩ বছর আগেও তিনি ভারত সফর করেন। এই সফরে ভারত থেকে কলকাতা পৌঁছেন। বান্ডেল গমন করেন হযরত সৈয়দ আবদুল বারী (রহ.) আল হাসানী ওয়াল হোসাইনীর যেয়ারতে । বিমানে কলকাতা থেকে বানারস হয়ে আজমগড় গমন করেন। আজমগড় থেকে গোন্ডা যান। আজমগড়ী হযরতের যেয়ারতে তথায় রাত্রি যাপন করেন। পরদিন দিল্লি অতঃপর আজমীর যেয়ারতে গমন করেন। মহান আল্লাহ পাক মাহফিলে সীরতুন্নবী কিয়ামত পর্যন্ত জারি রাখুন। সাথে সাথে হযরত শাহ ছাহেব কেবলাকে পরকালে আলা মোকাম দান করুন। আমিন।
লেখক: প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, গবেষক।