একাত্তরের মার্চ মাসকে আমরা বলি উত্তাল মার্চ, আগুন ঝরানো মার্চ। কিন্তু ১৯২০-এর ১৭ মার্চ তেমন আগুন ঝরানো ছিল না। তবে এটা ঠিক যে, ওই ১৭ মার্চ টুঙ্গিপাড়ায় একটি আগুনের ফুলকির জন্ম হয়েছিল। সেই আগুনের ফুলকি বাঙালির প্রাণে আগুনের ছোঁয়া লাগিয়েছিল একাত্তরের মার্চে। সে কারণেই ’৭১ আমাদের আগুন ঝরানো মার্চ।
যতকাল রবে পদ্মা, মেঘনা গৌরী, যমুনা বহমান - ততকাল রবে কীর্তি তোমার. শেখ মুজিবুর রহমান। কবি ও প্রাবন্ধিক অন্নদাশঙ্কর রায় যাকে ঘিরে কবিতার মতো এই সত্যকথন রচনা করেছেন, বাংলাদেশ আজ গভীর শ্রদ্ধা ও অবনত মস্তকে স্মরণ করছে সেই মহামানবকে। যার হাত ধরে এই ভূখণ্ডে রচিত হয়েছে বিস্ময়কর এক ইতিহাস। হাজার বছরের পরাধীনতার নাগপাশ ছিন্ন করে বিশ্বের মানচিত্রে স্থান করে নিয়েছে নতুন এক রাষ্ট্র। বাঙালি পেয়েছে জাতিসত্তার পরিচয় ও অধিকার।
আগামীকাল ১৭ মার্চ। সেই মহামানব, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১০৪ তম জন্মদিন। ১৯২০ সালের এই দিনে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় শেখ পরিবারে জন্ম হয় তার। তার জন্মদিন জাতি একই সঙ্গে 'জাতীয় শিশু দিবস' হিসেবেও উদযাপন করছে। দিনটি উদযাপিত হচ্ছে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায়।
বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্কুলজীবনেই জড়িয়ে পড়েন রাজনীতিতে। কৈশোরে গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র থাকার সময় ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যোগ দেওয়ায় প্রথম কারাবরণ করেন তিনি।
তাঁর সাহসী ও আপোষহীন নেতৃত্বে অনুপ্রাণিত হয়েই পাকিস্তানি উপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়েছিল বাঙালি জাতি।
ছোটবেলা থেকে বঙ্গবন্ধু ছিলেন প্রতিবাদী।অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করতেন না। তার প্রমাণ পাওয়া যায় বঙ্গবন্ধুর পিতা শেখ লুৎফর রহমানের কথা থেকেই। দেশের ক্রান্তিলগ্নে বঙ্গবন্ধু যখন লড়ে যাচ্ছিলেন তখন এক সাক্ষাৎকারে লুৎফর রহমান বলেছিলেন, সে তো ছোটবেলা থেকেই প্রতিবাদী। অন্যায় সহ্য করতো না। কোথাও তা দেখলে প্রতিবাদ করতো। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী মানসিকতা, গরিব দুঃখী মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও তাদের দুঃখ দূর করার প্রতিজ্ঞা পরবর্তীতে তাকে রাজনীতিতে নিয়ে আসে। ১৯২৭ সালে শেখ মুজিব গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরু করেন,১৯২৯ সালে গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে ভর্তি হন এবং ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। ১৯৩৭ সালে গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হন ।
১৯৪৯ সালে অসুস্থ শরীর নিয়ে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর পিতা তাকে বাঁধা দেননি। বলেছিলেন " বাবা রাজনীতি কর আপত্তি করব না। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করসো এতো সুখের কথা তবে লেখা পড়া করতে ভুলো না লেখা পড়া না শিখলে মানুষ হতে পারবা না আর একটা কথা মনে রেখো তোমার উদ্দেশ্যে আন্তরিকতা ও সততা থাকলে জীবনে পরাজিত হবে না। ম্যাট্রিক পরীক্ষার পরপরই মুজিব কলকতায় যান। কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে ছাত্র থাকা অবস্থায় রাজনৈতিক জীবনের পরিবর্তন গুলো শুরু হয়। তিনি পাকিস্তান আন্দোলনে সক্রিয় হন এবং মৌওলানা ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল কাশেমের মতো গুণীজনদের সান্নিধ্যে আসেন। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টি হলে শেখ মুজিব ও ঢাকায় চলে আসেন। নতুন রাজনৈতিক চিন্তা চেতনা নিয়ে ১৯৪৮ সালে ছাত্রলীগ গঠন করেন।
১৯৪৯ সালে নবগঠিত পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি নিয়ে গড়ে ওঠা আন্দোলনে অংশ নেয়ার মাধ্যমে শেখ মুজিবের রাজনৈতিক তৎপরতা ত্বরান্বিত হয়।১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৮ এর সামরিক শাসন বিরুদ্ধী আন্দোলন, ১৯৬২ এর শিক্ষা আন্দোলন ও ১৯৬৬ এর ঐতিহাসিক ৬ দফা ভিত্তিক আন্দোলনের মাধ্যমে তিনি হয়ে ওঠেন বাঙালীর অবিসংবাদিত নেতা। ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান মধ্য দিয়ে ছাত্র জনতা তাঁকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দেন ।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে বাঙালিরা বঙ্গবন্ধু ও তাঁর ৬ দফার পক্ষে অকুণ্ঠ সমর্থন জানায়। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী আওয়ামীলীগকে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে বাঙালির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের রাজনীতি শুরু করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে স্বাধীনতার ডাক দেন। ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনী পরিকল্পিতভাবে গণহত্যা শুরু করলে ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে দেশের আপামর জনগণ প্রায় নয় মাস যুদ্ধ করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ অর্জন করেন। তাঁর অবিসংবাদিত নেতৃত্বে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয় স্বাধীনতা। বিশ্বের মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের। স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার এই মহান নেতার জন্মদিনে গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাচ্ছি।।
বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর এক কুচক্রী মহল স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বে গাঁথা ইতিহাস বিকৃতির মধ্য দিয়ে , জাতির পিতার নাম ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা এমনকি ৭৫ সালে সপরিবারে হত্যার বিচার আইন করে বন্ধ করা হয়েছিল। একই সাথে গণতন্ত্র, মানবিক মর্যাদা, মানবাধিকার অর্থনৈতিক সাম্য, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি স্হাপন করার নিমিত্তে বাঙালির কাঙ্খিত স্বপ্ন ভেঙ্গে ধূলিসাৎ করে দিয়েছিল মুষ্টিমেয় স্বাধীনতাবিরোধী, পাকিস্তানের পরাজিত শত্রু, গুটিকয়েক উচ্চবিলাসী সেনা কর্মকর্তার নৃশংসতায়। কিন্তু বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতার অসমাপ্ত স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে। তাই, আসুন সবাই একসাথে হাতে হাত মিলিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজের স্বপ্ন গুলো বাস্তবায়ন করি। এটাই হোক জাতির প্রত্যাশা।