সৈয়দ শিবলী ছাদেক কফিল:
বিনয়বাঁশী জলদাস একজন শৈল্পিক ঢোলবাদক। দেশের লোকসংস্কৃতির এক নন্দিত শিল্পী তিনি। তৃণমূল থেকে উঠে আসা এ গুণী ঢোলবাদকের জন্ম চট্টগ্রামের বোয়ালখালী থানার ছন্দারিয়া গ্রামের জেলেপল্লিতে ১৯১১সালে। পিতা উপেন্দ্র নাথ জলদাস ও মাতা সরবালা জলদাস। ২০০২ সালের ৫ এপ্রিল নিজ বাড়িতে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এ গুণী শিল্পী বিনয় বাঁশী জলদাস। ঢোলের জাদুকর বিনয়বাঁশী জলদাস ঘুমিয়ে আছেন চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর ছন্দারিয়ার জেলেপল্লীতে। প্রান্তিক পরিবারে জন্ম নেয়া বিনয়বাঁশী জলদাসের রামসুন্দর বসাকের বাল্যশিক্ষাই ছিল প্রধান পাঠ। শৈশব থেকেই রেওয়াজ করেন ঢোল বাজনা। অতি আগ্রহ ও ভক্তিতে ঢোলকে গ্রহণ করলেন বিনয়বাঁশী। মাটি ও মানুষের সত্যিকারের শিল্পী বলে যাঁদের চিনে নেওয়া যায় বিনয়বাঁশী তাঁদেরই একজন। সামাজিক পশ্চাদপদতা দারিদ্র্যপীড়িত ও শোষিত জেলে সম্প্রদায়ের নিত্যসঙ্গী, এসব প্রতিকুলতার সঙ্গে সংগ্রাম করে বিনয়বাঁশী হয়ে উঠেন খ্যাতিমান। ঢোলের সাথে কেটেছে প্রায় ৮০ বছরের জীবনের অধিকাংশ সময়।
কবিয়াল সম্রাট রমেশ শীলের সঙ্গে পরিচয় বিনয়বাঁশীর জীবনের এক স্মরণীয় মুহূর্ত। এই লোক কবির সাহচর্যে এসেই তিনি নাগরিক সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে সুপরিচিত হয়ে উঠেন। ১৯৪৫ সালে রমেশ শীলের সঙ্গে তিনি কলকাতায় অনুষ্ঠিত ‘‘নিখিল বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলনে’ যোগ দেন। বিনয়বাঁশীকে গ্রহণ করেন বাংলা শ্রেষ্ঠ বাদক হিসেবে । এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। রমেশ শীলের সহশিল্পী হিসেবে ৩৫ বছর ধরে একাধারে ঢোল বাজিয়েছেন বিনয়, বাংলার ঢোল নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন ভারত উপমহাদেশের পথে-প্রান্তরে। সানাই, বেহালা, দো তারা, করতাল, মৃদঙ্গ বাজানোতেও পারদর্শিতা ছিল তাঁর। রমেশ শীল উপমহাদেশের প্রখ্যাত কবিয়াল আর বিনয়বাঁশী বাংলার বিখ্যাত ঢোলবাদক। ২০০২ সালে সরকার দুজনকেই একুশে পদতে ভূষিত করেন। বোয়ালখালীর সমাধিস্থলে সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স নির্মাণের আগ্রহ প্রকাশ করছেন বহু বহু গুণী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। বিনয় বাঁশীর জন্মভিটে ইতোমধ্যে ছন্দারিয়া খালে বিলীন হয়ে গেছে।
লন্ডনে বাংলাদেশ উৎসবে ঢোল বাদনের জন্য ১৯৯৯ সালে সরকার আমন্ত্রণ করেছিল বিনয় বাঁশীকে। কিন্তু অসুস্থতার কারণে তিনি যেতে পারেননি। তবে তাঁর যোগ্য ছেলে বাবুল জলদাস বাবার হয়ে লন্ডন মাতিয়ে এসেছিলেন। চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে তাঁর দলের ঢোলবাদনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় অনুষ্ঠান। বিনয়পুত্র বাবুল জলদাস আমেরিকা, জার্মানী, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়াসহ ভারতের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ঢোল বাজিয়ে সুনাম অর্জন করেছেন।
বিনয় বাঁশী সারা জীবন ভালোবেসে গেছেন দেশকে, দেশের মানুষকে। ঢোলের প্রতি ভালোবাসা ছিল আমৃত্যু। জীবনে অনেক জ্ঞানী-গুণীর ভালোবাসা তিনি পেয়েছেন। কিন্তু বিত্তের দিকে ফিরে তাকাননি ভুলেও। বাজনায় মুগ্ধ হয়ে উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নটরাজ উদয় শংকর তাঁর নৃত্যদল ‘মম বাণী’তে যোগ দেয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন বিনয়বাঁশীকে। নিজের জন্মস্থান ছন্দারিয়া গ্রাম ছেড়ে এ শিল্পী কোথাও যেতে চাননি বিনয়বাঁশি জলদাস।
সরকার ২০০২ সালে কবিয়াল রমেশ শীল ও বিনয়বাঁশীর সমাধিস্থলে সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স নির্মাণের ঘোষণা দিলেও এখনো তা বাস্তবায়িত হয়নি। ৫ এপ্রিল ২০২৪ শুক্রবার একুশে পদকপ্রাপ্ত প্রখ্যাত ঢোলবাদক বিনয়বাঁশী জলদাসের ২৩তম মৃত্যুবার্ষিকী।