প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জি২০ জোটের সামনে ছয়টি প্রস্তাব রেখে বলেছেন, টেকসই বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং বিশ্বের দক্ষিণাঞ্চলের (গ্লোবাল সাউথ) উন্নয়নের জন্য এগুলো সম্মিলিতভাবে সমাধান করা প্রয়োজন। বৃহস্পতিবার (১২ জানুয়ারি) ভারতের নয়াদিল্লীতে অনুষ্ঠিত ‘ভয়েস অফ দ্য সাউথ সামিট ২০২৩’—এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে (ইন্যাগুরাল লিডারস সেশন) গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, ‘বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনীতিকে (রাশিয়া—ইউক্রেন যুদ্ধ এবং কোভিড—১৯ মহামারীর প্রেক্ষাপট) বিবেচনায় নিয়ে, একটি ন্যায্য ও গ্রহণযোগ্য অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রণয়নে সম্মিলিতভাবে উদ্যোগ নেয়ার এখনই উপযুক্ত সময়।’
এই গুরুত্বপূর্ণ শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশকে অতিথি দেশ হিসেবে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, এই সম্মেলন বাংলাদেশকে বিশ্বজুড়ে যুক্ত হওয়ার সুযোগ তৈরি করে দেবে। এসময় জি২০ প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং ভারত সরকারকে আন্তরিক অভিনন্দন জানান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি ‘ভয়েস অফ দ্য সাউথ সামিট’ আহ্বান করার জন্য এবং ‘মানবকেন্দ্রিক উন্নয়ন’ বিষয়ক উদ্বোধনী নেতাদের অধিবেশনে তাঁকে আমন্ত্রণ জানানোর ধন্যবাদ জানান।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশ গ্লোবাল সাউথের একটি দেশ, ‘এক পৃথিবী, এক পরিবার, এক ভবিষ্যত’ ধারণার আওতায় অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য জি২০ এর প্রেসিডেন্ট হিসেবে ভারতের দৃষ্টিভঙ্গিকে স্বাগত জানায়। আসুন আমরা একটি সুন্দর ভবিষ্যত এবং একটি উন্নত বিশ্বের জন্য একসঙ্গে কাজ করি।’
টেকসই বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য রাখা ছয়টি প্রস্তাবের প্রথম প্রস্তাবে শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘মানবতার বৃহত্তর স্বার্থে বিশ্ব শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে হবে। দ্বিতীয়ত, একটি নতুন দৃষ্টান্ত প্রয়োজন যা এসডিজির সমান্তরালে সামগ্রিকভাবে বৈষম্যকে মোকাবিলা করবে। তৃতীয়ত, স্বল্পোন্নত দেশ, জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোসহ সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর জন্য বিশেষ অর্থায়নের প্রয়োজন, উত্তোরণের সময় এটি পূরণ করতে হবে। চতুর্থ প্রস্তাবে, নারীসহ সকলের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে ‘ডিজিটাল ডিভাইডস’ সেতুবন্ধন রচনার প্রয়োজনীয়তার কথা জানান তিনি। পঞ্চম প্রস্তাবে তিনি বলেন, ‘সব মানুষেরই ভালোভাবে জীবনযাপনের সমান অধিকার থাকা উচিত। বৈশ্বিক সম্প্রদায় দুর্ভাগ্যজনকভাবে মিয়ানমারের জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত নাগরিকদের (রোহিঙ্গা) বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে দেরী করছেন। তিনি বিশ^ সম্প্রদায়ের উদ্দেশে বলেন, তাদের (রোহিঙ্গা) মিয়ানমারে প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করতে যেন ভুলবেন না। ষষ্ঠ প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বৈশ্বিক মানব উন্নয়ন নিশ্চিত করতে সাউথ—সাউথ ও ত্রিপক্ষীয় সহযোগিতা জোরদার করুন। এখানে, অংশীদার, আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি খাত, থিঙ্ক—ট্যাঙ্ক এবং অন্যান্য স্টেকহোল্ডারদের কাছ থেকে সমর্থন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’
শেখ হাসিনা আরো বলেন, ‘প্রায় পাঁচ দশক আগে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘মহান অর্থনৈতিক উত্থান’—এর মুখে একটি ন্যায়সঙ্গত আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য জরুরি বোধ তৈরি করার আহ্বান জানিয়েছিলেন।’ তিনি বলেন, ‘আমরা বিশ্ব নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সহযোগিতায় মানবকেন্দ্রিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করার জন্য আপনার (মোদির) জোরালো উদ্যোগে অবদান রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
শেখ হাসিনা বলেন, সাম্প্রতিক কোভিড—১৯ মহামারী এবং চলমান রাশিয়া—ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বজুড়ে বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। এতে বিশ্বব্যাপী মন্দা দেখা দিয়েছে। এসব প্রতিকূলতা মোকাবেলা করার জন্য বিশ্বস্তরে সাহসী, দৃঢ় এবং সমন্বিত পদক্ষেপের প্রয়োজন। এসময় তিনি কোভিড মোকাবিলায় বাংলাদেশের উল্লেখ যোগ্য দিক তুলে ধরে বলেন, বাংলাদেশ বিশ্বের ৫ম সেরা কোভিড প্রতিরোধী দেশ এবং দক্ষিণ এশিয়ার সেরা পারফরমার হিসাবে স্থান পেয়েছে’ বলেন তিনি।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালে ইউএনজিএ—তে তাঁর যে প্রথম ভাষণ দেন তা উদ্ধৃত করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘একটি আন্তর্জাতিক দায়িত্ব¡ রয়েছে—নিজের এবং তার পরিবারের প্রত্যেকের স্বাস্থ্য ও সুস্থতার জন্য পর্যাপ্ত মানসম্মত জীবনযাপনের অধিকার নিশ্চিত করার।’ এই দৃষ্টিভঙ্গি আজও প্রাসঙ্গিক। এই চেতনাকে সামনে রেখে, আমরা অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করছি, তিনি যোগ করেন।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃত, গত এক দশকে বাংলাদেশ সবার জন্য সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। বাংলাদেশে গত ১৪ বছরে দারিদে্র্যর হার ৪১ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশে নেমে এসেছে এবং মাত্র এক দশকের ব্যবধানে মাথাপিছু আয় বেড়ে তিনগুণ হয়েছে। আমরা একটি শক্তিশালী অর্থনীতির ভিত্তি হিসেবে উন্নত ভৌত অবকাঠামো দিয়ে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়তে আকাঙ্খা রাখি।’
তিনি বলেন, বাংলাদেশ নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ করেছে। খুব শিগগিরই আমরা চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে ৩ দশমিক ২ কিলোমিটার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের কাজ শেষ করব, যা দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম।
তথ্যসূত্র: বাসস
Leave a Reply