আবু সাঈদ: তু’মা ইবনে উবাইরিক। মদিনার বনি যাফর গোত্রের মুসলিম পরিচয় প্রদানকারী এক মুনাফিক। সে ছিল অত্যন্ত কুটিল স্বভাবের। মুনাফিক হওয়ার পাশাপাশি চুরি করা, সত্য গোপন করা, অপবাদ দেয়া, খেয়ানত করা, মিথ্যা শপথ করা, মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া ইত্যাদি দোষে ছিল সে দুষ্ট।
তার একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে আল্লাহ তায়ালা কুরআনুল কারিমে সূরায়ে নিসার ১০৫ থেকে ১১৫ নম্বর পর্যন্ত ১১টি আয়াত নাজিল করেছেন। আয়াতগুলোতে তার মাঝে বিদ্যমান স্বাভাবগুলোর নিন্দা করা হয়েছে। এগুলোর মন্দ পরিণতির ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছে। তাকে উপলক্ষ্য করে সমগ্র মানবতাকে গুরুত্বপূর্ণ দিক নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।
‘কাতাদাহ ইবনে নোমান রা: নামক এক সাহাবী ছিলেন। তিনি বর্মসহ কিছু সরঞ্জমাদি আটার বস্তায় ভরে একটি কামরায় সংরক্ষণ করেছিলেন। তু’মা ইবনে উবাইরিক ছিল সেই সাহাবীর প্রতিবেশী। সে বস্তাসহ বর্মটি চুরি করে নিয়ে যায়েদ ইবনে সামীন নামক এক ইহুদির কাছে লুকিয়ে রাখে।
দুর্ভাগ্যক্রমে বস্তার একপাশ ছিল ছিদ্র। সেই ছিদ্রপথে আটা ছড়িয়ে পড়ে ইহুদির বাড়ি পর্যন্ত। এদিকে কাতাদাহ রা: বস্তা যথাস্থানে না পেয়ে খোঁজাখুজি শুরু করেন। তু’মা ইবনে উবাইরিককে জিজ্ঞাসা করলে সে সাফ অস্বীকার করে। কসম খেয়ে বলে, ‘আমি নেইনি এবং এ ব্যাপারে আমি কিচ্ছু জানি না। তখন তাকে ছেড়ে দিয়ে আটার চিহ্ন অনুসরণ করে যেতে থাকেন। যেতে যেতে ইহুদির বাড়িতে গিয়ে সেখানে বর্মটি দেখতে পান। তিনি বর্মটি উদ্ধার করে নিয়ে আসেন।
ইহুদি লোকটিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে সে বলে, আমি চুরি করিনি। তু’মা আমার কাছে বর্মটি রেখে গেছে। বেশ কয়েকজন লোক ইহুদির কথা সত্যায়ন করে সাক্ষ্য দিল। এদিকে তু’মা এ ঘটনা সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করল।
তারা জোট বেধে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গিয়ে আবেদন করল, হে আল্লাহর রাসূল, এ ঘটনার সাথে তু’মার কোনো সম্পর্ক নেই। বর্ম পাওয়া গেছে ইহুদির বাড়িতে, চুরিও করেছে সেই। অতএব আপনি তু’মার পক্ষ হয়ে উকালতি করুন এবং ইহুদিকে দোষী ঘোষণা করুন। অন্যথায় আমাদের গোত্রের কান কাটা যাবে।
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাহ্যিক প্রমাণাদি দেখে ইহুদিকে দোষী মনে করলেন এবং ইহুদির ওপর চুরির শাস্তি প্রয়োগ করার মনস্থির করলেন। এরই মাঝে আল্লাহ তয়ালা ইহুদির বক্তব্যের সত্যতা এবং চুরির সাথে তু’মার সম্পৃক্ততার কথা বিবৃত করে কুরআনে পূর্ণ দু’টি রুকু নাযিল করেন।’
বলা হয়ে থাকে, যে ব্যক্তি অন্যকে বিপদে ফেলার চেষ্টা করে, হাজারো বিপদ তার পেছনে ধাওয়া করে। যে মানুষ নিবিষ্ট মনে অন্যের ক্ষতির চিন্তায় মগ্ন থাকে নিজের ক্ষতি না হওয়া পর্যন্ত তাকে থামানো দায়।
মুফাসসিরীনে কেরাম বলেন, চুরির ঘটনা ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর তু’মা মদিনা থেকে পালিয়ে যায়। মক্কায় গিয়ে কাফেরদের সাথে মিশে যায় এবং প্রকাশ্যে কুফুরির ঘোষণা করে। কিন্তু পালিয়ে গিয়েও পাপের পরিণতি থেকে বাঁচতে পারেনি। মক্কায় যে নারীর ঘরে আশ্রয় নিয়েছিল, ওই নারী তার কুকীর্তির কথা জানতে পেরে তাকে ঘর থেকে বের করে দেয়।
এভাবে আশ্রয়হীন অবস্থায় ঘুরতে ঘুরতে একদিন এক ঘরে সিঁধ কেটে চুরি করতে গিয়ে তার ওপর দেয়াল ধসে পড়ে। দেয়ালের নিচে চাপা পড়ে তার করুণ মৃত্যু হয়।
এ ঘটনায় তু’মা ইবনে উবাইরিক এবং তার সম্প্রদায়ের জঘন্য কয়েকটি অপরাধ এবং মন্দ স্বভাবের চিত্র ফুটে উঠেছে।
১। চুরি করা, বিশ্বাসঘাতকতা করা, অন্যের সম্পদ আত্মসাৎ করা।
২। নিজের কৃত অপরাধের দায় অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া।
৩। অন্যায়কারীর পক্ষাবলম্বন করা। তার পক্ষে উকালতি করা। তাকে বাঁচানোর জন্য কূটকৌশলের আশ্রয় নেয়া।
৪। মিথ্যা কসম খাওয়া। কারো পক্ষে মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া।
৫। সত্য গোপন করা। সজ্ঞানে মিথ্যাকে সত্যের মোড়কে উপস্থাপন করা।
উপরোল্লিখিত প্রতিটি কাজই কবিরা গোনাহ। যেগুলো দুনিয়া এবং আখেরাতে কঠিন শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এছাড়াও এ ব্যাপারে যে সকল হুঁশিয়ারি উচ্চারণ হয়েছে সেগুলো হলো-
১। বিশ্বাসঘাতকদের আল্লাহ পছন্দ করেন না।
২। পক্ষাবলম্বনকারীদের বলা হয়েছে, দুনিয়াতে তো তোমরা তাকে সমর্থন করলে; কিন্তু ব্যাপার এখানেই শেষ নয়। কেয়ামতে যখন আল্লাহর আদালতে এ মুকাদ্দমার শুনানি হবে তখন কে তাকে সমর্থন করবে? কে তাকে রক্ষা করবে?
৩। এমন ঘৃণ্য অপরাধের পর যদি যথাযথ প্রক্রিয়ায় তাওবা না করে তাহলে আল্লাহ, রাসূল বা মুমিনদের তেমন ক্ষতি হবে না; বরং এ পাপের বোঝা তাদেরকেই বহন করতে হবে।
৪। যে নিজে কোনো অপরাধ করে অন্য নিরপরাধ ব্যক্তির ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়, যেমনিভাবে তু’মা চুরি করে ইহুদির ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছিল- সে জঘন্য অপবাদ এবং প্রকাশ্য গোনাহর বোঝা বহন করল।
আল্লাহ তায়ালা বনী যাফরের ঘৃণ্য এসকল কর্মকাণ্ড উল্লেখ করার পর এমন প্রেক্ষাপটে সাধারণ মুমিনদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কিছু করণীয় নির্ধারণ করে দিয়েছেন।
১। সাম্প্রদায়িকতা, স্বজনপ্রীতি, লোভ কিংবা ভয়ে প্রভাবিত না হয়ে শরীয়ত মোতাবেক ন্যায়সঙ্গত ফায়সালা করা।
২। অপরাধীর পক্ষাবলম্বন পরিহার করা। তার সঙ্গ এবং তার ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করা।
৩। যে কোনো মন্দ আচরণ প্রকাশিত হওয়ার ক্ষেত্রে লোকলজ্জার ভয়ের চেয়ে আল্লাহকে বেশি লজ্জা করা। তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা, অন্তর্জামী। প্রকাশ্য গোপন সবকিছুই তিনি জানেন, দেখেন। তাঁর কাছে কোনোকিছুই গোপন নেই। তাই সকল প্রকার মন্দ ও অন্যায় কাজ থেকে সর্বদাই বিরত থাকা।
৪। মন্দ কাজের জন্য কিংবা কারো ক্ষতির সাধনের উদ্দেশ্যে কানাকানি, সলা-পরামর্শ না করা।
৫। দুজন ব্যক্তির মাঝে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হলে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশে তা মীমাংসার চেষ্টা করা।
৬। নিরপরাধ কোনো ব্যক্তির ওপর অপবাদ দেয়া থেকে বিরত থাকা।
৭। যে কোনো ধরনের গোনাহ হয়ে গেলে অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর কাছে যথাযথ প্রক্রিয়ায় তাওবা করা।
আল্লাহ তায়ালা সবাইকে এসকল মন্দ স্বভাব থেকে বেঁচে থাকার তাওফীক দান করুন।
তথ্যসূত্র : আল কুরআন, তাফসিরে জালালাইন, মাআরেফুল কুরআন, সফওয়াতুত তাফাসির
Leave a Reply