ইসলামের চারজন খলিফা উম্মতে মুহাম্মাদীর শ্রেষ্ঠ সন্তান। তাঁরা নির্বাচিত হয়েছিলেন উম্মতের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদের পরামর্শক্রমে। তাঁদের মধ্যে পার্থিব স্বার্থ ছিল না ছিল না নেতৃত্বের মোহ। তাঁদের লক্ষ্য ছিল অপার্থিব। উম্মতের একান্ত প্রয়োজনে তাঁরা খিলাফতের কঠিন দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। সুতরাং বর্তমান যুগের নেতৃত্ব চেয়ে নেওয়ার এ রাজনীতির সঙ্গে ইসলামী খিলাফতের কোনো সম্পর্ক নেই। নিম্নে চার খলিফার রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করা হলো। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সান্নিধ্যে এসে তৎকালীন মানুষগুলো খাঁটি সোনায় পরিণত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন আমার সাহাবিরা এক একজন আকাশের নক্ষত্রতুল্য। তোমরা যাকে অনুসরণ করবে তার মধ্যে সত্যপথের সন্ধান পাবে। তার সান্নিধ্য পাওয়া সাহাবিদের মধ্যে ইসলামের চার খলিফা ছিলেন সবার থেকে আলাদা তাদের সঙ্গে কারও তুলনা হয় না। তারা উম্মতের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ। বিশ্বনবীর (সা.) সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ চার খলিফার শাসনামলকে ইসলামের ইতিহাসে খোলাফায়ে রাশেদিনের যুগ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। নবীজির পর তারা ৩০ বছর ইসলামের নেতৃত্ব দেন।
রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর অনুপস্থিতিতে আবু বকর (রা.) কে বিভিন্ন কাজে দায়িত্ব দিয়ে স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়ে গিয়েছিলেন যে আবু বকর (রা.) হবেন নবীজি (সা.) এর খলিফা। পরবর্তী সময়ে মদিনার সাকিফা বনু সাদায় মিলিত হয়ে আলোচনার এক পর্যায়ে আবু বকর (রা.) এর হাতে ওমর (রা.) এর বাইয়াত গ্রহণের মাধ্যমে তা কার্যকর হয়। অত:পর সবাই তাঁকে খলিফা হিসেবে মেনে নেন। হজরত আবু বকর (রা.) একবার খুতবার শুরুতে বললেন হে লোক সকল আমাকে তোমাদের শাসক বানানো হয়েছে যদিও আমি তোমাদের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি নই। অতএব আমি যদি ভালো কাজ করি তাহলে আমাকে সাহায্য করো। আর আমি যদি মন্দ কাজ করি তাহলে আমাকে সংশোধন করো। সত্য বলা আমানত মিথ্যা বলা খেয়ানত। তোমাদের দুর্বল ব্যক্তি আমার কাছে শক্তিশালী যতক্ষণ না আমি তার হক ফিরিয়ে দেব ইনশাআল্লাহ। আর তোমাদের শক্তিশালী (জালেম) ব্যক্তি আমার কাছে অসহায় ঠিক ততক্ষণ পর্যন্ত যতক্ষণ না আমি তার থেকে (আরেক ব্যক্তির) হক তুলে আনি ইনশাআল্লাহ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাতের পর তিনি খলিফা হন এবং মুসলমানদের নেতৃত্ব দেন। তার এ কথায় বেশ কিছু বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে। প্রথমত : ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষ সমান,শাসক হোক বা শাসিত সাদা হোক বা কালো,আরব হোক কিংবা অনারব। কোনোভাবেই একে অন্যের ওপর শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী নয়। এটা বোঝা যায় তার উল্লিখিত কথা যদিও আমি তোমাদের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি নই। তিনি সেই ১০ জন সৌভাগ্যশালীদের একজন মহানবী (সা.) যাঁদের বেহেশতের সুসংবাদ প্রদান করেছিলেন। দ্বিতীয়ত : তিনি বলেছেন যদি আমি ভালো কাজ করি তাহলে আমাকে সাহায্য করো। এখান থেকে বুঝা যায় জনগণের সুযোগ আছে শাসকের ভুল শুধরে দেওয়ার। আসল বিষয় হচ্ছে রাজার চালে রাজ্য চলে। শাসক যদি ঠিক থাকে তাহলে জনগণ এমনিতেই ঠিক হয়ে যায়। এজন্যই জনগণের কর্তব্য হচ্ছে শাসককে শুধরে দেওয়া। তবে সেটা শরিয়ত নির্দেশিত পন্থায় হতে হবে। তৃতীয়ত : মানুষের মধ্যে ইনসাফ ও সমতা রক্ষা করা যা ইসলামি রাষ্ট্রের প্রধান উদ্দেশ্য এবং শাসকের প্রধান কর্তব্য। এটা বোঝা যায় তার কথায় তোমাদের দুর্বল ব্যক্তি আমার কাছে শক্তিশালী যতক্ষণ না আমি তার হক ফিরিয়ে দেব। ইসলামের ইতিহাসে সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিকভাবে হজরত আবু বকর (রা.) প্রথম খলিফা নির্বাচিত হন।
হজরত আবু বকর (রা.) এর মৃত্যুকালে বিশিষ্ট সাহাবিদের সঙ্গে পরামর্শক্রমে পরবর্তী খলিফা হিসেবে ওমর (রা.) কে নির্বাচন করেন। অত:পর বিষয়টি উপস্থিত সাহাবায়ে কেরামের কাছে তিনি পেশ করলে সবাই তাতে সম্মতি জ্ঞাপন করেন। হজরত ওমর (রা.) যখন হজরত আবু বকর (রা.) এর স্থানে আসেন মানুষ তার কাঠিন্যের কারণে ভয়ে তটস্থ ছিল। তিনি তখন প্রথম খুতবাতেই মানুষের ভয় দূর করার জন্য বলেন হে আল্লাহ! আমি খুবই দুর্বল। সুতরাং আমাকে শক্তিশালী করে দেন। আমি অনেক বেশি দৃঢ়। অতএব আমাকে নমনীয় করে দেন। আমি খুব কৃপণ। সুতরাং আমাকে দানশীল বানিয়ে দেন। ইসলামের প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর (রা.) এর ওফাতের পর হজরত ওমর (রা.) শাসনভার গ্রহণ করেন। তার খেলাফত কাল (৬৩৪-৬৪৪) ইসলামের ইতিহাসে এক গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা করে। বিশ্বের সর্বকালের শাসকদের কাছে তিনি ছিলেন আদর্শ স্থানীয়। হজরত উমর (রা.)-এর বিখ্যাত একটি উক্তি রয়েছে তিনি বলেছিলেন সেই দুর্ভিক্ষের সময় আজ যদি ফোরাতের তীরে একটা প্রাণীও না খেয়ে মারা যায় তার জন্য আমি উমর আল্লাহর কাছে দায়ী থাকব। তিনিও সেই ১০ জন সৌভাগ্যশালীদের একজন মহানবী (সা.) যাঁদের বেহেশতের সুসংবাদ প্রদান করেছিলেন। হজরত ওমর (রা.) শাহাদাত বরণকালে ছয়জনকে নিয়ে একটি ‘শুরা’ গঠন করে দেন যাঁদের প্রত্যেকেই দুনিয়াতে জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত ছিলেন। তাঁরা নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করে উসমান (রা.) কে পরবর্তী খলিফা হিসেবে নির্বাচন করেন। হজরত ওমর (রা) শুধু একজন বিখ্যাত বিজেতাই ছিলেন না তিনি ছিলেন সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক এবং নিরঙ্কুশ সফলকাম জাতীয় নেতাদের অন্যতম। এক বিশাল সাম্রাজ্যের শাসক হয়েও হজরত ওমর (রা) সাধারণ মানুষের মতো জীবনযাপন করতেন।
হজরত ওসমান (রা.) প্রশাসক ও গভর্নরদের কাছে পত্র লিখে বলেন দেখো আল্লাহতায়ালা শাসকদের নির্দেশ দিয়েছেন তারা যেন রক্ষক হয়। তাদের এ কথা বলেন তারা যেন রক্ষক হয়। এই উম্মাহর অগ্রভাগ জামাত রক্ষক ছিল ভক্ষক ছিল না। তবে খুবই আশঙ্কা যে শাসকরা ভক্ষক হয়ে যাবে (শুধু রাজস্ব নিয়েই চিন্তা করবে) রক্ষক থাকবে না (প্রজাদের দেখাশোনা করবে না)। যদি তারা এমনটাই করে তাহলে লজ্জা উঠে যাবে আমানতদারিতা ও আনুগত্য চলে যাবে। হজরত উসমান (রা.) ছিলেন দয়ালু ও মহানুভাব একজন সাহাবি। হজরত ওমর (রা.) এর ওফাতের পর তিনি খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাকে খলিফা নির্বাচিত করা হলে তার নম্রতা ও বিনয় আরো বৃদ্ধি পায়। তিনি নিজ সম্পদ থেকে জনগণের খাদ্যের ব্যবস্থা করতেন। কিন্তু নিজে সিরকা ও যায়তুনের তেল ব্যবহার করতেন। তিনিও সেই ১০ জন সৌভাগ্যশালীদের একজন মহানবী (সা.) যাঁদের বেহেশতের সুসংবাদ প্রদান করেছিলেন। হজরত উসমান (রা.) এর সময় খেলাফতে প্রবল বিদ্রোহ দেখা দিলে হজরত আলী গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। বিদ্রোহীদের হাতে হজরত উসমান (রা.) ইন্তেকালের পর সব সম্প্রদায় এবং সমগ্র আরব জাহানের অনুরোধে হজরত আলী (রা.) খলিফা নির্বাচিত হন। তিনি ছিলেন খুব সহজ-সরল দয়ালু মানুষ। তিনি অতিরিক্ত উদার স্নেহপ্রবণ এবং অমায়িক ছিলেন। নবী কারিম (সা.) এর একটি বাক্যে হজরত উসমানের চরিত্র চিত্রিত করা যায়। তিনি বলেন আমার সাহাবিদের মধ্যে হজরত উসমান (রা.) সবচেয়ে নম্র ও লজ্জাশীল। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) তার আচরণে ও ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে পরপর দুবার নিজ দুই কন্যাকে তার সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি এত প্রিয় ছিলেন যে তার দুটি কন্যার ইন্তেকালের পরও অপর কোনো কন্যা থাকলে হজরত উসমানের সঙ্গে বিয়ে দিতেন বলে ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন।
হজরত উসমান (রা.) এর শাহাদাত বরণের পর হজরত আলী (রা.) কে খিলাফত গ্রহণের অনুরোধ করা হলে তিনি প্রত্যাখ্যান করে বলেন এটা তোমাদের এখতিয়ার নয় বরং এটি বদরি সাহাবা ও শুরা সদস্যদের দায়িত্ব। তাঁরা একত্রে বসে যাঁকে মনোনীত করবেন তিনিই খলিফা হবেন। পরবর্তী সময়ে মুহাজির ও আনসারি সাহাবিদের অনুরোধে মসজিদ-ই-নববীতে তিনি বাইয়াত গ্রহণ করেন। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর চাচা আব্বাস (রা.) সর্বপ্রথম তাঁর বাইয়াত গ্রহণ করলে বাকি সবাই তাঁর প্রতি আনুগত্যের বাইয়াত নেন। একবার হজরত আলী (রা.)-খলিফা থাকাকালীন আদালতে গিয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত কাজি শুরাইহের কাছে গিয়ে বললেন ইহুদির হাতে এই যে শিরস্ত্রাণটি দেখতে পাচ্ছ এটা আমার। আমি এটা বিক্রিও করিনি কাউকে দানও করিনি। কাজি শুরাইহ ইহুদিকে জিজ্ঞাসা করলেন এ ব্যাপারে তুমি কী বল ? সে বলল এটা আমারই শিরস্ত্রাণ। এটা আগে থেকেই আমার কাছে আছে। তখন শুরাইহ হজরত আলী (রা.)-কে বললেন আপনার কাছে কী কোনো প্রমাণ আছে ? তিনি বললেন আছে। হাসান ও হুসাইনই সাক্ষ্য দেবে যে শিরস্ত্রাণটি আমার। কাজি শুরাইহ বললেন সন্তানের সাক্ষ্য পিতার ক্ষেত্রে অগ্রহণযোগ্য। তখন হজরত আলী (রা.) বললেন জান্নাতি ব্যক্তির সাক্ষ্য অগ্রহণযোগ্য ? আমি রাসুলুল্লাহ (সা.) কে বলতে শুনেছি যে হাসান ও হুসাইন জান্নাতি যুবকদের সর্দার। তখন ওই ইহুদি বলে উঠল খলিফা আমাকে তার কাজির কাছে নিয়ে এসেছেন অথচ তার নিজের নিযুক্ত কাজিই তার বিরুদ্ধে ফায়সালা করেছে। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি এই দ্বীন ইসলামই সত্য। আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি আল্লাহ ছাড়া সত্য কোনো ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহর রাসুল। আসলে শিরস্ত্রাণটি আপনারই ছিল। হজরত উসমান (রা.) এর সময় খেলাফতে প্রবল বিদ্রোহ দেখা দিলে হজরত আলী গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। হজরত আলী (রা.) মাত্র দশ বছর বয়সে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন। বালকদের মধ্যে তিনিই প্রথম ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। নবী কারিম (সা.)-তার বীরত্বে মুগ্ধ হয়ে ‘আসাদুল্লাহ’ (আল্লাহর সিংহ) উপাধিতে ভূষিত করেন। বিদ্রোহীদের হাতে হজরত উসমান (রা.)-ইন্তেকালের পর সব সম্প্রদায় এবং সমগ্র আরব জাহানের অনুরোধে হজরত আলী (রা.)-খলিফা নির্বাচিত হন। তিনিও সেই ১০ জন সৌভাগ্যশালীদের একজন মহানবী (সা.) যাঁদের বেহেশতের সুসংবাদ প্রদান করেছিলেন। আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ জনগণের অধিকার আদায় দেশ ও জনতার নিরাপত্তা প্রদান এবং একটি ভারসাম্যপূর্ণ শান্তিময় জীবন ব্যবস্থা গঠন ও পরিচালনার জন্যই মূলত রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচন করা হয় এবং এ কাজগুলো আঞ্জাম দেওয়াই রাষ্ট্রপ্রধানের প্রধান দায়িত্ব। খোলাফায়ে রাশেদিনের এই চারজন খলিফার মতো সৎ, ন্যায়পরায়ণ শাসনকার্য প্রতি যুগে প্রতি রাষ্ট্রে প্রয়োজন।
লেখক : ফখরুল ইসলাম নোমানী, ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট
Leave a Reply