ড. কাজী এস এম খসরুল আলম কুদ্দুসী
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর প্রায় দু’মাসের কাছাকাছি সময়ে আমরা রয়েছি। এই প্রেক্ষাপটে ফিরে তাকাই পেছনে। ১৪ জুলাই এক সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনার বক্তব্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শত শত শিক্ষার্থীর প্রতিক্রিয়া আমাদের অনেকের কাছে নতুন এক উপলব্ধির চেয়েও বেশি ছিল। বিশ্বাস করি, এটাই ছিল জুলাই-আগস্টের সফল ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মোড় ঘোরানো ক্ষণ (টার্নিং পয়েন্ট)। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা যে এত স্বতঃস্ফূর্ত ও ক্ষিপ্তভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাবে, তা ধারণার বাইরে ছিল। একজন বোদ্ধা মাত্রই অনুধাবন করতে পারবেন যে, বাংলাদেশের বিভিন্ন সফল আন্দোলনের আঁতুড়ঘর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে শেখ হাসিনার তির্যক বক্তব্যের এমন তীব্র প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে যে দাবানল জ্বলে উঠেছিল, তা মাঝেমধ্যে স্থিমিত হলেও ৫ আগস্ট তার আগুনেই দগ্ধ হয় এতদিনের আওয়ামী লীগের পাহাড়সম সৌধ।
অথচ জাতির মানসের এমন পরিবর্তন ঘুণাক্ষরেও টের পাননি এদেশের আওয়ামী ঘরানার বিভিন্ন শ্রেনী-পেশার মানুষেরা। বলা ভালো বিশেষ করে তাদের ঘরানার বুদ্ধিজীবী-পেশাজীবীরা। তাই তাদের অনেকেই শান্তির পথে না গিয়ে দমন-পীড়নের পরামর্শ দিয়ে আসছিলেন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে। এ ছাড়া ছাত্রলীগের মাধ্যমে ছাত্র আন্দোলনকে দমন করার জন্য আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সরাসরি হুমকি এবং শিক্ষার্থীদের পরবর্তী আন্দোলনে এমনকি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও স্কুলের শিক্ষার্থীরাও অপ্রত্যাশিত সংখ্যায় জড়িয়ে পড়েছিল। তা একেবারেই নতুন একটি প্রপঞ্চ নিয়ে এসেছিল যেÑ নতুন প্রজন্ম, যারা বেশিরভাগই মোবাইল এবং মোবাইল গেমগুলোতে বিভোর থাকে, তারা চারপাশে কী ঘটছে, সে সম্পর্কে মোটেও অসচেতন নয়।
এতে আরও একটি বার্তা পাওয়া গিয়েছিল যে, নতুন প্রজন্ম কটুবাক্য এবং ধমককে হালকাভাবে নিতে প্রস্তুত নয়। এতে এটি স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়, প্রায় সাড়ে ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগ নেতারা এটি বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিলেন, নতুন প্রজন্ম তির্যক মন্তব্যও হজম করতে প্রস্তুত নয়। তাদের আত্মমর্যাদাবোধ প্রখর। বাংলাদেশের জন্য একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা। মুক্তিযোদ্ধারা দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান। তবে দুর্ভাগ্যবশত, প্রায় দেড় দশক ধরে ক্ষমতাসীন দল কর্তৃক ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ এবং ‘মুক্তিযোদ্ধা’ প্রত্যয়গুলোর উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও অতিমাত্রায় ব্যবহার নতুনদের কাছে এসবের আবেদন ব্যাপকভাবে কমিয়ে দিয়েছিল। এর বহুমাত্রিক বিরূপ প্রভাব সমাজে চাপা ক্ষোভ সৃষ্টি করেছিল যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে।
অধিকন্তু, ক্রমাগত ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন দলের লোক এবং ছেলেরা নতুন প্রজন্মকে ব্যাপকভাবে বিরুদ্ধভাবাপন্ন করে তুলেছিল। একজন এইচএসসি পরীক্ষার্থীর উত্তরে বিস্মিত হয়েছিলাম। সে নাকি ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ প্রবন্ধটি লেখেনি কারণ এটি নাকি সস্তা। কেন সে এবং নতুন প্রজন্মের অন্যরা এটি সস্তা মনে করে? কে এটাকে সস্তা করেছিল? সাড়ে ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা দলের জন্য একটা মারাত্মক ব্যর্থতা যে প্রতিনিয়ত ঢোল বাজিয়েও নতুন প্রজন্মের কাছে সত্যিকারের ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ জাগিয়ে তুলতে তারা ব্যর্থ হয়েছিল। এমনটি কাম্য ছিল না। এই বিষয়গুলোকে অন্যভাবে উপস্থাপন করে কিংবা কর্মকান্ডের মধ্যে দিয়ে সর্বজনের করা যেত। কিন্তু এক্ষেত্রে তৎকালীন আওয়ামী লীগের শাসক শ্রেণির ব্যর্থতা প্রকট হয়ে ওঠে।
এটা সত্যিই একটি মর্মন্তুদ ব্যাপার। এটি তাদের শাসনামলের অন্তর্নিহিত ত্রুটিকে পরিষ্কারভাবে উন্মোচিত করেছিল যে, তারা অনুপ্রাণিত করার চেয়ে দমনে বেশি আগ্রহী ছিল। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, প্রবীণ মুক্তিযোদ্ধারা প্রকাশ্যে বলছিলেন যে, তারা কোনো কোটা চান না। তারা শুধু সম্মান চান। কেন তাদের এত সংকোচ করতে হবে? তারা কি এই করুণ অবস্থার জন্য দায়ী? ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ মানে শোষণ, দুর্নীতি ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধযুক্ত দেশ ছাড়া আর কিছুই ছিল না। সত্যি কথা বলতে কী, আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকাকালে শাসনব্যবস্থাকে মোটেও উত্তম বলা যায় না। অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা-দুর্নীতি কোন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছিল এর প্রমাণ ইতোমধ্যে দৃশ্যমান।
শাসনব্যবস্থা ভালো হলে অন্যান্য বিষয় বাদ দিলেও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর একজন পিয়ন কীভাবে ৪০০ কোটি টাকা আয় করতে পারে; যা সাবেক প্রধানমন্ত্রী নিজেই ওই সংবাদ সম্মেলনে প্রকাশ করেছিলেন। এ বিষয়টিকে কিভাবে দেখা উচিত কিংবা মূল্যায়ণ করা যায়? মতিউরগংরা সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে কীভাবে এত অর্থ উপার্জন করতে পারেন? পাবলিক সার্ভিস কমিশনের একজন গাড়ির চালক কীভাবে প্রশ্ন ফাঁস করে এত টাকা আয় করতে পারেন? তার শক্তিশালী সহযোগীরা কোথায়? আসলে এসব ছিল দুর্নীতি হিমশৈলের অগ্রভাগ মাত্র। এ রকম অনেক কেলেঙ্কারি শেখ হাসিনার আমলে প্রকাশ্যে এসেছিল। তবে দুর্নীতিবাজদের সত্যিকার অর্থে আইনের আওতায় না আনার কারণে এবং দুর্নীতির হার মোটেও হ্রাস না পাওয়ার কারণে এগুলোর কোনো প্রভাবই ছিল না।
ক্রমাগত দুর্নীতি ও দুঃশাসনের কারণে দেশ ব্যাপকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের বেশ কিছু নেতা সাধারণ মানুষকে তুচ্ছ করার ব্যাপারটিকে একটি বিনোদন মনে করতেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ সুখশান্তির অনন্তলোকে বসবাস করতেন এবং নিজেদের অজেয় মনে করতেন। কোটা ইস্যুতে আওয়ামী লীগের চরম ব্যর্থতা প্রমাণ করে যে, ৭৫ বছরের একটি রাজনৈতিক দল নতুন প্রজন্মের স্পন্দন অনুভব করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছিল। আওয়ামী লীগ, যে দলটি বাংলার মাটি থেকে উৎসারিত হয়েছিল এবং বঙ্গবন্ধুর দ্বারা নিরলসভাবে উদ্দীপ্ত হয়েছিল, সে দলটি একটি ধনিকগোষ্ঠীর মতো কাজ করে অন্যের মর্যাদা ও আবেগকে আঘাত করতে সিদ্ধহস্ত হয়ে উঠেছিল। এমনটি একদিনে হয়নি এবং তারা মনে করেছিলেন এভাবেই চলবে।
দলটি নতুন প্রজন্মকে উত্তরোত্তর বিরুদ্ধবাদী করে তোলা এবং সাধারণ মানুষকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা অব্যাহত রাখার ফলে ব্যাপক ছাত্র-জনতার আন্দোলন এর ফলে এক অভাবনীয় অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হয় বিগত আগস্ট মাসের ৫ তারিখে। দমন-পীড়নের নীতি এ দলকে নতুন প্রজন্ম থেকে ক্রমাগত দূরে সরিয়ে দেয় এবং আপাত দুর্ভেদ্যতা তাসের ঘরের মতো ভেঙে যায়। দমন-পীড়নের যে মহাযজ্ঞে দলটি মেতে উঠেছিল তাতে এদেশের অনেকেই ঠিকমতো ঘুমাতে পারেনি। এ ছাড়া পাকিস্তানি কায়দায় বাসায় বাসায় গিয়ে মুক্তিসেনা খোঁজার মতো ছাত্র খোঁজার ব্যাপারটি সাধারণ জনগণের মনে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি করেছিল। এর পর থেকে আন্দোলনে সব পেশার মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণও ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। এটি ছিল ৭৫ বছরের পুরোনো একটি দলের আরেকটি চরম দেউলিয়াত্ব।
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার রিট খারিজ করার জন্য বলেছিলেন বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান আইনজীবী। অথচ জনরোষের ওপর ভর করে চাইলেই সরকার এ সুযোগ নিতে পারত। কেননা বিগত আওয়ামী লীগ সরকার আইন বিভাগকে কব্জা করে বিচারব্যবস্থাকে রীতিমতো তামাশায় পরিণত করেছিল, এ অভিযোগ তো নতুন কিছু নয়। ‘আগেই তো ভালো ছিলাম’ বলে যারা আফসোস করছেন তাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়া থেকে রক্ষা করল বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। বর্তমান সরকারের এটি একটি অনন্য নজির হয়ে থাকল। রাজনৈতিক দলগুলো ওই অধ্যায় থেকে কোনো ইতিবাচক শিক্ষা নেবে নাকি পরিবারতন্ত্রের খেয়ালখুশি ও স্বেচ্ছাচারিতার কাছে জিম্মি হয়ে থাকবে, সেটা সময়ই বলে দেবে।
তবে পরিবারতন্ত্রের ঘেরাটোপ থেকে মুক্তি না পেলে কারো কারো ঘুরে দাঁড়ানো অত্যন্ত কঠিন হবে। রাজনীতিও কদাচারের গ্রাসমুক্ত হবে না। পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতির ভয়াবহ ফল কি হতে পারে এমন নজির আমাদের সামনে অনেক আছে। গণতন্ত্রবিহীন উন্নয়নের স্লোগান তো লক্ষ কোটি টাকার দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের কাছে মুখ থুবড়ে পড়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আওয়ামী বয়ান তো শত শত শিশু-কিশোরের লাশের সঙ্গে তারা কবরে পালিয়েছে। অন্তঃসারশূন্য আত্মম্ভরিতা, আস্ফালন ও আগ্রাসী মনোভাব এবং আচরণের কারণে রাজনীতির খাদে পড়ে যাওয়া এ আওয়ামী লীগকে খাদ থেকে তোলার জন্য তো আলাদিনের চেরাগের প্রয়োজন হবে। তবে এমন কিছু হলেও চেরাগ থেকে দৈত্য বের হয়ে যে আবারও মানব বধের পুরোনো খেলায় মেতে উঠবে না, সে বিশ্বাস এ জাতির মনে কীভাবে জাগাবে? রাজনীতি হোক গণমানুষের কলাণের মাধ্যম। মুক্ত হোক কদাচারের ছায়া থেকে।
লেখক: অধ্যাপক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
Leave a Reply