মো. বাদশাহ আলমঃ সীতাকুণ্ড উপজেলার বড় কুমিরার পূর্বপার্শ্বের পাহাড়ের চূড়ায় চট্টগ্রামের মজ্জুবে ছালেক, মাহবুবে খালেক, ফয়ুযাত ও কামালিয়াতের ভাণ্ডার হযরত মওলানা শাহসূফী সৈয়দ কমর আলী শাহ (রহ.) প্রকাশ হযরত ডাল চাল মিয়ার (রহ.) রওজা (কবর)। এ মাজার শরীফটি পাহাড়ের চূড়ায় বিধায় ৩৪১টি সিঁড়ি বেয়ে জিয়ারতের জন্য সেখানে যেতে হয়। প্রতি বৎসর ২৩ বৈশাখ (৬ মে) ওরশ শরীফ অনুষ্ঠিত হয়। হাজার হাজার ভক্ত আশেকান ওরশে অংশগ্রহণ করে থাকেন। অনেকে গরু, মহিষ, ছাগল, হাঁস-মুরগি ইত্যাদির প্রাণীর মাধ্যমে ফাতিহা করেন। তাছাড়া সাধারণত বৃহস্পতিবার, শুক্রবার অথবা সপ্তাহের যে কোনো দিন অসংখ্য ভক্তবৃন্দ জিয়ারতের উদ্দেশ্যে মাজারটিতে গমন করেন। আশেক ভক্তগণের অনেকে সেখানে তবারুক রান্না করে নিয়ে যায় অথবা মাজার প্রাঙ্গনে তৈয়ার করে উপস্থিত ভক্তবৃন্দের মাঝে বিতরণ করে থাকেন।
১৬৬০ সালে মুঘল সম্রাট শাহজাহানের ২য় পুত্র বাংলার সুবেদার শাহজাদা শাহ সুজা সিংহাসন অধিকারের যুদ্ধে তার ভাই আওরঙ্গজেবের কাছে পরাজিত হবার পর সেনাপতি মীর জুমলা পিঁছু হটলে তিনি আরাকানে আশ্রয় নেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন। সে সময় চট্টগ্রামে আসার কোনো স্থলপথ ছিলো না বলে প্রথমে ঢাকা থেকে হাতিয়া এসেছিলো তারা। সুবেদার শাহ সুজার সাথে সফরসঙ্গী হিসাবে স্ত্রী-পুত্র কন্যাসহ ২০০ জন একান্ত অনুগামী, ১৮ জন সেনাপতি, ৩ হাজার জন সৈন্য, ২২ জন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। বহরটি নদীপথে যাত্রা করে কর্ণফুলীর উত্তর পাড়ে কাট্টলী নগরে বা ভাটিয়ারী অথবা কুমিরা নগরে নৌবহর থেকে অবতরণ করে। তৎকালীন সময়ে দেওয়াং পাহাড় ছিলো আরকানীদের রাজধানী ও সমুদ্র বন্দর যার মাধ্যমে বহি:বিশ্বের সাথে ব্যবসা বাণিজ্য চলতো। কর্ণফুলীর উত্তর পাড়ে তেমন উল্লেখযোগ্য উন্নত স্থান ছিলো না বিধায় দেওয়াং বন্দর হয়ে ওঠে দক্ষিণ চট্টগ্রামের স্থলপথ। এ পথেই তিনি আরাকান যাওয়ার মনোস্থির করেছিলেন। কিন্তু আরাকান রাজার শর্ত মোতাবেক অতিঘনিষ্ট আত্বীয় স্বজন এবং অল্প সংখ্যক দেহরক্ষী ছাড়া অন্য কাউকে সঙ্গী করা যাবে না বিধায় অনেকে কর্ণফুলী নদীর উত্তর ও দক্ষিণ পাড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিভিন্ন জায়গায় বসতি স্থাপন করেছিলেন।
ইতিহাসবিদদের মতে, তাদের অনেকে দেওয়াং পাহাড়ের আশেপাশে, বাঁশখালী, চুনতি এবং দক্ষিণ চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে বসতি গড়ে তুলেন। জনশ্রুতি রয়েছে, হযরত শাহসূফী সৈয়দ কমর আলী প্রকাশ হযরত ডাল চাল মিয়া (রহ.) শাহ সুজাকে ওইসময় দাওয়াত করে মেজবান খাইয়েছিলেন। অল্প পরিমান ডাল ও চাল মিশিয়ে একটি হাড়িতে রান্না করে শাহ সুজার সফরসঙ্গীদের আহার করিয়ে অলৌকিকত্ব (কারামত) প্রদর্শন করেছিলেন তিনি। এরপর থেকে হয়রত কমর আলী শাহ; ডাল চাল মিয়া (রহ.) নামে পরিচিতি লাভ করে।
যদিও তিনি অনেককাল আগে থেকে কুমিরা এলাকায় অবস্থান করছিলেন কিন্তু তিনি সেখানকার স্থায়ী বাসিন্দা ছিলেন না। লোকে মুখে শুনা যায়, ধর্ম প্রচারের লক্ষ্যে মধ্যপ্রাচ্য বা আরব দেশ থেকে চট্টগ্রামে আসেন তিনি। পাহাড়ের চূড়ায় নির্জনে বসে সাধনায় রত থাকতেন, মহান আল্লাহর এবাদতে মশগুল ছিলেন এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভ করেছিলেন।
আরও পড়ুন ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যে অলিয়ে কামেল শাহছুফি হযরত মাওলানা বশরত উল্লাহ্ (রহ.)’র বার্ষিক ওরশ সম্পন্ন
হযরত শাহসূফী সৈয়দ কমর আলী প্রকাশ হযরত ডাল চাল মিয়া (রহ.) বড় হাস্তী (সম্মানী) এবং আউলিয়ায়ে কামেলীন ছিলেন। জনশ্রুতি আছে যে তিনি বাঘের পিঠে করে চলাফেরা করতেন। তার ওফাত (মৃত্যু) কত সালে হয়েছে তার কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তৎকাল থেকে আজ অবধি অসংখ্য ভক্তবৃন্দ নিয়মিত জিয়ারত তার রওজা জিয়ারত করেন। তৎকালে পাহাড়ে গভীর জঙ্গল হওয়ার কারণে তার মাজার বাঘ-ভাল্লুক পাহারা দিতো বলে জনশ্রুতি রয়েছে। এজন্য রাত্রি বেলায় কেউ মাজারে যেত না কেবল দিনের বেলায় গিয়ে জিয়ারত করতো। বর্তমানে জিয়ারতকারীরা বিভিন্ন জীব-জন্তু মাজার প্রাঙ্গনে বিচরণ করতে দেখে থাকেন।
কালের পরিক্রমায় মানুষের আসা-যাওয়া বেড়ে যাওয়ায় এসব জীব-জন্তুরা কম বিচরণ করছে। হযরত ডাল চাল মিয়ার (রহ.) অনেক কারামত বা অলৌকিক ঘটনা লোকমুখে শুনা যায়। কথিত আছে একবার কয়েকজন মহিলা জিয়ারতের উদ্দেশ্যে মাজার শরীফে গমন করেছিলেন। কিন্তু তাদের চলাফেরা, আচার আচরণ, কথাবার্তা, পোশাক পরিচ্ছদ শালীন ছিলো না। তখন হঠাৎ তাদের দিকে বিরাট এক অজগর সাপ
ধেয়ে আসে, কিন্তু কোনো রকম ক্ষতি না করে অন্যদিকে চলে যায়, সাথে সাথে মহিলাগণ তাদের ত্রুটি বুঝতে পারে।
হযরত ডাল চাল মিয়া (রহ.) এর মাজার শরীফ আদব ভক্তির দরবার। আশেক ভক্তরা বিশ্বাস করেন, উনি রুহানিয়তভাবে সর্বত্র বিরাজমান। তাই কোনো কিছুর মানত করা, জিয়ারত করা এবং স্বীয় আশা আকাক্সক্ষা পুরণের উদ্দেশ্যে প্রতিদিন শতশত আশেক-ভক্তের আগমন ঘটে। অভিষ্ট লক্ষ্য পূরণ হচ্ছে বিধায় দিন দিন লোক সমাগম বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রতি বৎসর ২৩ বৈশাখ ওরশ অনুষ্ঠিত হয়, এসময় অসংখ্য ভক্তবৃন্দের আগমন ঘটে এবং মাজার প্রাঙ্গন মহামিলন মেলায় পরিণত হয়, পাহাড়ের পাদদেশে বসে মেলা।
বি:দ্র: ইমামে আহলে সুন্নত হাদিয়ে দ্বীনে মিল্লাত হযরত আল্লামা গাজী শেরে বাংলা (রহ.) রচিত দিওয়ান-ই-আজিজ এ উল্লেখ আছে; হযরত শাহসূফী সৈয়দ কমর আলী প্রকাশ হযরত ডাল চাল মিয়া শাহ; (রহ.) সম্পর্কে ফার্সি ভাষায় তিনি লিখেছেন, বাংলা অর্থ “মজ্জুবে ছালিক, মহাস্রষ্টার প্রিয়ভাজন, সৃষ্ঠির মিলন কেন্দ্র যুগের প্রসিদ্ধ বুজুর্গ, আরিফবান্দাদের শিরমনি দুনিয়ার মোহত্যাগী বুজুুর্গদের আদর্শ, কাশফ ও কারামতের ভাণ্ডার। উচু মর্যযদার আসনে আসীন, ফয়ুজাত ও কামালতের ভাণ্ডার চট্টগ্রামের কুমিরা নিবাসী হযরত ডাল চাউল মিয়া আলায়হি রাহমাতু রাব্বিহিল বারীর প্রশংসা।’
লেখক: সাবেক অধ্যক্ষ, তাহের মনজুর কলেজ।
Leave a Reply