#গত ১৪ বছরে প্রাণ গেছে ১ হাজার ৫০২ জনের
#পোর্স্টমর্টেম ছাড়ায় হস্তান্তর হয় মরদেহ
#ক্ষতিপূরণ পায় না অধিকাংশের পরিবার
অনলাইন ডেস্কঃ মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আারবে গিয়ে গড় আয়ুর চেয়ে কমে বয়সে প্রাণ হারিয়েছেন বাংলাদেশের অসংখ্য তরুণ। এক্ষেত্রে মৃত্যুর কারণ ব্যাখ্যা করেনা সোদি কতৃপক্ষ এবং ক্ষতিপূরণ মিলেনা অধিকাংশের। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের একটি প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
গত বছর ২০২৩ সালে বাংলাদেশ থেকে সৌদিতে যাওয়া প্রায় ৫০ হাজার কর্মীর একজন আবদুল জলিল শেখ (৩৫)। সৌদি থেকে উড়োজাহাজে এসেছে তার মরদেহ। কীভাবে তার মৃত্যু হয়েছে? সে বিষয়ে মৃত্যু সনদে উল্লেখ করা তথ্যের বাইরে আর কোনো তথ্য জানেন না তার স্বজনেরা। একটা ছোট কাগজের টুকরা অবশ্য কফিনের সঙ্গে লাগিয়ে রাখা হয়েছে। তাতে লেখা, ‘মৃত্যুর কারণ: স্বাভাবিক। ময়নাতদন্ত: করতে চাওয়া হয়নি। ক্ষতিপূরণ: নেই।’
জলিলের স্ত্রী খাদিজা সৌদি আরবে থাকা স্বামীর সহকর্মীদের কাছ থেকে শুনেছেন, স্ট্রোক (মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ) করে মারা গেছেন তিনি। কিন্তু ময়নাতদন্ত না করে কীভাবে জানা যায় মৃত্যুর কারণ? এজন্য সৌদি আরব থেকে কোনো ক্ষতিপূরণও পাবেন না তার স্বজনেরা!
খাদিজা কী করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। সন্তানদের ভবিষ্যৎ আর স্বামীর পাঁচ লাখ টাকা ঋণের দায়ভার এখন তার কাঁধে। তিনি বলছেন, ‘আমার ভবিষ্যৎ কী, আমি জানি না। কী করব, জানি না।’
বাংলাদেশ থেকে সৌদি যাওয়ার প্রাক্কালে যে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো হয়, সেটি অনুসারে কেবল স্বাস্থ্যবান হলেই দেশটির শ্রমবাজারে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার ছাড়পত্র পায় বাংলাদেশি যুবকেরা।
তথ্যানুসারে, গত ১৪ বছরে (২০০৮-২২) সৌদি আরবে কমপক্ষে ১৩ হাজার ৬৮৫ বাংলাদেশি কর্মী মারা গেছেন। এর মধ্যে ২০২২ সালেই মৃত্যু হয়েছে এক হাজার ৫০২ জনের। প্রতিদিন গড়ে চারজনের বেশি বাংলাদেশি কর্মীর মৃত্যু হয়েছে দেশটিতে।
বাংলাদেশে পুরুষের গড় আয়ু ৭১ বছর। তবে ২০২২ সালে সৌদি আরবে যেসব বাংলাদেশি কর্মীর মৃত্যুকে ‘স্বাভাবিক’ বলে নথিবদ্ধ করা হয়েছে, তাদের গড় বয়স ছিলো ৪৪ বছর। সৌদি কর্তৃপক্ষের দেওয়া নথিপত্রের ভিত্তিতে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত মারা যাওয়া বাংলাদেশিদের ৭৬ শতাংশের ‘স্বাভাবিক’ মৃত্যু হয়েছে বলে উল্লেখ করেছে।
গার্ডিয়ান অনুসন্ধান করে দেখেছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে মৃত্যুর কারণ ব্যাখ্যা করা হয়না। সৌদি কর্তৃপক্ষের দেওয়া মৃত্যু সনদে কখনো ‘স্বাভাবিক কারণ’, কখনো ‘হৃদ্যন্ত্রের সমস্যা’ আবার কখনো ‘শ্বাসতন্ত্রজনিত সমস্যার’ কথা উল্লেখ করা হয়। যার ফলে মৃত্যুর কারণ চিহ্নিত করতে পোস্টমর্টেমের উদ্যোগও নেওয়া হয় না।
আরও পড়ুন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরদারে আগ্রহী বাংলাদেশ ও সৌদি আরব
মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, কঠোর পরিশ্রম ও জীবনযাত্রার পরিস্থিতি, শোষণ, চাপ ও হিটস্ট্রোক এসব মৃত্যুর কারণ হতে পারে। মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনানের তথ্যানুযায়ী, সৌদি আরবে অভিবাসী কর্মীদের প্রতি ভয়ংকর আচরণ করা হয়। ‘স্পনসরশিপ ব্যবস্থার’ কারনে তারা শোষণ ও নির্যাতনের শিকার হয়। কখনো কখনো জোর করে অমানবিক পরিবেশে আটকে রাখা হয়, কিংবা জোর করে দেশে ফেরত পাঠানো হয়।
সৌদি আরবের মানবসম্পদ ও সামাজিক উন্নয়ন বিষয়ক মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, সৌদি আরবের উন্নয়নে অভিবাসী কর্মীদের অবদানকে মূল্যায়ন করে সৌদি কর্তৃপক্ষ। বর্তমানে ২৫ লাখের বেশি বাংলাদেশি দেশটিতে অবস্থান করছে, যাদের নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে সৌদি সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
২০৩৪ সালে ফিফা বিশ্বকাপের আয়োজক হতে যাচ্ছে সৌদি আরব। সেক্ষেত্রে দেশটিতে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া কর্মীর সংখ্যা অতীতের তুলনায় আরও বাড়বে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। কিন্তু দেশটিতে পাকিস্তান, ভারত, মালয়েশিয়া কিংবা ইউরোপ, আমেরিকার নাগরিকদের মৃত্যু হলে যে প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয় সেটা বাংলাদেশিদের ক্ষেত্রে হয় না।
এ প্রসঙ্গে ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির সহযোগী পরিচালক শরিফুল হাসান বলেন, ‘সৌদি আরবে এখনই বাংলাদেশি কর্মীদের মৃত্যুর হার উদ্বেগজনক। ভবিষ্যতে এটা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যেতে পারে। সৌদি কর্তৃপক্ষের নির্দিষ্ট করা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে স্বাস্থ্য পরীক্ষার পরই কেবল বাংলাদেশি কর্মীরা সেদেশে যেতে পারেন। তার মানে শারীরিকভাবে যোগ্য হওয়ার পর তারা সৌদি আরবে যেতে পারছেন। তাহলে সেখানে গিয়ে কেন মারা যাচ্ছেন? এরা যদি ইউরোপ বা আমেরিকার নাগরিক হতেন, তাহলে জবাবদিহি করতে হতো। বাংলাদেশ ও সৌদি কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই বাংলাদেশি কর্মীদের মৃত্যুর কারণ তদন্ত করতে হবে।’
ভাষান্তর: প্রথম আলো
Leave a Reply