আজ ৭ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২২শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

বহুগুণী মানুষ এসএম নূর-উল-আলম


সৈয়দ শিবলী ছাদেক কফিল:

এস এম নূর-উল-আলম- একজন বহুগুণী মানুষের নাম। তাঁর জন্ম চট্টগ্রামের পটিয়া থানার কচুয়াই গ্রামের শেখমোহাম্মদ পাড়ায় ১৯৫১ সালের ১৩ আগস্ট। তাঁর পিতার নাম এস এম আলা মিঞা ও মাতার নাম ইসলাম খাতুন। ৭ ভাই ও ৫ বোন অর্থাৎ ১২ ভাই-বোনের মধ্যে তিনি সর্বজ্যেষ্ঠ। বাবা-মায়ের কাছে প্রারম্ভিক জ্ঞান নিয়ে স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তাঁর শিক্ষা জীবন শুরু হয়। পরে পটিয়া মোহছেনা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন এবং প্রাথমিক বিদ্যালয় শেষ করে ১৯৬৯ সালে কানুনগোপাড়া ডা. বিবি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশ করেন এবং ১৯৭১ সনে পটিয়া কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক ও ১৯৭৩ সালে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।

শৈশব থেকেই এস এম নূর-উল-আলম সংগীতানুরাগী ছিলেন। ছাত্র জীবন থেকে তিনি লোক সংস্কৃতি ও সংগীত ধারায় নানা অনুষঙ্গের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন এ প্রসঙ্গে পূঁথিপাঠ, পল্লিগীতি, ভান্ডারী গান, জারীগান, গাজীর গান, কবিগান ইত্যাদির সাথে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন। উপমহাদেশের খ্যাতিমান কবিয়াল ফনীন্দ্র লাল বড়ুয়া ও এয়াকুব আলীর কবিরলড়াই দেখে কবিগানের প্রবল উদ্দীপ্ত হন। তিনি ছাত্রজীবনে লেখা পড়ার পাশাপাশি তিনি কবিগানে চর্চা করতেন। কবিয়াল সম্রাট রমেশ শীল, কবিয়াল যোগেশ্বর শীল, মানিক শীল, এয়াকুব আলী, বিভুতি রঞ্জন নাথ, মানিক শীল ও মোস্তাক আহমদ প্রমুখের উৎসাহ-উদ্দীপনায় এস এম নূর-উল-আলম একজন লোককবি বা কবিয়াল হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন। তিনি ১৯৮৯ সাল থেকে চট্টগ্রাম বেতারে এবং ২০০০ সাল থেকে বিটিভি- চট্টগ্রাম কেন্দ্র থেকে কবিগান পরিবেশন করেন। পটিয়া, চট্টগ্রাম, ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় কৃতিত্বের সাথে কয়েক হাজার আসরে কবিগান পরিবেশন করে দর্শক শ্রোতার মনজয় করেন। অক্টোবর ১৯৭৯ সালের অক্টোবরে পটিয়া শাহচান্দ আউলিয়া আলিয়া মাদরাসায় সহকারি শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। আমৃত্যু তিনি ওই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ছিলেন। যে প্রতিষ্ঠান থেকে হাজার হাজার মানব সম্পদ তৈরী হয়েছে। অগণন কৃতী শিক্ষার্থীর কৃতী শিক্ষক তিনি।

সাহিত্য চর্চায়ও তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। লেখার গুণ-মান ছিল অতুলনীয়। দৈনিক বীর চট্টগ্রাম মঞ্চ পত্রিকায় “লোকজ সংস্কৃতি” নামক কলামে তিনি নিয়মিত লিখতেন। এখানেও সহস্রাধিক লেখা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়াও ঢাকা-চট্টগ্রামের বহু পত্রিকায় উপসম্পাদকীয় ও গবেষণামূলক লেখা লিখতেন। তাঁর লেখা কয়েকটি বই তাঁর জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয়েছে। তন্মধ্যে “জীবন জিজ্ঞাসা ও শৈল্পিক সংগ্রাম”, “চট্টগ্রামের কবিয়াল ও কবিগান” (বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত) অন্যতম। তাঁর লেখায় জ্ঞান ও কৃতিত্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটত। পারিবারিকভাবে এক গুণীমহিলা রোকেয়া বেগমকে নিয়ে তাঁর সুখ-সাফল্যের সংসার তৈরী হয়। দাম্পত্য জীবনে তাঁদের এক ছেলে ও তিন মেয়ে রয়েছে। প্রথম সন্তান (মেয়ে) নাহিদ সুলতানা (বাংলাদেশ সমরাস্ত্র কারখানা, গাজীপুর সেনানিবাসে উচ্চমান সহকারী হিসাবে কর্মরত), দ্বিতীয় সন্তান (একমাত্র ছেলে) এস এম নাজমুল আলম ফুয়াদ (রাঙ্গুনিয়া উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ে অফিস সহকারি হিসেবে কর্মরত), তৃতীয় সন্তান (মেয়ে) নাদিয়া সুলাতানা পিংকি (ডেন্টিস) এবং চতুর্থ সন্তান নুসরাত সুলতানা বিন্তু (ইসলামী ব্যাংক- পাহাড়তলী, চট্টগ্রাম শাখায় জুনিয়র অফিসার হিসেবে কর্মরত)।

এস এম নূর-উল-আলম নিজের জীবন বাজি রেখে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সশস্ত্র যুদ্ধিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েন। একজন বীর মুক্তিয়োদ্ধা হিসেবেও তিনি সফল। তিনি ছিলেন একাধারে বীর মুক্তিযোদ্ধা, কবিয়াল, গবেষক, শিক্ষক, লেখক, মানবাধিকার ব্যক্তিত্ব ও সমাজ হিতৈষী।

এস এম নূর-উল-আলমের তত্ব, তথ্য, যুক্তি, উপস্থাপন, বাকচাতুর্যতা, বাকপ্রতিভা, পদরচনা, সুর সংযোজন ইত্যাদি যে কাউকে আকৃষ্ট করত। অনুষ্ঠানকে করত দারুণ আকর্ষণীয়। দর্শক-শ্রোতা মুগ্ধ হয়ে পিনপতন নীরবতায় অনুষ্ঠান উপভোগ করতেন। বহুমাত্রিক গুণের অধিকারী এ মহান ব্যক্তি (এস এম নূর-উল-আলম) ২০০৯ সালের ১৯ মার্চ মৃত্যুবরণ করেন।

লেখক: সৈয়দ শিবলী ছাদেক কফিল, সাংবাদিক ও ছড়াকার।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     এই বিভাগের আরও খবর