সৈয়দ শিবলী ছাদেক কফিল:
৯ ডিসেম্বর, সোমবার বেগম রোকেয়া দিবস। এই বেগম রোকেয়া দিবস বাংলাদেশে সরকারিভাবে পালিত একটি জাতীয় দিবস। বাঙালি লেখক, শিক্ষাবিদ, বাংলাদেশে নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার অবদানকে স্মরণ করে তার জন্ম ও মৃত্যুদিন (৯ ডিসেম্বর) "রোকেয়া দিবস" হিসেবে পালন করা হয়। সরকারের উদ্যোগে বাংলাদেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এবং প্রশাসনিক দপ্তরে দিবসটি উদ্যাপন করা হয়। এই দিন বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখা নারীদের বেগম রোকেয়া পদক প্রদান করে। যা "জয়িতা" সম্মাননা হিসেবে পরিচিত।
“জয়িতা” এখানে বিজয়ী নারীর প্রতিকী নাম। জয়িতা উদ্যোগের ক্ষেত্রে নারীর বিজয়ের স্বপ্ন দেখেন। সে বিবেচনায় নারীমুক্তির একটি মহৎ স্বপ্নের নামও জয়িতা। যার প্রতিফলন জয়িতা ফাউন্ডেশনের লোগোতে লক্ষ্যনীয়।
মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর ‘‘জয়িতা’’ শীর্ষক একটি কর্মসূচি পরীক্ষামূলকভাবে বাস্তবায়ন শুরু করে। কর্মসূচিটির মেয়াদ ছিল তিন বছর। কর্মসূচি শুরুর অব্যবহিত পরেই ‘"জয়িতা"কেন্দ্রিক নারীমুক্তির স্বপ্নটিকে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেয়ার জন্য মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর “জয়িতা অন্বেষনে বাংলাদেশ” নামে একটি কার্যক্রমের সূচনা করে। ফলশ্রুতিতে জয়িতার পরিচিতি যেমন দেশব্যাপী ছড়িয়ে পরে, তেমনি জয়িতাকে কেন্দ্র করে দেশের নারীসমাজের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ ও আশাবাদ সঞ্চারিত হয়। প্রাথমিকভাবে ঢাকায় একটি নারীবান্ধব বিপণন পরিকাঠামো গড়ে তুলে তৃণমূলের নারী উদ্যোক্তাদেরকে (যাদের নিজস্ব উদ্যোগে তৈরী করা বিপণনযোগ্য পণ্য রয়েছে) পণ্য প্রদর্শন ও বিপণনের সুযোগ করে দেয়া হয়। কার্যক্রমটির ধারাবাহিকতা অক্ষুন্ন রাখার জন্য পরবর্তিতে “জয়িতা ফাউন্ডেশন” নামে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সহযোগী একটি অলাভজনক ও স্বশাসিত প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়।
জয়িতা ফাউন্ডেশন নিজে ব্যবসা করে না, নারী উদ্যোক্তাগণ এখানে জয়িতার প্লাটফর্মে প্রত্যক্ষভাবে ব্যবসা করেন। জয়িতা ফাউন্ডেশন পরিকাঠামোগত সুবিধাদিসহ নারী উদ্যোক্তাদেরকে ব্যবসা পরিচালনায় ও পণ্য উৎপাদনে প্রয়োজনীয় জ্ঞান—দক্ষতা প্রদান করে। ক্ষেত্রবিশেষে পুঁজি যোগানের ক্ষেত্রে ঋণ সহায়তা প্রদান করে। জয়িতার ব্র্যান্ড ভ্যালু সৃষ্টির লক্ষ্যে বিপণনযোগ্য পণ্য ও সেবার মান নিয়ন্ত্রণসহ প্রচার প্রসারে জয়িতা ফাউন্ডেশন প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদান করে। কোন ব্যক্তি নারী উদ্যোক্তা নয়; সমিতিতে সংগঠিত নারী উদ্যোক্তাগণ উৎপাদিত পণ্য এক ছাদের নীচে সমিতিভিত্তিক আলাদা আলাদা স্টলে জয়িতার ব্র্যান্ডে বাজারজাত করে। জয়িতা ফাউন্ডেশন ব্যবসা অনুকূল ও নারীবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টিতে কাজ করে। নারী উদ্যোক্তা সমিতির সদস্যগণ ব্যবসায় অর্জিত মুনাফা নিজ নিজ অবদান অনুসারে প্রাপ্য হন। অন্যান্য প্রতিযোগীদের উপস্থিতিতে একটি বাজার ব্যবস্থায় নারী উদ্যোক্তাগণ তাদের ব্যবসার সবল—দূর্বল দিক এবং সমস্যা—সম্ভাবনার দিকগুলি অনুধাবন করে তাদের ব্যবসা কার্যকরভাবে পরিচালনায় প্রয়াসী হবেন মর্মে জয়িতা ফাউন্ডেশন আশা করে। নারী উদ্যোক্তাগণ সহায়তার ক্ষেত্রগুলি এ প্রক্রিয়ায় যথাযথভাবে চিহ্নিত করতে সমর্থ হবেন, তদনুসারে উদ্যোক্তাদের চাহিদার নিরিখে জয়িতা ফাউন্ডেশন সে সমস্ত সহায়তা কার্যকর ও সাশ্রয়ী মূল্যে প্রদানে উদ্যোগী হবে। বাজার চাহিদার নিরিখে জয়িতা ফাউন্ডেশন নতুন নতুন ব্যবসার ক্ষেত্র উদ্ভাবন ও উদ্ভাবিত ব্যবসাসমূহে নারীদেরকে সম্পৃক্ত করতে নিরন্তর সচেষ্ট থাকে। আশা করা যায়, এমনিভাবে নারীবান্ধব ব্যবসায় অনুকূল পরিবেশে ব্যবসা করতে করতে কালক্রমে নারী উদ্যোক্তা সমিতিগুলি গড়ে উঠবে। ফলশ্রুতিতে সমিতির সদস্য হিসাবে নারীদের সম্মানজনক জীবিকায়নের ব্যবস্থা হবে। এ প্রক্রিয়ায় দেশের নারীসমাজের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন হবে। নিবিড় পরিচর্যার মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে দেশব্যাপী সফল নারী উদ্যোক্তা গড়ে তুলে তাদের মাধ্যমে একটি আলাদা বাজার ব্যবস্থা (বিপণন নেটওয়ার্ক) ও ভ্যালু চেইন (সাপ্লাই চেইন) গড়ে তোলা জয়িতা ফাউন্ডেশনের মূল উদ্দেশ্য।
অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের মাধ্যমে নারীর সামগ্রিক ক্ষমতায়ন প্রক্রিয়া ত্বরাম্বিত করে লিঙ্গ ন্যায্যতাভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের জন্য একটি অনন্য উদ্যোগ জয়িতা। দেশের সাংবিধানিক অঙ্গীকার হিসাবে লিঙ্গ ন্যায্যতাভিত্তিক সমাজ নির্মাণের চলমান প্রক্রিয়ার পরিপূরক হিসাবে নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে নিরবিচ্ছিন্ন কর্মপ্রয়াস পরিচালনায় সক্ষম একটি কার্যকর বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান হিসাবে জয়িতা ফাউন্ডেশনকে গড়ে তুলতে হবে।
উদ্দেশ্য: সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রের জয়িতাদের চিহ্নিত করে তাদের যথাযথ সম্মান, স্বীকৃতি ও অনুপ্রেরণা প্রদান করে সমাজের আপামর নারীদের মধ্যে আস্থা সৃষ্টি করা এবং তাঁদের জয়িতা হতে অনুপ্রাণিত করা।
নারীর অগ্রযাত্রায় সকল প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করে জয়িতাদের অগ্রসর হওয়ার পথ সুগম করা। ফলশ্রুতিতে জেন্ডার সমতাভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের মাধ্যমে দেশের সুষম উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা।
আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ ও বেগম রোকেয়া দিবসের মূল চেতনার সাথে সংগতি রেখে গতানুগতিকতার উর্ধে উঠে দিবস গুলো যথাযথ ভাবে উদযাপন করা।
সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখায় ‘"জয়িতা" পুরস্কারে ভুষিত হলেন: নারী উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের মূর্ত প্রতীক জয়িতা। কেবল নিজের অদম্য ইচ্ছাকে সম্বল আর চরম প্রতিকুলতাকে জয়করে জয়িতারা তৃণমূল থেকে সবার অলক্ষ্যে সমাজে নিজের জন্য অবস্থান তৈরী করে নিয়েছেন। সরকারের মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর এই জয়িতাদের খুঁজে বের করে। কর্মসূচি বা উদ্যোগটির নাম "জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ"।
জয়িতাদের পাঁচটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়েছেঃ ১। অর্থনৈতিক সাফল্য অর্জনকারী নারী, ২। শিক্ষা ও চাকুরী ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী নার, ৩। সফল জননী নারী, ৪। নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন যে নারী ও ৫। সমাজ উন্নয়নে অবদান রেখেছেন যে নারী।
উপজেলা, জেলা, বিভাগ ও জাতীয়ভাবে জয়িতা বাছাই কর সম্মাননা দেয়া হয়। বাংলাদেশ সরকার প্রতি বছরের ন্যায় এবারেও সমাজে বিভিন্ন পর্যায়ে উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছেন যে সকল নারীদের পুরস্কারে ভুষিত করেছেন।
নির্বাচন বা মনোনয়ন পক্রিয়া:: ক)আবেদনকারীর প্রদত্ত তথ্যের সত্যতা ও বস্তুনিষ্ঠতা সম্পর্কে ইউনিয়ন পৌর/সিটি ওয়ার্ড জয়িতা" বাচাই করে উপজেলায় প্রেরণ করেন। খ) উপজেলা নির্বাহী অফিসারের নেতৃত্বে উপজেলা একটি কমিটি ইউনিয়ন এবং ওয়ার্ড হতে প্রাপ্ত প্রস্তাবগুলোর সত্যতা ও বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে প্রত্যেক ক্যাটাগরীতে একজন করে শ্রেষ্ঠ মহিলার প্রস্তাব জীবনবৃত্তান্ত এবং প্রদত্ত তথ্যের সত্যতা ও বস্তুনিষ্ঠতা সম্পর্কে প্রত্যয়ন ও প্রতিস্বাক্ষরসহ জেলা প্রশাসকের নিকট প্রেরণ করেন। গ)জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে জেলা পর্যায়ে গঠিত একটি কমিটি সকল উপজেলা হতে প্রাপ্ত প্রত্যেক ক্যাটাগরীর প্রস্তাবগুলোর সত্যতা যাচাই করেন। জেলার শ্রেষ্ঠ একজনের (প্রত্যেক ক্যাটাগরীতে) প্রস্তাব সংক্ষিপ্ত জীবন বৃত্তান্ত প্রদত্ত তথ্যের সত্যতা ও বস্তুনিষ্ঠতা সম্পর্কে প্রত্যয়ন ও প্রতিস্বাক্ষরসহ বিভাগীয় কমিশনারের নিকট প্রেরণ করেন। ঘ)বিভাগীয় কমিশনারের নেতৃত্বে গঠিত বিভাগীয় কমিটি সকল জেলা হতে প্রাপ্ত প্রস্তাব যাচাই করে প্রতি ক্যাটাগরীতে ২ জন করে ১০ জন (ঝযড়ৎঃ খরংঃ) শ্রেষ্ঠ জয়িতা নির্বাচন করে এবং তা চূড়ান্ত নির্বাচনের জন্য বিচারকমন্ডলীর নিকট প্রেরণ করেন। ঙ)বিভাগীয় পর্যায়ে ৫ জন শ্রেষ্ঠ জয়িতা নির্বাচনের জন্য বিচারকমন্ডলী বিভাগীয় কমিটি হতে প্রাপ্ত ১০ জন জয়িতার তালিকা হতে প্রতি ক্যাটাগরী থেকে ১জন করে ৫জন জয়িতাকপ সম্মাননা প্রদান করা হবে। আজ (৯ ডিসেম্বর) দেশের সকল জেলা ও উপজেলায় জয়িতা সম্মাননা দেয়া হয়। বিস্তারিত আলোচনা করা বেগম রোকেয়ার জীবনী ও সামাজিক অবদান বিষয়ে।
উল্লেখ্য যে, বেগম রোকেয়া ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর ৫২তম জন্মদিনে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
লেখক (সৈয়দ শিবলী ছাদেক কফিল): সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক।