আবদুর রাজ্জাক, জেলা প্রতিনিধি, কক্সবাজার।। সীমান্ত জনপদের এক আতংকের আরেক নাম হচ্ছে ডাকাত শাহীন। তার অত্যাচারে অতিষ্ঠ সীমান্ত এলাকার লোকজন। তার বাহিনীর ভয়ে কেউ মুখ খোলার সাহস পাচ্ছে না। ফলে বান্দরবানের নাইক্ষংছড়ি ও কক্সবাজারের রামু উপজেলায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে শাহীনুর রহমান শাহীন ওরফে ডাকাত শাহীন। খুন, ডাকাতি, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া, একচ্ছত্রভাবে গরু ও মাদক পাচার নিয়ন্ত্রণ, মতের বিরোধ থাকা লোকজনকে এলাকা ছাড়াসহ এমন কোন অবৈধ কাজ নাই সে করে না।
নাইক্ষংছড়ি ও রামু থানা পুলিশের পিসিপিআরের তথ্য অনুযায়ী একটি দুই নয়। সি,আর ও জি,আর মামলা এবং জিডিসহ প্রায় ১৭ মামলার পলাতক আসাসী ডাকাত শাহীন। তার দুই ডজন মামলার মধ্যে রয়েছে ৯ টি ডাকাতি, ডাকাতি প্রস্তুতি ও ছিনতাই, ৪টি মার্ডার মামলা, দুইটি অস্ত্র মামলা, দুইটি মাদক মামলা এবং বাকীগুলো বিভিন্ন থানায় জিডি হিসেবে রয়েছে।
মামলা গুলো হল-১) বান্দরবান এর নাইক্ষ্যংছড়ি থানার, এফআইআর নং-১০, তারিখ- ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫, জি আর নং-২১, তারিখ- ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫, সময়- ০৭.৪৫ ঘটিকা যারা 198/19(1) the Arms Act, 18/8,, এজাহারে অভিযুক্ত।
২। বান্দরবান এর নাইক্ষ্যংছড়ি থানার, এফআইআর নং-৯, তারিখ- ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫, স্ট্রি আর নং-২০, তারিখ- ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫, সময়- ০৭.৩৫ ঘটিকা থাবা 199/402 The Penal Code, 1860,, এজাহারে অভিযুক্ত।
৩। AVS) কক্সবাজার এর রামু খানার, এফআইআর নং-১৬/১৬, তারিখ- ১৬ জানুয়ারি, ২০১৭, সময়- ২৩৩৫ ধারা-৩৯৯/৪০২ পেনাল কোড ১৮৬০,, এজাহারে অভিযুক্ত।
81 কক্সবাজার এব রামু থানার এফআইআর নং-১৮/১৮, তারিখ- ১৫ জানুয়ারি, ২০১৭, সময়- ২২১৫ ঘটিকা হাবা ১৯৮১) এর ৯(ঘ) ১৯৯০ সালের মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, এজাহারে অভিযুক্ত
৫) কক্সবাজার এর রামু থানার এফআইআর নং-৪/২৬৩, তারিখ- ০৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, সময়- ২০৩০ ধারা-৩৯৯/৪০২ পেনাল কোড-১৮৬০,, এজাহারে অভিযুক্ত।
৬। কক্সবাজার এর রামু থানার, এফআইআর নং-৫/২৬৪, তারিখ- ০৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, সময়- ২২ ৩৫ ধারা ১৯ ১১৮৭৮ সালের অস্ত্র আইন,, এজাহারে অভিযুক্ত।
৭) কক্সবাজার এর রামু ঘানার, এফআইআর নং-৭/২৪২, তারিখ- ০৮ আগস্ট, ২০১৬, সময়- ২৩:৪৫ ধারা-৩৯৯/৪০২ পেনাল কোড-১৮৬০,, এজাহারে অভিযুক্ত।
৮। • কক্সবাজার এর রামু থানার এফআইআর নং-৮/২৪৩, তারিখ- ০৭ আগস্ট, ২০১৬, সময়- ২৩.৫০ ধারা-১১৯৬ ১৮৭৮ সালের অস্ত্র আইন,, এজাহারে অভিযুক্ত।
৯) কক্সবাজার এর রামু থানার, এফআইআর নং-৯/১৭৭, তারিখ- ০৮ জুন, ২০১৬, সময়- ১৮:১৫ ধারা-১৪৩/৪৪৮/৩২৩/৩০৭/৩৮২/৩৯৫/৩৯৭/৩৪ পেনাল কোড-১৮৬০;, এজাহাবে অভিযুক্ত।
১০। কক্সবাজার এর রামু থানার, এফআইআর নং-২/১৫ (রাম), তারিখ-০১ অক্টোবর, ২০১৫, জি আর নং-২৮০/১৫ (রামু), তারিখ- ০১ অক্টোবর, ২০১৫; সময়- ধারা- ৩৯৯/৪০২ পেনাল কোড-১৮৬০;, এজাহারে অভিযুক্ত।
১১। কক্সবাজার এর রামু খানার, এফআইআর নং-১৫, তারিখ- ১৩ মে, ২০১২, জি আর নং-১৩১/১২ (রাম), তারিখ-১৩ মে, ২০১২: সময়- যারা- ৩৯৫/৩৯৭ পেনাল কোড-১৮৬০,, এজাহারে অভিযুক্ত।
১২। কক্সবাজার এর রামু থানার এফআইআর নং-১৯/২২০, তারিখ- ১৯ জুলাই ২০১৬, সময়- ১২ ২০ ধারা- ১৯৬ ১৮৭৮ সালের অস্ত্র আইন, এই মামলায় সে এজাহারে অভিযুক্ত।
১৩। কক্সবাজার এর রামু থানার এফআইআর নং-১৩, তারিখ- ১২ জানুয়ারি, ২০১৫, জি আর নং-১০, তারিখ- ১২ জানুয়ারি ২০১৫, সময়- ধারা- ৩২৬/১৪৩/৪৪৭/৪৪৮/৩২৩/৩২৪/৩০৭/৩৭৯/৩৮০/৫০৬ পেনাল কোড-১৮৬০,, এই মামলায় সে এজাহারে অভিযুক্ত।
১৪। বান্দরবান এর নাইক্ষ্যংছড়ি থানার এফআইআর নং-৬, তারিখ- ১২ মার্চ, ২০১২, জি আর নং-৫৯/১২, তারিখ- ১৩ মার্চ, ২০১২, সময়- ধারা- ১৪৩/৪৪৭/৪৪৮/৩২৩/৩৭৯/৩৮০/৩৮৭ পেনাল কোড ১৮৬০।
১৫। কক্সবাজার এর রামু ধানার এফআইআর নং-২০, তারিখ- ১৭ মার্চ, ২০২৩, জি আর নং-১১৩, তারিখ- ১৭ মার্চ, ২০২৩, সময়- ০০ ৩০ ঘটিকা ধারা 102/34 The Penal Code, 1860,, এই মামলায় সে মামলায় তদন্তে সন্দিগ্ধ আসামি।
১৬। কক্সবাজার এর রামু যানার এফস্পাইসার নং ২১, অনিখ ১৫ জানুয়ারি, ২০২৩, জি আর নং-২১, তারিখ- ১৫ জানুয়ারি ২০২৩, সময়: ০০ ১০ ঘটিকা যারা 143/341/323/325/307/379/506(2)/34 The Penal Code, 1860,, এই মামলায় সে এজাহারে অভিযুক্ত।
১৭। বান্দরবান এর নাইক্ষ্যংছড়ি থানার এফআইআর নং ২. আরিখ ০৮ ডিসেম্বর ২০২৪ খ্রি আর নং ১০৩, তারিখ- ০৮ ডিসেম্বর, ২০২৪, সময় ২০৪০ ঘটিকা যারা 143/114/447/448/323/307/354/435/436/379/380/506/34 The Penal Code, 1860,, এই মামলায় সে এজাহারে অভিযুক্ত আসামী।
শাহীনুর রহমান শাহীন ওরফে ডাকাত শাহীন হচ্ছে মূলত ধনীর ঘরের দুলাল। কক্সবাজারের রামুর গর্জনিয়ার জমিদার হাজী ইসলামের সন্তান সে। বাবা মায়ের স্বপ্ন ছিলো সন্তান বড় হয়ে গর্জনিয়ার হাল ধরবে। হাল ধরেছে ঠিকই, তবে তা সমাজসেবা বা এলাকার মানুষের কল্যাণে নয়। একের পর খুন, ডাকাতি, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া, একচ্ছত্রভাবে গরু, মাদক ও সিগারেট পাচার নিয়ন্ত্রণ, মতের বিরোধ থাকা লোকজনকে এলাকা ছাড়াসহ ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে নাইক্ষংছড়ি ও রামু সীমান্তের জনপদে মধ্যে।
গর্জনিয়ায় পৃথক পুলিশ ফাঁড়ি, বিজিবি ক্যাম্প থাকলেও সেখানে আইন চলে শাহীনের। বলা চলে শাহীনের হাতে স্বাধীন দেশের পরাধীন এক ভূখন্ড রামু ও নাইক্ষ্যংছড়ি। শুনতে বাড়িয়ে বলা মনে হলেও তার অপরাধের চিত্র এতটাই ভয়ংকর যে আধুনিক এই সময়ে যা মানুষের কল্পনাকেও হার মানায়।
শাহীনের হাতে খুনের তালিকাও দীর্ঘ হচ্ছে প্রতিনিয়ত, প্রকাশ্যে করা খুনের তথ্য এলাকাবাসী জানলেও সীমান্তে লোকচক্ষুর আড়ালে তৈরী করা মৃত্যুপুরীর পরিসংখ্যান থেকে যাচ্ছে আড়ালে। যুবক, বৃদ্ধ, নারী এমনকি পেটের অনাগত সন্তানও রেহায় পায়নি শাহীনের হাত থেকে।
এলাকাবাসী সুত্রে জানা যায়, পড়াশোনার জন্য পরিবার থেকে শাহীনকে ঢাকা এবং চট্টগ্রামে পাঠালেও সেদিকে মন না দিয়ে চলে আসেন গ্রামে। অপরাধ জগতে পা দেয় ঈদগড়ের ভয়ংকর ডাকাত কালু, কলিমুল্লাহসহ কয়েকজনের হাত ধরে। শুরুতে ঈদগড় ঈদগাও সড়কে ডাকাতি করতে গিয়ে আটক হয়ে জেলে যায় শাহীন। সেখান থেকেই ঘুরে যায় জীবন। সন্ত্রাসীদের অনুসারী থেকে হয়ে উঠে দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী বাহিনীর প্রধান। ২০১২ সালে সন্ত্রাস জগতে পা রাখা শাহীন এখন সীমান্তের অপরাধ জগতের ঢন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তার এলাকার এক ব্যক্তি জানায়, কয়েকবার ডাকাতি করার পর একটি মামলায় কারাগারে যায় শাহীন। কারাগারে তার সাথে পরিচয় ঘটে মহেশখালীর জলদস্যু, অস্ত্রের কারিগর, চকরিয়ার ডাকাত, উখিয়ার টেকনাফের ইয়াবা কারবারি এবং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সন্ত্রাসীদের সাথে। শাহীন কারাগার থেকে বের হওয়ার পর একে একে জামিনে বের করে আনেন বিভিন্ন এলাকার দাগী অপরাধীদের।
শীর্ষ সন্ত্রাসীদের জামিনে বের করে গড়ে তুলেন অপরাধের বিশাল সাম্রাজ্য। সাবেক সংসদ সদস্য সাইমুম সরওয়ার কমলের ছত্রছায়ায় শুরুতে জমি দখল, ডাকাতি এবং অস্ত্র কারবার চালালে সে। ফলে এমপি সাপোর্টে থাকায় ২০২২ সালের পর থেকে আরো রমরমা হয়ে উঠে তার অপরাধ কর্মকান্ড। গর্জনিয়া সীমান্ত দিয়ে মিয়ানমার থেকে গরু পাচার শুরু হওয়ার পর থেকে শাহীনও নিজেকে আবিস্কার করেন ভিন্নভাবে।
প্রতিনিয়ত সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করা গরু সংগ্রহকারীদের বাঁধা দেওয়া শুরু করেন তিনি। শেষ পর্যন্ত চোরাকারবারিরা শাহীনের নেতৃত্ব মেনে নিয়ে তার মাধ্যমেই দেশে অবৈধভাবে গরু ঢুকানো শুরু করেন।
সুত্রে জানা যায়, ৫শ থেকে ১ হাজার পর্যন্ত গরু অবৈধভাবে প্রতিদিন বাংলাদেশে প্রবেশ করে। প্রতিটি গরু থেকে ৩ হাজার টাকা করে দিতে হয় শাহীনকে। শুধু গরু নয়, সাথে আসে আইস, ইয়াবা, সিগারেটসহ বিভিন্ন অবৈধ পন্য যার মূল নিয়ন্ত্রক হচ্ছে শাহীন। গরু, আইস, ইয়াবা, সিগারেট চোরাচালান বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে সীমান্তের এই এলাকায় বেড়ে যায় খুনোখুনির ঘটনাও। শাহীনের গরু এবং ইয়াবা পাচারে কেউ নূন্যতম বাঁধা হলেও তাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় বলে জানায় এলাকাবাসী। এক এক করে সীমান্তের এই এলাকাগুলোতে গত কয়েক বছরে অন্তত ডজনাধিক খুনের নেতৃত্ব দিয়েছে শাহীন।
শাহীন এবং তার সিন্ডিকেট সদস্যরা গরু পাচারের সময় ফসলের ক্ষেত নষ্ট করে দেয় গর্জনিয়ার থোয়াইংগা কাটা এলাকার জাফর আলমের। পরে জাফর তার ক্ষেতের ওপর দিয়ে গরু পাচারে বাধা দেওয়ায় ২০২৪ সালের ২২ এপ্রিল রাতের আঁধারে হামলা চালিয়ে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করে জাফর আলম ও তার ছেলে সেলিমকে। শুধু গুলি করে ক্ষান্ত হয়নি তারা। দা দিয়ে কুপিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে বাবার ছেলের দেহ।
নিহত জাফরের শালা জানায়, আমার দুলাভাই এবং ভাগিনাকে ডাকাত শাহীন ও তার লোকেরা হত্যা করেছে। এটা নিয়ে মামলাও চলমান আছে। কিন্তু কোন প্রশাসন তারা কিনে রেখেছে তাই কোন সহযোগিতা পাচ্ছি না।
২০২৩ সালের ৩ মার্চ। সেদিন ভয়ংকর হত্যাকান্ডের সাক্ষী হয় গর্জনিয়ার বেলতলীর মানুষ।এলাকাবাসীরা জানায়, নাইক্ষ্যংছড়ির শফিউলাহর ছেলে ইরফানকে ডাকাত শাহীন তার নিজের মোটরসাইকেলে বসিয়ে পেছন থেকে গুলি করে হত্যা করে নৃসংশভাবে। নিহত ইরফানের বাবা জানায়, আমার ছেলেটাকে তারা এভাবে গুলি হত্যা করলো। থানায় মামলাও করেছি কিন্তু বিচারের মুখ দেখে যেতে পারবো কিনা জানিনা। কারন তাদের অনেক টাকা ও ক্ষমতা।
স্থানীয় আবুল কাশেম। ২০২৪ সালের ৮ মে মধ্যরাতে শাহীন তাকে নিজ বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে নারাইম্মাজিরি পাহাড়ে নিয়ে যায় এবং সেখানে তাকে হত্যা করা হয়। নিহত আবুল কাশেমের ভাই মো. শহীদুল্লাহ সাংবাদিকদের জানান, ডাকাত শাহীন গ্রুপের নেতৃত্বে ৪০ জন সন্ত্রাসী বাহিনী ভারী অস্ত্র নিয়ে তার ভাইকে বাড়ি থেকে ডেকে পাহাড়ে নিয়ে যায়। এরপর গুলি করে হত্যা করে। আবুল কাশেম কৃষি কাজের পাশাপাশি ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালাতেন। ডাকাত শাহীনের নেতৃত্বে অবৈধ গরু পাচারে বাধা হয়ে দাঁড়ায় আবুল কাশেম। সে কারণেই তাকে হত্যা করা হয়েছে বলে পরিবারের দাবি।
তাছাড়াও গরু পাচারে বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করায় ২০২৪ সালের ১৬ মার্চ গর্জনিয়ার থিমছড়ির আহমদুর রহমানের ছেলে আবু তালেব নির্মমভাবে হত্যা করে ডাকাত শাহীন।
নিহত আবু তালেবের মামাতো ভাই গিয়াস উদ্দিন জানায়, শাহীন তার দলবল দিয়ে থিমছড়ি বাজারের উত্তর পাশে একটি মানুষকে অপহরন করতে আসে। তখন মানুষজন জড়ো হয় ঐ এলাকায়। আমি আর আমার ফুফাতো ভাই নিহত আবু তালেবও সেখানে যাই এক সাথে। শাহীন আবু তালেবের সাথে পুর্বের শত্রুতার জের ধরে ঐ জায়গায় তাকে পেয়ে লাঠি দিয়ে আমার সামনে পিটিয়ে হত্যা করে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক ব্যক্তি জানায়, শাহীনের কাছে জেলফেরত এবং বিভিন্ন এলাকার পলাতক খুনের আসামী ও সন্ত্রাসীরা আশ্রয় নেন। তেমনই আশ্রয় নিয়েছিলেন কক্সবাজার শহরের আলোচিত মেধাবী ছাত্র তানভীর হত্যা মামলার প্রধান আসামী নেজাম উদ্দিন। ২০২৪ সালের ৩ জুন সীমান্ত থেকে অবৈধভাবে সিগারেটের চালান ঢুকানোর সময় বিজিবির সাথে বন্দুকযুদ্ধ হয় শাহীন গ্রুপের। সেখানে গুলিবিদ্ধ হন নেজাম উদ্দিন। মুমূর্ষু অবস্থায় নেজাম উদ্দিন বার বার তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার আকুতি জানালেও শাহীন প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু নিশ্চিত করেন। পরে নেজামের বাবাকে মোটা অংকের টাকা দিয়ে ম্যানেজ করে বিজিবি, সাংবাদিক এবং নিরীহ লোকজনকে আসামী করে মামলা করান।
খুনের এই ঘটনাগুলো নিয়ে রামু ও নাইক্ষংছড়ি থানায় একাধিক হত্যা মামলা হলেও পুলিশ প্রশাসনের নিরব ভূমিকা পালন করছে বলে জানাই ভুক্তভোগি পরিবারগুলো।
তার বিরুদ্ধে কথা বললে বা তার বিরুদ্ধে গেরে কতটা ভয়ংকর পরিস্থিতি তৈরী হতে পারে তার উৎকৃষ্ট উদাহরণও আছে অনেক।
নাইক্ষংছড়ি উপজেলার বাইশারী ইউনিয়নের নারিজবুনিয়ার মকসুদ ও তার ভাই মুফিজকে হত্যা করার জন্য প্রথম দফা বাড়িতে হামলা চালায় ২০২৪ সালের ১৮ নভেম্বর। শাহীনের নেতৃত্বে টানা তিন ঘণ্টা বাড়ি ভাংচুর ও গুলি চালানো হয়। সেই সময় কোনোরকম প্রাণে বেঁচে যান তারা। শাহীনের সন্দেহ মকসুদ ও মুফিজ দুজনই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সোর্স। তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে শাহীন সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য সরবরাহ করে। ফলে তাদেরকে খুন করার জন্য মত্ত হয়ে উঠেছে শাহীন। প্রথম দফায় ব্যর্থ হয়ে গত ৩ ডিসেম্বর আবারও হামলায় চালায় শাহীন। অন্তত ৩০ জন সশস্ত্র সন্ত্রাসী নিয়ে হামলায় চালায় মকসুদের বাড়িতে।
ভুক্তভোগি মকসুদ জানাই, তাদের প্রত্যেকের হাতে ছিলো বিদেশি অস্ত্র। সেই সময় আমাকে এবং আমার ভাই মুফিজকে না পেয়ে এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে ভয়ংকর পরিস্থিতি তৈরি করে। এক পর্যায়ে আমার বাড়িসহ আশপাশের আরো কয়েকটি বাড়ি পুড়িয়ে দেয় এবং নারীদের মারধর করে শাহীন ও তার সন্ত্রাসী বাহিনী। তলপেটে লাথি ও বন্দুকের আঘাত করে সাড়ে আমার ৮ মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর অনাগত সন্তানকে হত্যা করে তারা। এতকিছু ঘটলেও আমরা ভুক্তভোগী হিসেবে পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোন ইউনিটের সহযোগিতাই পাইনি। কারন তার আগেই শাহীন টাকা দিয়ে সব কিনে ফেলেছে প্রশাসন।
এলাকাবাসীরা জানায়, এরকম শুধু মকসুদের পরিবার নয়, তার বিরুদ্ধে কথা বলে পথের কাটা হয়ে প্রাণ হাতে নিয়ে এলাকা ছাড়া হয়েছে নাইক্ষংছড়ি গর্জনিয়ার ৩০ থেকে ৪০ পরিবারের অন্তত ২০০ মানুষ যারা জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে আর ফিরতে পারছে না এলাকায়।
স্থানীয়দের অভিযোগ, সাবেক সংসদ সদস্য সাইমুম সরওয়ার কমল নিজের অবস্থান শক্ত করার জন্য শাহীন ও তার বাহিনীকে লালনপালন করতেন। শাহীনের মাথার উপর সাবেক এমপি কমল শক্ত ছাতা হয়ে থাকায় দিনকে রাত বানাতে দ্বিধাবোধ করেনি শাহীন। কমলের আর্শিবাদে আওয়ামী লীগে পদও পেয়েছিলো সে। সরকার পতনের পর বর্তমানে স্থানীয় যুবদল নেতা তার এক নিকটাত্মীয়ের সহযোগিতায় বিএনপির প্রভাব খাটিয়ে আরো বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠেছে শাহীন।
নাম প্রকাশ না করা শর্তে তার এক সহযোগী (শাহীনের সাথে এক সময় কাজ করতো) জানাই, শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহীনের সংগ্রহে রয়েছে জার্মানের তৈরী জি- থ্রী রাইফেলসের মতো অত্যাধুনিক ভয়ংকর অস্ত্র। রয়েছে শতাধিক বিদেশি পিস্তল সহ দেশীয় অস্ত্রও। প্রথমবার টেকনাফ থেকে ভারী অস্ত্র সংগ্রহ করার চেষ্টা করেন শাহীন। সুপারির বস্তার ভেতর জি থ্রী রাইফেল আনার সময় পুলিশের হাতে চালানটি ধরা পড়ে যায়। পরে অস্ত্র সংগ্রহের পথ পাল্টান শাহীন। রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী নবী হোসেন গ্রুপের সেকেন্ড ইন কমান্ড নসরুল্লাহ ওরফে নুরুল আমিন এবং আরএসও নেতা ইকবালের সহযোগিতায় সম্পর্ক গড়ে তুলেন আরেক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আরএসওর সাথে। আরএসওর কাছ থেকে একে ৪৭ সংগ্রহ করেন বেশ কয়েকটি। যা ব্যবহার করে বেপরোয়াভাবে মানুষ খুনে মেতে উঠেছে শাহীন। শাহীনের ভারী অস্ত্র সংগ্রহ এবং মিয়ানমারের বিভিন্ন চোরাকারবারি ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সাথে সম্পর্ক স্থাপনের সেতু বন্ধন হিসেবে কাজ করেন নবী হোসেন গ্রুপের সেকেন্ড ইন কমান্ড নসরুল্লাহ। ফলে এপার ওপার দুপারেই সমান আধিপত্য চলছে শাহীনের।
দিনদুপুরে খুন, গরু ও মাদক পাচারের মতো ভয়ংকর অপরাধ করলেও সোনার ডিম পাড়া হাঁস হওয়ায় পুলিশ এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সকল ইউনিটের কাছে শাহীন জামাই আদরে থাকেন বলে জানায় এলাকাবাসী।
কক্সবাজারের রামু উপজেলার দুই বিচ্ছিন্ন ইউনিয়ন গর্জনিয়া ও কচ্ছপিয়াসহ পার্বত্য বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন অবৈধভাবে আসছে শত শত মিয়ানমারের গরু – মহিষ। যাচ্ছে চাল, ডাল, তেল, ওষুধ ও বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সামগ্রী। সীমান্ত লাগোয়া এই জনপদ এখন ইয়াবা, আইস, অস্ত্র ও স্বর্ণ চোরাচালানের নিরাপদ রুট।
আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দেওয়া তথ্যানুযায়ী দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসী, অস্ত্র কারিগর, অস্ত্র প্রশিক্ষকসহ অপরাধী চক্রের বিচরণ ক্ষেত্র এসব পাহাড়ি জনপদ। শুধু তাই নয়, রোহিঙ্গা বিদ্রোহী ও আরাকান আর্মির সঙ্গে সখ্যতা গড়ে পুরো সীমান্ত এলাকাকে অশান্ত করার পাঁয়তারা চালাচ্ছে তারা। এসবের নেতৃত্ব দিচ্ছে রামু কচ্ছপিয়ার সন্ত্রাসী জামসেদ ও গর্জনিয়ার ডাকাত সর্দার শাহীন।
সর্বশেষ ডাকাত শাহীন ও জামসেদ ভাড়ায় আনা নরসিংদীর সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত বিকচাঁন মিয়াকে সোনাইছড়ি জারুলিয়াছড়ি থেকে গত (মঙ্গলবার) ২৫ ফেব্রুয়ারি রাত অনুমান সাড়ে ১২টায় গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ডাকাতির প্রস্তুতিকালে নাইক্ষ্যংছড়ি থানা পুলিশ অস্ত্র ও রাইফেলের গুলিসহ গ্রেপ্তার করে।
এ ব্যাপারে শাহীনুর রহমান শাহীনের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে, সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে সে কথা শুরুর আগে ফোন কেটে দেয়। পরে হোয়াটসএ্যাপে লিখে প্রশ্ন করা হলে সে বলে, ‘আমার এলাকায় এসে লোকজন এর কাছ থেকে জিজ্ঞেস করে দেখেন। সঠিক উত্তর পাবেন। দয়া করে জেনে কথা বলবেন।’
এ ব্যাপারে নাইক্ষংছড়ি থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো:- মাসরুরুল হক জানান, শাহীন ডাকাতকে গ্রেফতারের জন্য ইতিমধ্যে অনেক জায়গায় অভিযোগ চালানো হয়েছে এবং যেকোনো মূল্যে শাহীন ডাকাতকে গ্রেফতার করা হয় বলে তিনি জানান ।
রামু থানার অফিসার ইনচার্জ(ওসি) ইমন কান্তি চৌধুরী বলেন, আমার থানায় তার বেশি কিছু মামলা আছে তবে ওয়ারেন্ট আছে কিনা জেনে দেখতে হবে। তাছাড়াও তাকে ধরার জন্য বিজিবি এবং র্যাবের সাথেও কথা হয়েছে। ইতোমধ্যে তার একটি মামলার চার্জশীটও দিয়েছি।।