আজ ৯ই ফাল্গুন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২২শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

দেশপ্রিয় ব্যারিস্টার যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্ত’র ১৪০তম জন্মবার্ষিকী


সৈয়দ শিবলী ছাদেক কফিল:

২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ শনিবার খ্যাতিমান আইনজীবি বিপ্লবী দেশপ্রিয় যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্তের ১৪০তম জন্মবার্ষিকী। তিনি ছিলেন একজন সফল মানুষের প্রতিকৃতি। চট্টগ্রামের তৎকালীন পটিয়া থানার (বর্তমান চন্দনাইশ উপজেলার) বিপ্লবতীর্থখ্যাত বরমা গ্রামে ১৮৮৫ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম যাত্রামোহন সেনগুপ্ত (জে এম সেন) ও মাতার নাম মেনকা দেবী। তিনি (যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্ত) আইনজীবী ও বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য ছিলেন। যতীন্দ্র মোহন কলকাতার হেয়ার স্কুল থেকে ১৯০২ সালে প্রবেশিকা পাস করেন। এরপর ভর্তি হন কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে। তিনি ১৯০৪ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাউনিং কলেজে ভর্তি হন। ১৯০৮ সালে তিনি স্নাতক ও পরের বছর আইন বিষয়ে ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯০৯ সালে ব্যারিস্টারি পাস করেন। তিনি খেলাধুলা ও সামাজিক কর্মকান্ডে জড়িত ছিলেন এবং ইন্ডিয়ান মজলিসের বিতর্ক সভা ও ইস্ট অ্যান্ড ওয়েস্ট সোসাইটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তখন পরিচিত হন গ্রে পরিবারের সাথে তার পরিচয় ঘটে। এই রাজ পরিবারের কন্যা নেলী গ্রে’র সাথে ১৯০৯ সালের ১ আগস্ট বিয়ে হয়। দেশে ফিরে এসে যতীন্দ্রমোহন চট্টগ্রাম জেলা আদালতে আইন পেশায় নিয়োজিত হন। এক বছর পর তিনি কলকাতা হাইকোর্টে আইন পেশায় যোগ দেন। এসময় কিছুদিন তিনি কলকাতা ল’ কলেজে অধ্যাপনা করেন। ক্রমে কলকাতা হাইকোর্টে তাঁর সুনাম ও প্রভাব বৃদ্ধি পেতে থাকে।

১৯১১ সালে তিনি কংগ্রেসের রাজনীতিতে যোগ দেন এবং ওই বছর চট্টগ্রামের প্রতিনিধি হয়ে ফরিদপুরে অনুষ্ঠিত দলীয় কংগ্রেসে যোগদান করেন। সে সময় পাঞ্জাবে ব্রিটিশ সৈন্যদের নৃশংস হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে সারাদেশে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। চট্টগ্রামেও আন্দোলন তীব্র হয়ে উঠে। যতীন্দ্রমোহন কলকাতা ছেড়ে চট্টগ্রাম চলে আসেন। প্রথমে সিদ্ধান্ত নেন তিনি তিন মাসের জন্য আইন পেশা ত্যাগ করবেন এবং চট্টগ্রামে এসে জনগণের মধ্যে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে তীব্রতর করেন।
অসহযোগ আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে ১৯২১ সালে। এ বছর বার্মা অয়েল কোম্পানি ও আসাম বেঙ্গল রেলওয়েতে ধর্মঘট পরিচালনা করে যতীন্দ্রমোহন গ্রেফতার হন। তাঁর স্ত্রী নেলী সেনগুপ্ত আন্দোলনে যোগ দেন ও গ্রেফতার হয়ে কারাভোগ করেন। ধর্মঘটী শ্রমিক-কর্মচারীদের পরিবারের সদস্যদের ভরণপোষণের জন্য যতীন্দ্রমোহন চল্লিশ হাজার টাকা ঋণ গ্রহণ করেন। তিনি এ সময় ‘দেশপ্রিয়’ উপাধিতে ভূষিত হন। দেশপ্রিয় যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্ত ১৯৩০ সালে ভারতবর্ষ থেকে বার্মাকে বিচ্ছিন্ন করার প্রতিবাদে অনুষ্ঠিত কর্মসূচিতে যোগ দিতে রেঙ্গুন যান। সেখানে জনসমাবেশে বক্তৃতা দেয়ার সময় তিনি পুনরায় গ্রেফতার হন। যতীন্দ্রমোহন ১৯২২ সালে জাতীয় কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য হন। পরবর্তী সময়ে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ স্বরাজ পার্টি প্রতিষ্ঠা করলে যতীন্দ্রমোহন স্বরাজ পার্টিতে যোগ দেন। ১৯২৩ সালে তিনি চট্টগ্রাম থেকে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক পরিষদে সদস্য নির্বাচিত হন। চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যুর পর যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত স্বরাজ পার্টির বিশেষ অধিবেশনে দলের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। একই বছর তিনি বাংলা প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির প্রেসিডেন্ট এবং কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন। পরে ক্রমান্বয়ে পাঁচবার মেয়র নির্বাচিত হন কলকাতা কর্পোরেশনের ।

ব্যারিস্টার যতীন্দ্র মোহন ছিলেন জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সমগ্র বাংলার অবিসংবাদিত নেতা। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ পরিচালিত ফরোয়ার্ড পত্রিকার সাথে তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি এডভান্স নামে একটি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। যা বিপ্লবীদের উৎসাহিত করে।

১৯৩২ সালে যতীন্দ্র মোহন সস্ত্রীক লন্ডন যান। লন্ডন থেকে ফেরার পথে জাহাজ বোম্বে বন্দরে ভিড়তেই ব্রিটিশ পুলিশ ২০ জানুয়ারি তাঁকে গ্রেফতার করে। ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে রাজদ্রোহীতার অভিযোগ এনে কিছুদিন কলকাতায় বন্দী করা হয়। ১৯৩৩ সালের ৫ জুন যতীন্দ্র মোহনকে বন্দী অবস্থায় রাঁচীতে স্থানান্তর করা হয়। দেড় বছর ধরে জেলে থেকে যতীন্দ্র মোহনের স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে। তিনি ১৯৩৩ সালের ২২ জুলাই পরলোক গমন করেন। তিনি রাজনীতি ও সমাজসেবার সাথে শিক্ষা ও খেলাধূলার উন্নতি সাধনে ভূমিকা রাখেন। কলকাতার লোকেরা তাঁর নাম দেয়া হয় ক্রীড়ামোদী মেয়র। আইনজীবী হিসেবে ছিলেন অসামান্য বাগ্মিতার অধিকারী। বিশেষত ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে তাঁর মত বিজ্ঞ ব্যারিস্টার খুব কমই ছিলেন সমগ্র ভারতে।

পিতৃভূমি বরমায় নিজ গ্রামে পিতা কর্তৃক ১৮৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাঁর ব্যাপক অবদান রয়েছে। যাত্রামোহনের মৃত্যুর পর যতীন্দ্রমোহন বরমা ত্রাহি-মেনকা মধ্য ইংরেজি বিদ্যালয়কে উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে উন্নীত করেন। তিনি বিদ্যালয়টি মাধ্যমিক হতে উচ্চ বিদ্যালয়ে রূপান্তর করেন ১৯২৫ সালে। তিনি ও তাঁর পরিবার কর্তৃক ভারত ও বাংলাদেশে বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছেন। তারমধ্যে বরমা ত্রাহিমেনকা উচ্চ বিদ্যালয়, বরমা বিনোদিনী বালিকা বিদ্যাপীঠ (বর্তমানে বিলুপ্ত), পাথরঘাটা জে এম সেন উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, জে এম সেন কিন্ডার গার্টেন, কুসুমকুমারী উচ্চ বিদ্যালয়, চট্টগ্রাম সংস্কৃত কলেজ, ডা. খাস্তগীর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ইত্যাদি।

বরমা গ্রামে পৈত্রিক বাড়ি না থাকলেও বাড়ির সামনে স্থাপিত হয়েছে যাত্রা মোহন সেনগুপ্ত, যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্ত ও নেলী সেনগুপ্তর স্মৃতিস্তম্ভ। দক্ষিণ কলকাতায় স্থাপিত হয়েছে ‘দেশপ্রিয় পার্ক’ ও পার্কের অভ্যন্তরে এই দুই কৃতী ব্যক্তিত্বের যুগল মূর্তি। কলকাতাস্থ চট্টগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে প্রতিবছর দেশপ্রিয় ব্যারিস্টার যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্ত ও নেলী সেনগুপ্তর জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী পালন করা হয়। এছাড়াও কর্মসূচীসমূহ পালন করে গবেষণা সংস্থা ‘মানুষের ঠিকানা’, ‘বরমা ত্রাহি মেনকা উচ্চ বিদ্যালয়’, গুণীজন স্মৃতি সংসদ, চট্টগ্রামস্থ বরমা সমিতি প্রভৃতি সংস্থা। চট্টগ্রামের মানুষ তাকে ‘মুকুটহীন রাজা’ নামে সম্মানিত করেন।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     এই বিভাগের আরও খবর