শেফাইল উদ্দিন
বাংলাদেশ পুলিশের ৩৩ তম হতে ৪০ তম ব্যাচে (২০১২ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ) সাব- ইন্সপেক্টর(নিরস্ত্র) নিয়োগে রাজনৈতিক কৌশল ও আওয়ামী দলীয় কোটায় চাকরি দেওয়ার অনিয়মের অভিযোগ দেশজুড়ে চাউর হয়েছে। বৈষম্যের শিকার ভুক্তভোগীরা হাইকোর্টে রিট আবেদনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানা গেছে।
জানা যায়,লিখিত পরীক্ষা শেষে মৌখিক পরীক্ষা (ভাইভা) নেওয়ার আগেই করা হয় পুলিশ ভেরিফিকেশন। কোটার বরাদ্দ ভেঙে প্রাধান্য পায় গোপালগঞ্জ জেলা। নিয়োগের তালিকা চূড়ান্ত হয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রভাবশালী পুলিশদের একটি সিন্ডিকেটের হাত ধরে।
অনিয়মের সেই শুরু গেল ২০১২ সাল থেকে । এর পর থেকে টানা এক যুগ ধরে এসআই নিয়োগে চলতে থাকে এ সব অনিময় ও দুর্নীতি। ২০২৩ সাল পর্যন্ত এভাবে পুলিশ বাহিনীতে নিয়োগ পেয়েছেন প্রায় ১০ হাজার এসআই।
পুলিশ সদর দপ্তরের সূত্রে জানা গেছে, বিগত সময়ে এসআই নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগ যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। কারও বিরুদ্ধে অনিয়মের মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়ার অভিযোগ প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সরাসরি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। বিএনপি ও সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর দীর্ঘদিনের অভিযোগ ছিল, বিগত আওয়ামী লীগ সরকার পুলিশ বাহিনীকে দলীয়করণের মাধ্যমে রাজনৈতিক কাজে ব্যবহার করেছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের ধরপাকড়, গুম, হত্যা, নির্যাতন, দমনপীড়নে পুলিশকে ব্যবহার করা হয়েছে। এ জন্য দলীয় লোকজনকে পুলিশ বাহিনীতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
অভিযোগ উঠেছে, এসব নিয়োগে লিখিত পরীক্ষার পর উত্তীর্ণদের সাক্ষাৎকার নেওয়ার আগেই পুলিশ ভেরিফিকেশন করা হয়, যাতে সাক্ষাৎকারের আগেই প্রার্থীর এবং তাঁর পরিবারের রাজনৈতিক পরিচয় নিশ্চিত করা হয়েছে। অথচ বিগত সময়ে নিয়োগ চূড়ান্ত করার আগে পুলিশ ভেরিফিকেশন করা হতো না।
এ বিষয়ে সাবেক আইজিপি মুহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন, সাক্ষাৎকারের আগে সাধারণত পুলিশ ভেরিফিকেশন হওয়া উচিত নয়। কারণ, সাক্ষাৎকারের আগে জানা যায় না কাকে নেওয়া হবে। এটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
বেশি নিয়োগপ্রাপ্ত গোপালগঞ্জসহ বৃহত্তর ফরিদপুরের অভিযোগ রয়েছে, এসআই পদে ওই আট ব্যাচের নিয়োগে জেলা কোটা মানা হয়নি। কোটা লঙ্ঘন করে বেশি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর জেলার প্রার্থীদের। অন্য জেলার ক্ষেত্রে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মী এবং দলীয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত পরিবারের সদস্যদের।
বিভিন্ন ব্যাচে ভিন্ন মতাদর্শ ও আওয়ামী দলীয় এমপির ডিও লেটার না পাওয়া নিয়োগ বঞ্চিত এসআই প্রার্থীরা দাবি করেন, আওয়ামী লীগের রাজনীতি না করায় কিংবা পরিবারের কেউ বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় তাঁদের চাকরি দেওয়া হয়নি।
সূত্র বলেছে, এসআই নিয়োগের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের সাবেক এমপিদের সুপারিশও প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ তো আছেই। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের নেতৃত্বে পুলিশ সদর দপ্তরের দু-তিনজন ডিআইজির যোগসাজশে একটি চক্র নিয়োগের তালিকা সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করত।
দেশের বিভিন্ন জেলার নিয়োগ বঞ্চিত এসআই প্রার্থীরা জানায়, গত এক যুগে ৩৩ তম ব্যাচ থেকে ৪০তম ব্যাচে সাব-ইন্সপেক্টর পদের নিয়োগ পরীক্ষায় বিভিন্ন ব্যাচের প্রার্থী হিসেবে অংশগ্রহণ করে। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির শর্ত অনুযায়ী প্রতিটি ধাপ যথাযথভাবে অনুসরণ করে ভাইভা পরীক্ষা পর্যন্ত এগিয়ে যায়,কিন্তু চাকরির চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশের আগেই রাজনৈতিক ভাবে দলীয় লোক বাছাই করার হীন মানসে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ সকল প্রার্থীদের রাজনৈতিক পরিচয় জানতে প্রাক-ভেরিফিকেশন ও অন্যান্য বিষয়ে আগাম তথ্য কালেকশন করাতে আমরা রাজনৈতিক ভিন্ন মতাদর্শী হওয়ায় নিয়োগ বঞ্চিত মনে করছি।কারণ হিসেবে উল্লেখ করতে চাই, চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত হওয়ার আগে কোন প্রার্থীর ভেরিফিকেশন রাজনৈতিক ও অসৎ উদ্দেশ্যে ছাড়া আর কিছু নয়।তাই চূড়ান্ত বাছাইয়ের পূর্বেই রাজনৈতিক কৌশলে প্রাক- ভেরিফিকেশনে তৎকালীন সরকারদলীয় রাজনীতির সাথে জড়িত না থাকার কারণেও ভিন্ন মতাদর্শের লোক হওয়ায় ভাল ফলাফল করেও বঞ্চিত হওয়া প্রার্থীরা নিয়োগ দেয়ার দাবি জানান।
ছাত্রদলের রাজনীতির সাথে জড়িত ময়মনসিংহের তানভির হোসাইন জানান, গত এক যুগে নিয়োগ হওয়া ব্যাচ গুলোতে সাব ইন্সপেক্টর অফ পুলিশ (নিরস্ত্র)/ নিয়োগে প্রিলিমিনারি স্ক্রিনিং এ উত্তীর্ণ হয়ে শারীরিক মাপ ও কাগজপত্র যাচাইকরণ এবং ৭ টি ইভেন্টে যথাযথভাবে উত্তীর্ণ হই। আমরা লিখিত পরীক্ষায় এবং কম্পিউটার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ভাইভা দিয়েছি। লিখিত পরীক্ষার রেজাল্ট প্রকাশের পরপরই আমাদের বাসায় ভেরিফিকেশন আসে, সেই ভেরিফিকেশনে আমরা তৎকালীন সরকারদলীয় রাজনীতির সাথে জড়িত না থাকার কারণে পূর্ণাঙ্গ লিস্ট থেকে আমাদের বাদ দেয়া হয়।অবাক করার মতো বিষয় হল চূড়ান্ত ফলাফলে(ভাইভা পরবর্তী) যাদের নাম আসে তাদের পুনঃ ভেরিফিকেশন ও মেডিকেল আনফিট জনিত কারণে প্রতি ব্যাচ থেকে কম করে হলেও ৫০ থেকে ৮০ জন বাদ যায়। গেল সরকারের সদিচ্ছা থাকলে প্রতি ব্যাচের শূন্যপদ গুলো প্যানেল বা অপেক্ষামান তালিকা করে পূরণ করা যেত।কিন্তু এই শূন্য পদ গুলো শূন্য রেখে আবার নতুন করে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে লোক নিয়োগ দিয়েছে গত এক যুগ।
কক্সবাজারের নিয়োগ বঞ্চিত শাহাদাত কামাল জানান, আমরা যারা দলীয় কারণে নিয়োগ বঞ্চিত, তারা বর্তমান সরকার ও বিএনপি নেতৃবৃন্দের নিকট দাবি জানিয়ে বলতে চাই, আওয়ামী সরকার গত এক যুগে পুলিশের এসআই নিয়োগে দলীয়করণের যে স্বৈরাচারী সিস্টেম চালু করেছিল তা গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত দাবি করছি।
এস,এম রেজাউল করিম নামের এক প্রার্থী জানান, আমি শুনেছি গোয়েন্দা সংস্থার লোককে আমার বিরুদ্ধে এলাকার কিছু লোক আমি ছাত্রদলের রাজনীতির সাথে জড়িত বলে জানান আবার কেউ কেউ আমার দাদা জামাত সংশ্লিষ্ট পরিবার বলে মন্তব্য করে গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধিদের তথ্য দেন বলে অবগত হই।
দলীয়করণের মাধ্যমে আমাদের সাথে অন্যায় করা হয়েছে বলে আমরা মনে করি। আমরা আমাদের ঘামের এবং আমাদের ভাই ও বোনের রক্তের বিনিময়ে এক নতুন বাংলাদেশ পেয়েছি। আমাদের মধ্যে এখনও অনেক আহত অবস্থায় আছে। এত কষ্টের পরও আমরা কোনো বৈষম্য চাই না। আমরা ৩৩ তম থেকে ৪০ তম ব্যাচে সাব-ইন্সপেক্টর নিয়োগের ভাইভা থেকে বাদ পরাদের পুনঃ ভেরিফিকেশন,ফলাফল শীট বিচার-বিশ্লেষণ,(বিশেষ করে যাদের রিটেন মার্কসের তুলনায় ভাইভা মার্কস বেশি তাঁরা কোন দলের কর্মী সমর্থক ছিলো তা পুন:ভেরিফিকেশন করে বের করা) ও নিয়োগ প্রক্রিয়া গুলোতে রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে
কোন অরাজনৈতিক পরিবারের সন্তান বা ভিন্ন মতাদর্শের প্রার্থী হওয়ায় কোন মেধাবী প্রার্থী ঝরে পড়লো কিনা তা তদন্ত স্বাপেক্ষে সকল ব্যাচগুলোতে নিয়োগ পাওয়ার যোগ্য প্রার্থীদের শূন্য পদে নিয়োগ প্রদানে কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।
ঝালকাঠী জেলার বাসিন্দা সৈয়দ আসাদুজ্জামান নূর জানান, বাংলাদেশ পুলিশের সাব- ইন্সপেক্টর ৩৬ তম এবং ৩৭ তম ব্যাচের নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহন করে উভয় ব্যাচে ভাইভা পরীক্ষা দিয়েছে, কিন্তু প্রতিবার লিখিত পরীক্ষায় পাশ করার পর আমার জেলা DSB অফিস থেকে আমার রাজনৈতিক পরিচয় সনাক্ত করার উদ্দেশ্যে তৎকালীন (DI-1) ইন্সপেক্টর মো: হান্নান শেখ এবং (DI-2) ইন্সপেক্টর মো : আলমগীর হোসেন আমার বাড়ি এলাকায় ভেরিফিকেশন করে।যাহা তখন আমার জন্য প্রচন্ড অস্বস্তিকর ছিলো।গত ৫ ই আগষ্ট ছাত্র জনতার গন অভ্যুত্থান এর পরে নতুন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর গত ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ইং তারিখে আমার মত পুলিশ নিয়োগ পরীক্ষায় বৈষম্যের শিকার হওয়া প্রায় ৭০ জন প্রার্থী মিলে মাননীয় সচিব, জন নিরাপত্তা বিভাগ মহোদয় এবং মাননীয় পুলিশ মহাপরিদর্শক মহোদয় বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করি এবং সুশৃঙ্খল ভাবে মানব বন্ধন করি কিন্তু তাহাতে কোন প্রকার প্রতিকার না পেয়ে আমরা দেশের সর্বোচ্চ আদালতে রীট আবেদন করার প্রস্তুতি নিচ্ছি।