শত বছরের পুরোনো কর্ণফুলীর নদীর ওপর নির্মিত কালুরঘাট সেতু। কয়েক দফা সেতুটি মেরামত করে যান ও ট্রেন চলাচলের উপযুক্ত করা হলেও কিছুদিন যেতে না যেতেই আবার শুরু হয় ভোগান্তি।
বোয়ালখালী-পটিয়াসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামের মানুষের একাংশের নগরের সঙ্গে যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম এই সেতু। ১৯৯১ সাল থেকে অনুষ্ঠিত প্রতিটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ওই সংসদীয় আসনের প্রার্থীদের প্রতিশ্রুতির কেন্দ্রবিন্দু সেই কালুরঘাট সেতু নির্মাণ। তবে সেই প্রতিশ্রুতি আলোর মুখ দেখেনি তিন দশকেও।
বহুল প্রতীক্ষিত এ সেতু নির্মাণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ হতে যাচ্ছে ডিসেম্বরে। প্রকল্প পরিচালক নিয়োগের মধ্যদিয়ে নতুন কালুরঘাট সেতু নির্মাণ প্রকল্পের কাজ ধাপে ধাপে এগিয়ে যাবে। আগামী বছরের মে-জুনে প্রকল্পের জন্য কোরিয়ার পরামর্শক নিয়োগ দেওয়া হবে। পরামর্শক নিয়োগের সঙ্গে সঙ্গে জুনে ভূমি অধিগ্রহণের কাজও শুরু হবে বলে জানা গেছে।
রেল ভবন সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পের পরামর্শক নিয়োগের কাজ চলছে। মূল সেতুর পুরো টাকা দক্ষিণ কোরিয়ার। প্রকল্পের ১১ হাজার ৫৬০ কোটি ৭৭ লাখ টাকার মধ্যে ৭ হাজার ১২৫ কোটি ১৫ লাখ টাকা দিচ্ছে দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনৈতিক উন্নয়ন সহযোগিতা তহবিল (ইডিসিএফ) এবং ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট প্রমোশন ফ্যাসিলিটি (ইডিপিএফ)। অবশিষ্ট ৪ হাজার ৪৩৫ কোটি ৬২ লাখ টাকা বাংলাদেশ সরকারের। ভূমি অধিগ্রহণ সরকারি অর্থায়নে হবে।
গত ১৫ নভেম্বর সড়ক পরিবহন ও সেতু এবং রেলপথ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে এক মতবিনিময় সভায় আগামী ফেব্রুয়ারি মাস থেকে কালুরঘাট নতুন সেতুর কাজ শুরু হবে বলে জানিয়েছিলেন।
কালুরঘাট সেতুটি দিয়ে চলাচল এখন ভোগান্তির নাম। সেতুটি দিয়ে ঘণ্টায় ১০ কিলোমিটারের বেশি গতিতে ট্রেন চলতে পারে না। ট্রেন চলাচলের সময় সড়ক পথে যান চলাচল বন্ধ থাকে। অথচ সেতুটি চালু হলে বোয়ালখালীসহ আশপাশের এলাকার লক্ষাধিক মানুষের চট্টগ্রাম নগরের সঙ্গে যোগাযোগ নতুন মাত্রা পাবে। কক্সবাজারের সঙ্গে চট্টগ্রামের যোগাযোগও হবে সহজ।
এর আগে ১৯৮৬-৮৭ সাল ও ২০০৪-০৫ সালে দুই দফায় সেতুটির ব্যাপক সংস্কার করা হয়েছিল। সবশেষ গত বছরের আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সংস্কার কার্যক্রম চালানো হয়। তবে এভাবে বারবার সংস্কার করে ধুঁকে ধুঁকে নয়, কালুরঘাটে নতুন সেতু নির্মাণের মাধ্যমে সহজ যোগাযোগ স্থাপনের সুবিধার দাবিই ছিল ওই এলাকা মানুষের।
ওই সময় বাংলাদেশ সরকার কোরিয়া সরকারের কাছে আর্থিক সহায়তার অনুরোধ জানালে কোরিয়া ঋণ দিতে সম্মত হয়। ২০১৮ সালে ৭ আগষ্ট প্রকল্পটি একনেক সভায় উপস্থাপন করা হয়েছিল। তবে অনুমোদন না দিয়ে রেল ও সড়ক সেতুর জন্য আলাদা নকশা করে পুনরায় উপস্থাপনের সুপারিশ দেয় একনেক।
পরে ২০১৯ সালে বিআইডব্লিউটিএ কর্ণফুলী নদীর ওপর কালুরঘাট পয়েন্টে রেল কাম রোড সেতুর জন্য নেভিগেশন ক্লিয়ারেন্স ১২ দশমিক ২ মিটার করায় কোরিয়া আবার সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করে। নতুন সমীক্ষা অনুযায়ী ডুয়েলগেজ রেল সেতুতে ডাবল লাইন এবং দুই লেন সড়ক পথের সংস্থান রাখা হয়।
প্রস্তাবিত নতুন নকশা অনুযায়ী, কর্ণফুলী নদীর ওপর বিদ্যমান রেলসেতুর ৭০ মিটার উজানে নতুন সেতু নির্মিত হবে। সেতুর দুই পাশে দুই লেন করে চার লেনের সেতু তৈরি করা হবে। এক পাশে চলবে ট্রেন, অন্যপাশে চলবে বাস-ট্রাকসহ সাধারণ যানবাহন। মূল সেতুর দৈর্ঘ্য ৭০০ মিটার। পানি থেকে সেতুর উচ্চতা ১২ দশমিক ২ মিটার। ভায়াডাক্টসহ সেতুর দৈর্ঘ্য হবে প্রায় ছয় কিলোমিটার। সেতু নির্মাণ, ভায়াডাক্ট, অ্যামব্যাঙ্কমেন্ট, সড়ক ভায়াডাক্ট ও রেল ট্র্যাক স্থাপনের কাজগুলো রয়েছে প্রকল্পের আওতায়।
কালুরঘাট নতুন সেতু প্রকল্পের কাজ এগুচ্ছে। আগামী ডিসেম্বর মাসে সেতুর পিডি নিয়োগ হবে। ২০২৫ সালের মে–জুনে প্রকল্পের পরামর্শক নিয়োগ হয়ে যাবে। যেহেতু প্রকল্পটি কোরিয়ান অর্থায়নে বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে, প্রকল্পের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ হবে কোরিয়ার। পরামর্শক নিয়োগের পর তারা ডিটেইল ডিজাইন করবে। একইসঙ্গে ভূমি অধিগ্রহণের কাজও মে–জুন থেকে শুরু হবে। ডিটেইল ডিজাইন করতে এক বছর লাগবে। এরপর টেন্ডার আহ্বান করা হবে। এরপর সেতুর কাজ শুরু হবে।
সেতুর কাজ ২০২৬ সালের মাঝামাঝি শুরু হবে জানিয়ে তিনি বলেন, পরামর্শক নিয়োগের সঙ্গে ভূমি অধিগ্রহণের কাজ শুরু হবে।
কালুরঘাটে কর্ণফুলী নদীর ওপর দিয়ে রেল-কাম সড়ক সেতু নির্মাণ প্রকল্পটি গত ৭ অক্টোবর একনেক সভায় অনুমোদন দেওয়া হয়।
এ প্রকল্প একনেকে পাস হওয়ায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান এ অঞ্চলের বিশিষ্টজনেরা।
তারা বলছেন, বোয়ালখালী-পটিয়াসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামের মানুষের প্রাণের দাবি কালুরঘাটে কর্ণফুলী নদীর ওপর রেল কাম সড়ক সেতু নির্মাণে আশা জাগানিয়া একটি অগ্রগতি হয়েছে। নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার দুই মাসের মধ্যে সেতু নির্মাণ প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন দেওয়ার মধ্য দিয়ে চট্টগ্রামবাসীর দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষা এখন বাস্তবে রূপ পেয়েছে। এ সেতুর বারণে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হওয়ার পাশাপাশি নতুন নতুন শিল্প কারখানা গড়ে উঠবে।
অনলাইন ডেস্ক