অধ্যাপক শাব্বির আহমদ
শরিয়ত ও তরিকত জগতের সম্রাট শাহেনশাহে বাগদাদ সাইয়্যিদুনা আবদুল কাদের জিলানী (রাহ.) এমন এক যুগ সন্ধিক্ষণে (৪৭১-৫৬১ হিজরি) আবির্ভূত হন যখন ভিন্নধর্মী দর্শন মুসলিম শিক্ষা ও চিন্তার জগতকে দারুণভাবে বিভ্রান্তির কালো থাবা বিস্তার করে ফেলছিল। শিরক, কুফর ও বিদআত নবরূপে সঞ্চারিত হচ্ছিল মুসলিম মননে। অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। সেই দুঃসময়ে উম্মতে মুহাম্মদীকে সঠিক পথের দিশা দেবার জন্য তাঁর মত একজন মুজাদ্দিদের, একজন পথ প্রদর্শকের আবির্ভাব খুবই জরুরি হয়ে পড়েছিল। তাঁর মাধ্যমেই ইসলাম পূর্বের অবস্থায় ফিরে এসেছিল। এ জন্যই তিনি ‘মুহিউদ্দীন’ তথা পুনর্জীবিতকারী উপাধিতে ভূষিত। তাঁর শিক্ষা ও আদর্শ যুগে যুগে সঠিক পথের দিশা দিয়ে আসছে। তাঁর অপরিসীম জ্ঞানের পরিধি, ভাষার মাধুর্যতায় মানব সমাজকে ইসলামের আদর্শে অনুপ্রাণিত করেছেন। বায়তুশ শরফ এর প্রতিষ্ঠাতা শাহ মাওলানা মীর মুহাম্মদ আখতার (রাহ.) ছিলেন ত্বরিকায়ে কাদেরীয়ার ইমাম হযরত শায়খ মুহিউদ্দিন আব্দুল কাদের জিলানী রাহ.) এর অধঃস্থন বংশধর।
মসজিদ ভিত্তিক, অরাজনৈতিক আধ্যাত্মিক, মানবকল্যাণমূলক রূহানী মারকজ বায়তুশ শরফের প্রাণপুরুষ কুতুবুল আলম শাহসুফী হযরত মাওলানা মীর মোহাম্মদ আখতর (রাহ.) সাত দশক পূর্বে পীরানে পীর দস্তগীর হযরত মহিউদ্দন আবদুল কাদের জিলানী (রা:) এর স্মরণে কুমিরাঘোনায় প্রবর্তন করেন চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার কুমিরাঘোনা (আখতরাবাদে) মাহফিলে ইছালে সাওয়াব। মাহফিলে ইছালে সাওয়াব বায়তুশ শরফ দরবারের সবচেয়ে শানদার মাহফিল। বায়তুশ শরফের প্রাণ প্রতিষ্ঠাতা হযরত শাহ মাওলানা মীর মুহাম্মদ আখতরুল কাদেরী প্রকাশ হযরত কেবলা (রাহ.) তরীকতের ভক্ত-অনুরক্ত এবং আপামর জনসাধারণের জন্য বার্ষিক ভ্রাতৃ-সম্মিলন স্বরূপ ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ছৈয়্যদুনা গাউছে পাকের (রাহ.) এর ঈসালে সওয়াব মাহফিলের প্রবর্তন করেন।
বার্ষিক মাহফিলে ইছালে সাওয়াব সম্পর্কে একবার বলেছিলেন, 'প্রত্যেক ওলীআল্লাহ্ তাঁর তরিকতের জন্য, তাঁর সময়ের জন্য মোজাদ্দেদ। সময়ের প্রয়োজনে মোজাদ্দেদগণ নিজ তরিকার অনুসারী ও সাধারণ মানুষদের হেদায়েত এবং তাদের মাঝে ধর্মীয় উৎসাহ উদ্দীপনা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে থাকেন- প্রবর্তন করেন অনুষ্ঠান বা মাহফিলসমূহের। সেগুলো অবশ্যই শরীয়তের সীমাবব্ধতার মধ্যেই হয়ে থাকে।' ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে লোহাগাড়ার উপজেলার বড়হাতিয়ায়া ইউনিয়নের কুমিরাঘোনা (আখতারাবাদ) গ্রামে হযরত কেবলা প্রবর্তিত ছৈয়্যদুনা গাউসে পাকের (রাহ.) এর বার্ষিক মাহফিলে ইছালে সাওয়াব এসবের মধ্যে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকরী প্রচেষ্টা। এটি বায়তুশ শরফ দরবারের সবচেয়ে শানদার মাহফিল। তরিকতের দৃষ্টিভঙ্গিতে এটি দরবারের বৃহত্তম ধর্মীয় অনুষ্ঠান। হযরত কেবলার (রাহ.) অনুসৃত নিয়মানুযায়ী এবং তাঁরই পছন্দনীয় স্থান লোহাগাড়া থানার বড় হাতিয়া ইউনিয়নের কুমিরাঘোনা (আখতরাবাদ) গ্রামে এই পবিত্র মাহফিল প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত তখন কুমিরাঘোনা ছিল অজপাড়াগাঁ। গ্রামের অধিকাংশ জনগণ ছিল কৃষক ও দিনমজুর। গাড়ি-ঘোড়ার চলাচল তো দূরের কথা, পায়ে হাঁটার রাস্তা পর্যন্ত সুবিধাজনক ছিলনা। কুমিরাঘোনা মাহফিলে ইছালে সাওয়াব প্রবর্তনের পূর্বে বেশ কয়েক বছর পূর্ব থেকে হযরত কেবলা (রাহ.) তাঁর একান্ত মুরিদ কুমিরাঘোনা নিবাসী মাওলানা আবদুর রশিদ ছাহেব (রাহ.) ও স্থানীয় আরো কিছু লোকের ঐকান্তিক আগ্রহে একাধিক বার কুমিরাঘোনায় তশরিফ নিতে থাকেন। ধীরে ধীরে হযরত কেবলার (রাহঃ) শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের বদৌলতে সে জায়গার মানুষের মাঝে বিরাট ধর্মীয় ও নৈতিক চেতনার সৃষ্টি হয়। শিক্ষা-দীক্ষা, কাজকর্ম ও ব্যবসা বাণিজ্যের একটি বৃহত্তর ক্ষেত্র তাঁদের চোখের সম্মুখে উন্মুক্ত হয়ে যায়।
হযরত কেবলার (রাহ.) ভক্ত-মুরিদদের বহু কষ্ট্য সহ্য করে, অনেক সময়ে হাঁটু পর্যন্ত পানি ও কাদার মধ্য দিয়ে অনেকদূর হেঁটে কুমিরাঘোনা (আখতরাবাদ) মাহফিলে যোগদান করতে হতো। কুমিরাঘোনায় সেই সময়ে যাতায়াতের ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত কষ্টকর। চাটগাঁ থেকে সরাসরি আরাকান রোড দিয়ে গাড়ি চলাচলের কোন ব্যবস্থা তখন ছিলনা। প্রথমে ট্রেন, পরে নৌকা দিয়ে শঙ্খ নদী পার হয়ে সেই আমলের লক্করঝক্কর বাসে অথবা টেক্সিতে করে যেতে হত আমিরাবাদ বা আধুনগর পর্যন্ত। আবার সেখানে থেকে কুমিরাঘোনা পর্যন্ত তিন থেকে সাড়ে তিন মাইল পথে। হাঁটার ভাল রাস্তা পর্যন্ত ছিল না। সেই সময়ে সেখানে দোকানপাট বলতে কিছুই ছিলনা। মানুষের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় জিনিস- পত্র বিশেষ করে শহরবাসীরা যে সব জিনিস প্রাত্যহিক জীবনের ব্যবহারে অভ্যস্ত এমন কোন জিনিস-পত্র পাওয়ার কোন ব্যবস্থা সেখানে ছিল না। যাতায়াতের অসুবিধার কারণে প্রাথমিক পর্যায়ে এ মাহফিলের ব্যবস্থাপনাও বর্তমানের তুলনায় অনেক কঠিন এবং কষ্টকর ছিল। ছৈয়্যদুনা গাউছে পাকের (রাহ.) সুনজর বর্ষিত হওয়ায় বহু বাধাবিঘ্ন সত্ত্বেও এই মাহফিলের কলেবর দিন দিন বৃদ্ধি পেতে থাকে। এই মাহফিলের সার্বিক ব্যবস্থাপনা সুষ্ঠু ও সুন্দর করার জন্য স্থানীয় ও বাইর থেকে আসা হযরত কেবলা (রাহ.) এর মুরিদগণ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। বিশেষ করে কুমিরাঘোনা ও এর আশে- পাশের ভাই-বোনদের শারীরিক পরিশ্রম, বদান্যতা ও একাগ্রতা নিঃসন্দেহে এ মাহফিল উক্ত স্থানে স্থায়ী হওয়ার পেছনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে।
১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে কুমিরাঘোনায় (আখতারাবাদ) এ মাহফিল প্রবর্তনের পূর্বে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জায়গায় এই মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম ইছালে সাওয়াব মাহফিল অনুষ্ঠিত হয় ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে হযরত মাওলানা মীর মুহাম্মদ আখতর (রাহ.) এর নিজ বাসস্থান চট্টগ্রাম শহরের মাদারবাড়িতে। দ্বিতীয়বার ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত হয় রাঙ্গুনিয়ায় তাঁর নানার বাড়িতে। তৃতীয়বার ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে পুনরায় নিজ বাসস্থান মাদারবাড়িতে অনুষ্ঠিত হয়। চতুর্থবার ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে পুনরায় রাঙ্গুনিয়ায় নানা হযরত মাওলানা শাহ আকরম আলী (রাহ.) এর বাড়িতে। পঞ্চমবার ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রামের পাহাড়তলীস্থ হাজী ক্যাম্প মসজিদে৷ এ মসজিদে পর পর তিন বৎসর যথাক্রমে ১৯৪৬, ৪৭, ৪৮ খ্রিস্টাব্দে এ মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। ষষ্ঠবার ১৯৪৯ ও ৫০ খ্রিস্টাব্দে তদানীন্তন সাতকানিয়া থানার, বর্তমানে লোহাগাড়া উপজেলার কলাউজানে এ মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। সপ্তমবার ১৯৫১ ও ৫২ খ্রিস্টাব্দে একই থানার আমিরাবাদে তাঁর এক মুরিদের বাড়িতে এ মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। সবশেষে কুমিরাঘোনায় (আখতরাবাদে) এই পবিত্র মাহফিল আল্লাহর দরবারে কবুল হয়ে যায়। ছৈয়্যদুনা গাউছে পাকের (রাহঃ) পবিত্র সুনজর বর্ষিত হওয়ায় বহু বাধাবিঘ্ন সত্ত্বেও এই মাহফিলের কলেবর দিন দিন বৃদ্ধি পেতে থাকে। যাতায়াতের অসুবিধার কারণে প্রাথমিক পর্যায়ে এ মাহফিলের ব্যবস্থাপনাও বর্তমানের তুলনায় অনেক কঠিন এবং কষ্টকর ছিল।
প্রাথমিক পর্যায়ে স্বল্প পরিসরে আয়োজিত এ মাহফিলের বৈশিষ্ট্যসমূহের বদৌলতে অংশ গ্রহণকারীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় অকল্পনীয়ভাবে। হৃদয়ভরা ভক্তি ও মোহাব্বত নিয়ে বহু দূর-দূরান্ত থেকে আল্লাহর বান্দারা ছুটে আসেন কুমিরাঘোনা মাহ্ফিলে ইছালে ছওয়াবে। হযরত কেবলার (রাহ.) এর অতুলনীয় ব্যক্তিত্ব, অসাধারণ সাংগঠনিক প্রতিভা এবং সুউচ্চ আধ্যাত্মিক ক্ষমতার বাস্তব বহিঃপ্রকাশ ছিল এই মাহফিলে ইছালে ছওয়াব। এ মাহফিলের অনুষ্ঠানসূচী, এর আদব-কায়দা, নিয়ম-শৃঙ্খলা যে কোন মো'মিনের হৃদয় আকৃষ্ট করতে পারে। অনেক পীর-বুজুর্গ, হক্কানী আলেম ওলামা এবং উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তি এ মাহফিল প্রত্যক্ষ করে অভিভূত হয়েছেন। এ মাহফিলের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সকল কাজ শরিয়ত সম্মতভাবে এবং একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে হয়ে থাকে। কোন দুনিয়াবী স্বার্থের লেশমাত্র সেখানে নেই।
১৯৭১ সালে তাঁর ইন্তেকালের পর বায়তুশ শরফের প্রধান রূপকার হাদিয়ে যামান শাহ্সুফী মাওলানা আবদুল জব্বার (রাহ.) এর হাতে মাহফিলে ইছালে সাওয়াব এর সুমাম-সুখ্যাতি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৯৮ সালে তাঁর ইন্তেকালের পর তাঁরই ছায়াসাথী বাহারুল উলুম, বায়তুশ শরফের মরহুম পীর সাহেব শাহসুফি মাওলানা মুহাম্মদ কুতুব উদ্দিন (রাহ.) এর তত্বাবধানে মাহফিলটি পরিচালিত হয়। ২০২০ সালে তাঁর ইন্তেকালের পর বায়তুশ শরফের বর্তমান রাহবার, বিশিষ্ট ইসলামী গবেষক, লেখক আল্লামা শায়খ মুহাম্মদ আবদুল হাই নদভী ম.জি.আ এর হাতেই এই মাহফিল পরিচালনার ভার।
মাহফিলে ইছালে সাওয়াব সাধারনত বৃহস্পতিবার, জুমাবার ও শনিবারকে সামনে রেখেই তারিখ নির্ধারণ করা হয়। আদব, শৃঙ্খলা, নম্রতা, ভদ্রতা, পিনপতন নীরবতার মধ্য দিয়ে কিভাবে বিশাল মাহফিলের আঞ্জাম দেয়া যায় তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ এই মাহফিলে ইছালে সাওয়াব। মাহফিলের দ্বিতীয় দিন জুমার নামাজের পূর্বেই বিশাল প্যান্ডেল ধর্মপ্রাণ মুসল্লিতে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। প্যান্ডেলে জায়গা না পেয়ে অনেক মুসল্লিকে আশেপাশের খোলা জায়গায়, রাস্তার ধারে জুমার নামাজ আদায় করতে দেখা যায়। বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা শত শত স্বেচ্ছাসেবক পিনপতন নীরবতায় মাহফিলের শৃঙ্খলায় নিয়োজিত থাকেন। খাবার পরিবেশনে থাকেনা কোন আশরাফ-আতরাফ বিভাজন। খাবার পরিবেশনে ভিআইপি মেহমান, স্পেশাল মেহমান, সাধারণ মেহমান বলে শ্রেণী বিভাজন এখানকার প্রথা বিরুদ্ধ। সমাজের উঁচু তলার লোকদেরও সর্বসাধারনের সাথে বসে খাবার খাওয়া এখানকার রেওয়াজ। শুক্রবার মাগরিবের নামাজের পর অনুষ্ঠিত হয় তরিকায়ে আলীয়া কাদেরিয়ার শায়খ বায়তুশ শরফের প্রাণপুরুষ কুতুবুল আলম শাহসুফী হযরত মাওলানা মীর মোহাম্মদ আখতর (রাহঃ), বায়তুশ শরফের প্রধান রূপকার হাদিয়ে যামান শাহ্সুফী মাওলানা আবদুল জব্বার (রাহ:) ও বায়তুশ শরফের মরহুম পীর সাহেব বাহরুল উলুম শাহসুফি মাওলানা মুহাম্মদ কুতুব উদ্দিন (রাহ:) এর অনুসৃত পন্থায় বিশেষ যিকির-আযকার এবং রাহবারে বায়তুশ শরফ আল্লামা শায়খ মুহাম্মদ আবদুল হাই নদভী হাফিজাহুল্লাহর বয়ান ও তরিকতের বাইয়াত গ্রহন। শেষরাত্রে তাহাজ্জুদ নামাজের পর তরিকায়ে আলীয়া কাদেরিয়ার জিকির উপস্থিত মুমিন মুসলমানদের জন্য 'গেজায়ে রূহ" তথা আত্মার খোরাক হিসেবে পরিচিত। এসময় ভাবগম্ভীর সমবেতকণ্ঠ "আল্লাহু হাজেরী, আল্লাহু নাজেরী; আল্লাহু শাহেদী, আল্লাহু মুঈন" জিকির উপস্থিত লাখো মুসল্লিকে নিয়ে যায় অতীন্দ্রিয় আধ্যাত্মিকতার জগতে। ৩য় দিবস শনিবার সকাল থেকেই শুরু হয় মাহফিলমুখী জনস্রোত। সকাল ১১টার মধ্যে বিশাল প্যান্ডেল পূর্ণ হয়ে যায়। তিলধারণের ঠাঁই থাকেনা কোথাও। ফলে অসংখ্য মুসল্লিকে রাস্তার ধারে, আশেপাশের বাড়ি ঘরের আঙিনায় বসে পড়ে মোনাজাতে অংশ নিতে হয়। আছরের নামাজের পূর্বে হৃদয় স্পর্শী ও আবেগঘন দীর্ঘ বিশেষ আখেরী মোনাজাতে লাখো মুসল্লির কান্নার রোল ও আমীন, আমীন ধ্বনি আশেপাশে নূরানী আবহ সৃষ্টি করে।
আলেম সমাজের কদরদানি, মতামত ও পরামর্শ গ্রহন বায়তুশ শরফের অন্যতম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। মরহুম হুজুর কেবলা শাহ্সুফী আল্লামা আবদুল জব্বার (রাহ:) মুসলিম সমাজের ঐক্যবদ্ধতার মূলে আলেম সমাজের ঐক্যকে পূর্বশর্ত মনে করতেন। তিনি বারবার বলতেন, 'আলেম সমাজের ঐক্যের ক্ষেত্রে অবশ্যই অহংকার, হিংসা-বিদ্বেষ পরিহার করে অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, ভালোবাসা এবং অন্যের কথা শোনার মতো মানসিকতা তৈরি করতে হবে। একই সঙ্গে অন্যের দোষ-ত্রুটি গোপন রাখতে হবে। তাহলেই হতে পারে আলেম সমাজের ঐক্য।' তিনি আরো বলতেন, 'মতপার্থক্য থাকতেই পারে, কিন্তু ইসলামের মৌলিক বিষয়ে আনুগত্য ও আস্থাশীল থাকলে ক্ষুদ্র মতপার্থক্য ঐক্যের পথে বাধার প্রাচীর হতে পারেনা। তাই তিনি গঠন করেছিলেন 'মজলিসুল ওলামা বাংলাদেশ'। মতানৈক্যের মাঝে মতৈক্য প্রতিষ্ঠাই ছিল মজলিসুল ওলামা গঠনের মূল লক্ষ্য। প্রতিবছর আখেরী মোনাজাতের পরদিন ওলামা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে আসলেও আলেম-ওলামাদের নানা ব্যস্থতার কারনে বর্তমান রাহবার আল্লামা শায়খ মোহাম্মদ আবদুল হাই নদভী (ম.জি.আ) ২০২১ থেকে ওলামা সম্মেলন মাহফিলের তৃতীয়দিন বাদ মাগরিব পুনঃনির্ধারন করেন। ইছালে সাওয়াব ময়দানে আয়োজিত ওলামা সম্মেলনে প্রচুর ওলামা মাশায়েখের অংশগ্রহণ বরাবরই চোখে পড়ার মতো।
ইছালে সাওয়াব মাহফিলের দুইদিন পর পূর্ব থেকে চলে আসা প্রথানুযায়ী পর্দা সহকারে পৃথক পৃথকভাবে মহিলা সমাবেশ, তরিকতের সবকদান ও বাইয়াত গ্রহন অনুষ্ঠানও সম্পন্ন হয় অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে। হাজার মহিলা অংশগ্রহণ করেন এবং সবার জন্য তাবরুকের ব্যবস্থা করা হয়। মহিলা সমাবেশে রাহবারে বায়তুশ শরফ আল্লামা শায়খ মুহাম্মদ আবদুল হাই নদভী (ম.জি.আ) ইসলামে নারী জাতির সম্মান, জ্ঞানার্জনের অপরিহার্যতা, পর্দার গুরুত্ব এবং সাংসারিক জীবনকে সুখময় করে গড়ে তোলা, সর্বোপরি একটি সুন্দর ও সুখী সমাজ বিনির্মাণে আদর্শ মায়ের ভূমিকার কথা তুলে ধরে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বক্তব্য রাখেন। আল্লাহ পাক, কুমিরাঘোনাস্থ (আখতরাবাদ) বায়তুশ শরফের এই মাহফিলে ইছালে সাওয়াবকে কেয়ামত পর্যন্ত জারি রাখুন- আমীন।