আজ ৫ই চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৯শে মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

এস এম নূর-উল-আলম


সৈয়দ শিবলী ছাদেক কফিল:

কবিয়াল বা কবিগানের জগতে এক বিখ্যাত নাম “এস এম নূর-উল-আলম”। তিনি একজন বহুগুণী মানুষ। তাঁর জন্ম চট্টগ্রামের পটিয়া থানার কচুয়াই গ্রামের শেখমোহাম্মদ পাড়ায় ১৯৫১ সালের ১৩ আগস্ট। তাঁর পিতার নাম এস এম আলা মিঞা ও মাতার নাম ইসলাম খাতুন। ৭ ভাই ও ৫ বোন অর্থাৎ ১২ ভাই-বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। পারিবারিক দায়িত্ব পালনে তিনি ছিলেন কর্মতৎপর।

জীবনের প্রারম্ভিক শিক্ষা নেন পিতা-মাতার কাছে। এরপর স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তাঁর শিক্ষা জীবন শুরু হয়। পরে পটিয়া মোহছেনা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন এবং প্রাথমিক বিদ্যালয় শেষ করে ১৯৬৯ সালে কানুনগোপাড়া ডা. বি.বি. উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশ করেন এবং পটিয়া কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক ১৯৭১ সনে এবং স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন ১৯৭৩ সালে।

কিশোরকাল থেকে এস এম নূর-উল-আলম সংগীতানুরাগী ছিলেন। ছাত্র জীবন থেকে তিনি লোক সংস্কৃতি ও সংগীত ধারায় নানা অনুষঙ্গের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন এ প্রসঙ্গে পুঁথিপাঠ, পল্লিগীতি, ভান্ডারী গান, জারীগান, গাজীর গান, কবিগান ইত্যাদির সাথে সম্পৃক্ত হয়ে হয়ে পড়েন। পড়েন। উপমহাদেশের খ্যাতিমান কবিয়াল ফনীন্দ্র লাল বড়ুয়া ও এয়াকুব আলীর কবিরলড়াই দেখে কবিগানের প্রবল উদ্দীপ্ত হন। তিনি ছাত্রজীবনে লেখা পড়ার পাশাপাশি তিনি কবিগানে চর্চা করতেন। কবিয়াল সম্রাট রমেশ শীল, কবিয়াল যোগেশ্বর শীল, মানিক শীল, এয়াকুব আলী, বিভূতি রঞ্জন নাথ, মানিক শীল ও মোস্তাক আহমদ প্রমুখের উৎসাহ-উদ্দীপনায় একজন লোককবি বা কবিয়াল হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন তিনি।

খ্রিস্টাব্দ ১৯৮৯ সাল থেকে চট্টগ্রাম বেতারে এবং ২০০০ সাল থেকে বিটিভি- চট্টগ্রাম কেন্দ্র থেকে কবিগান পরিবেশন করেন। পটিয়া, চট্টগ্রাম, ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় কৃতিত্বের সাথে কয়েক হাজার আসরে কবিগান পরিবেশন করে দর্শক শ্রোতার কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেন। ১৯৭৯ সালের অক্টোবরে পটিয়া শাহচান্দ আউলিয়া আলিয়া মাদরাসায় সহকারি শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। আমৃত্যু তিনি ওই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ছিলেন। যে প্রতিষ্ঠান থেকে হাজার হাজার মানব সম্পদ তৈরী হয়েছে। অগণিত কৃতী শিক্ষার্থীর প্রিয় শিক্ষক স্বীকৃতি লাভ করেন।

লেখালেখি বা সাহিত্য চর্চায়ও তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। লেখার গুণ-মান ছিল অতুলনীয়। দৈনিক বীর চট্টগ্রাম মঞ্চ পত্রিকায় লোকজ সংস্কৃতিচ নামক কলামে তিনি নিয়মিত লিখতেন। এখানেও সহস্রাধিক লেখা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়াও ঢাকা-চট্টগ্রামের বহু পত্রিকায় উপসম্পাদকীয় ও গবেষণামূলক লেখা লিখতেন। লেখায় জ্ঞান ও কৃতিত্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটত। তাঁর লেখা কয়েকটি বই তাঁর জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয়েছে। তন্মধ্যে ‘জীবন জিজ্ঞাসা ও শৈল্পিক সংগ্রাম’, ‘চট্টগ্রামের কবিয়াল ও কবিগান’ (বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত) অন্যতম। এক গুণীমহিলা রোকেয়া বেগমকে নিয়ে তাঁর সুখ-সাফল্যের সংসার তৈরী হয়। দাম্পত্য জীবনে তাঁদের এক ছেলে ও তিন মেয়ে রয়েছে। প্রথম সন্তান (মেয়ে) নাহিদ সুলতানা (বাংলাদেশ সমরাস্ত্র কারখানা, গাজীপুর সেনানিবাসে উচ্চমান সহকারী হিসাবে কর্মরত), দ্বিতীয় সন্তান (একমাত্র ছেলে) এস এম নাজমুল আলম ফুয়াদ (উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ে অফিস সহকারি হিসেবে কর্মরত), তৃতীয় সন্তান (মেয়ে) নাদিয়া সুলাতানা পিংকি (ডেন্টিস) এবং চতুর্থ সন্তান নুসরাত সুলতানা বিন্তু (ইসলামী ব্যাংকে অফিসার হিসেবে কর্মরত)।

বরেণ্য কবিয়াল এস এম নূর-উল-আলম নিজের জীবন বাজি রেখে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য মহান মুদ্ধিযুদ্ধে অংশ নেন। তিনি ছিলেন একাধারে মানবাধিকার ব্যক্তিত্ব ও সমাজ হিতৈষী, কবিয়াল, গবেষক, শিক্ষক ও লেখক।
তাঁর তত্ব, তথ্য, যুক্তি, উপস্থাপন, বাকচাতুর্যতা, বাকপ্রতিভা, পদরচনা, সুর সংযোজন ইত্যাদি যে কাউকে আকৃষ্ট করত। অনুষ্ঠানকে করত দারুণ আকর্ষণীয়। অনুষ্ঠানসমুহে মুগ্ধ দর্শক-শ্রোতার মাঝে পিনপতন নীরবতা বিরাজ করত।
প্রাতঃস্মরণীয় বহুমাত্রিক গুণের অধিকারী এ মহান ব্যক্তি (এস এম নূর-উল-আলম) ২০০৯ সালের ১৯ মার্চ মত্যুবরণ করেন।

লেখক (সৈয়দ শিবলী ছাদেক কফিল): সাংবাদিক ও ছড়াকার।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     এই বিভাগের আরও খবর