শ.ম.গফুর: উখিয়া উপজেলার রাজাপালং ইউনিয়নের কুতুপালং পশ্চিমপাড়ায় জমি নিয়ে গত কয়েক বছর ধরে বিরোধ চলে আসছিল।উভয় পক্ষ সন্তোষজনক কোন সুরাহায় পৌছাতে পারেনি।গত বছর ৫ আগষ্টের পরে তা তুমুল হয়ে উঠে।সর্বশেষ গত ৬ এপ্রিল রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে রুপ নেয়।ওইদিন উভয়পক্ষের ৩ জন নিহত হয়।আহত হন আরোও ৫ জন।অবশেষে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন রওশন আরা (৩৮)। তিনি সংঘর্ষে নিহত আব্দুল মান্নানের বড় বোন। এ নিয়ে এক চিলতে জমি বিরোধে কেড়ে নিলো একে একে ৪টি তাজা প্রাণ।চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে মঙ্গলবার রাত ১টা ১৫ মিনিটের সময় শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন রওশন আরা। মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেন তার স্বামী মো. শাহজাহান। তিনি জানান, ঘটনার দিনই স্ত্রী’কে গুরুতর আহতাবস্থায় কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রামে নেওয়া হয়। সেখানে আইসিইউতে দুইদিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়েন, অবশেষে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান রওশন আরা।পরিবার সূত্রে জানা গেছে, রওশন আরার শরীরে একাধিক স্থানে ছুরি ও কুড়াল দিয়ে আঘাত করা হয়েছিল। মাথায় গুরুতর আঘাতের কাটা চিহ্ন ছিল।
এর আগে গত ৬ এপ্রিল সকালে জমিজমা নিয়ে আপন চাচাতো ভাইদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায় একই পরিবারের সদস্যরা। ঘটনার দিনই আগে নিহত হন শাহিনা আক্তার(৩৬)।এরপর মাওলানা আব্দুল্লাহ আল মামুন (৩৮), মো. আব্দুল মান্নান (৩৬) এবং রওশন আরার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মৃতের সংখ্যা গিয়ে দাড়ালো ৪জনে।নিহত মাওলানা মামুন ছিলেন কুতুপালং বাজার জামে মসজিদের খতিব এবং জামায়াতে ইসলামির স্থানীয় নেতা। একদিকে ধর্মীয় নেতৃত্ব, অন্যদিকে রক্তের সম্পর্ক,সব কিছুই ম্লান হয়ে গেছে হিংসা আর সহিংসতার ক্ষিপ্ততা আর তীব্রতায়।
স্থানীয়রা জানান, আব্দুল মান্নানের পৈতৃক ভিটির অধিকাংশ জায়গা সবল চাচাতো ভাই আবুল ফজল গংরা কিনে নেন।সবশেষে কয়েক বছর আগে পৈতৃকসূত্রে পাওয়া ২০ কড়া জমি বিক্রি করে দেন একই এলাকার প্রতিবেশী সরওয়ার’কে। সেই জমি বুঝিয়ে দিতে গেলে বাধা দেন মাওলানা আবদুল্লাহ আল মামুনের পরিবার। শুরু হয় বাকবিতণ্ডা, এরপরই রূপ নেয় নারকীয় সংঘর্ষে।
এদিকে এই মর্মান্তিক ঘটনার পর এলাকায় নেমে এসেছে শোকের ছায়া। শুধু নিহতদের পরিবার নয়, পুরো কুতুপালং পশ্চিমপাড়া তথা উখিয়ার মানুষ মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। অনেকেই এই ঘটনায় শুধু পারিবারিক দ্বন্দ্ব নয়, সামাজিক ও প্রশাসনিক ব্যর্থতাকেও দায়ী করছেন।
কুতুপালং উচ্চ বিদ্যালয়ের এক শিক্ষক বলেন, এটা নিছক জমির বিরোধ নয়, এটি আমাদের সামাজিক অবক্ষয়ের প্রতিফলন। আজ ভাই ভাইকে কুপিয়ে মারছে। আমরা কী ধরনের সমাজে বাস করছি? আগে পরিবারে যেকোনো বিরোধ বসে মীমাংসা করা হতো, এখন সেটা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে গড়াচ্ছে।
স্থানীয় সমাজকর্মী সু-শাসনের জন্য নাগরিক(সুজন) উখিয়ার আহবায়ক আলহাজ্ব নুর মোহাম্মদ শিকদার বলেন,অত্যন্ত বেদনার। বলতে গেলে একই পরিবারের ৪জনের মৃত্যু কোনো সাধারণ ঘটনা নয়। এখানে নারীরাও নিহত হয়েছেন, ছুরি–কুড়াল দিয়ে এভাবে কুপিয়ে হত্যার ঘটনা প্রমাণ করে, আমাদের সহিংসতা কতটা নিষ্ঠুর হয়ে উঠেছে। এর দায় শুধু পরিবারের নয়,স্থানীয়ভাবে যারা সালিশ বা মধ্যস্থতা করতে পারতেন, তারা কোথায় ছিলেন?।এই ঘটনায় স্থানীয় প্রশাসন দায় এড়াতে পারেন না।ঘটনার আগেও আবদুল মান্নান পুলিশী সহযোগিতা চেয়েছিলেন,কিন্তু পুলিশী গাফিলতির কারণে এমন নির্মম ঘটনা ঘটেছে।৪ জন নিহতের ঘটনায় মামলা হয়েছে।তাতে এক পক্ষ নিরীহ লোকজন’কে আসামী করেছে,তা দু:খজনক।
স্থানীয় যুবক রিদুয়ান ও আবু তাহের আজাদ বলেন,এই জমি নিয়ে বিরোধের কথা শুনেছি। বিষয়টা স্থানীয়ভাবে সমাধান করতে পারতো। কিন্তু দেরি হয়ে গেছে। আমরা মনে করি, যাদের গাফিলতিতে বিষয়টা এতদূর গড়িয়েছে, তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা দরকার।
কুতুপালং বাজার সমিতির সভাপতি জানে আলম বলেন, এই ঘটনায় এলাকার ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উচিত দ্রুত দোষীদের গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা। একইসঙ্গে ভবিষ্যতে যেন এমন ঘটনা না ঘটে, সে জন্য প্রশাসনের পাশাপাশি সমাজের সবার সতর্ক হওয়া জরুরি বলে মনে করেন তিনি।
উখিয়া উপজেলার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান রাসেল চৌধুরী বলেন, জমিটা বহুদিন ধরেই বিরোধের কেন্দ্র ছিল। মাঝেমধ্যে কথাকাটাকাটি হতো, কিন্তু কেউ ভাবেনি যে বিষয়টা এভাবে রক্তগঙ্গায় গড়াবে। ওরা তো আপন ভাই-বোন।এইভাবে একজন আরেকজনকে খুন করতে পারে, সেটা ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে। এটা খুবই দু:খজনক।
উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা(ওসি) মোহাম্মদ আরিফ হোসাইন চৌধুরী বলেন,কুতুপালংয়ে জমি বিরোধ নিয়ে সংঘটিতে ঘটনায় মোট ৪ জন নিহত হয়েছে।এ সংক্রান্তে পৃথক দু’টি মামলা হয়েছে।এতে দুই মামলায় ১৭ জনের নাম উল্লেখ ও আরো ১২/১৩ জন অজ্ঞাত আসামী রয়েছে।জড়িতদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে।
উল্লেখ্য, এ ঘটনায় উখিয়া থানায় পৃথক দুটি হত্যা মামলা দায়ের করেছে ভুক্তভোগী পরিবারগুলো। এক মুঠো মাটির জন্য, রক্তে রঞ্জিত হলো একটি পরিবার। ভাইয়ের হাতে ভাই, বোনের রক্তে লেখা হলো পারিবারিক বিষাদের এক নির্মম অধ্যায়। রেখে যাওয়া তাদের প্রজন্ম ধুকে-ধুকে মানসিক বিকৃত সমাজে বেড়ে উঠবে।আপনজন হারা স্বজনগুলো ভরণ পোষণ পেলেও বাবা-মায়ের স্নেহ বঞ্চিত হতে হলো।এমন নির্দয়া মানুষের নির্দয়া ঘটনার পুণরাবৃত্তি না হোক এমনটাই প্রত্যাশা সকলের।
Leave a Reply