নোয়ল গোনছালবেছ:
খ্রিস্টাব্দ ৩৫৪ হতে শুরু করে (চতুর্থ শতাব্দীর মাঝামাঝি একটি রোমান পঞ্জিকায় পাওয়া যায়) প্রতিবছর গোটা বিশ্বের খ্রীষ্টবিশ্বাসীগণ ২৫ ডিসেম্বর যীশুখ্রিস্টের জন্মতিথি পালন করে আসছে। যীশুখ্রিষ্টকে খ্রিষ্টবিশ্বাসীগণ মানবজাতির নিকট ঈশ্বরের ত্রাণকর্তা বা নাজাতদাতা বলে বিশ্বাস করেন তাই তার জন্মদিন পালন তাঁদরে কাছে গুরুত্বপূর্ণ। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় ২০০০ বছর আগে ইস্রায়েলের বেথেলহেমে এক জীর্ণ গোসালায় রাত্রি দ্বিপ্রহরে এক কুমারী কন্যার গর্ভজাত হয়ে যীশু জন্ম নেন। পাপের পৃথিবীতে সরাসরি এলেন। যাতে সকল মানুল ঈশ্বরের সন্তান হয়ে স্বর্গের অধিকার ফিরে পায়। আনন্দ আর উল্লাসে মাতোয়ারা হয় বিশ্ব, সহভাগীতা ও সম্প্রীতির আবেশ ছড়িয়ে পড়ে প্রতিটি সমাজের রন্ধে রন্ধে।আমাদের দেশে খ্রীষ্টান ব্যাক্তিবর্গের বড়দিন হলো ঘরে-বাইরে-ধর্মগৃহে এক ঐতিহ্যবাহী মহোৎসব। সর্বত্রই যেন প্রস্তুতি, মিলনানন্দ, শোভা, প্রসাধন, সাজসজ্জা ও উৎসব উৎসব ভাব যা সর্বোতভাবে মানুষের অন্তরের রূপ, স্বাদ-সৌন্দর্য প্রকাশ করে ও অন্যদের সেই সৌন্দয্যের জগতে শান্তিভাবাপন্ন হতে আহবান করে।
বড়দিন মৌসুমে প্রস্তুতি ও বড়দিন উদযাপন এ ভিন্ন মাত্রা আসলেও ’আনন্দ’ মানসিক জীবনের গুরুত্বপূর্ন চাহিদা হিসেবে বিবেবচনা করে মানুষ অত্যাধুনিকরূপে কয়েকটি দিক বিশেষভাবে এসময়ে লক্ষ্য করে চলে। তা হলো:
ক) বড়দিনের অগ্রীম শুভেচ্ছা ও পুন:মিলন অনুষ্ঠান: সকল দেশের রাষ্ট্রিয় পর্যায় হতে ব্যক্তি পর্যায়ে ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহ হতেই বড়দিনের শুভেচ্ছাবিতরণের উদ্দেশ্যে মনলোভা কার্ড/বার্তা ও বিভিন্ন ভিডিও চিত্রায়নের মাধ্যমে দেয়া-নেয়া শুরু করে খ্রীষ্টবিশ্বাসীরসহ বিভিন্ন শুভাকাঙ্খিগন। বড়দিন উদযাপন পর্ব শেষ হলে, ডিসেম্বর ২৫ হতে ৩১ ডিসেম্বর তারিখের মধ্যে বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় ও প্রতিষ্ঠানে বড়দিন পুনমিলনী অনুষ্ঠান ও আনন্দঘন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। যা মানসিক প্রশান্তি ও মিলনের উৎস হিসেবে সমাজ ও পরিবারে বিশেষ প্রভাব সৃষ্টি করে।
খ) বড়দিনের আগমনী র্কীতন ও খ্রীষ্টের জন্মবার্তা ঘোষণা ঃ খ্রীষ্ট বিশ^াসীগণ বড়দিন আসার প্রায় ৪ সপ্তাহ পূর্ব হতেই যীশুখ্রীষ্টের আগমনকাল হিসেবে পালন করে। এ সময়ে গ্রামে গ্রামে, শহরে এলাকায় এলাকায় খ্রীষ্ট বিশ^াসীদের বাড়িতে বাড়িতে যীশুর জন্ম বারতা জানানোর উদ্দেশ্যে ভক্তিমূলক আগমনী/কীর্তন গান পরিবেশন করা হয়। এলাকায় এলাকায়, পাড়া ও মহল্লার বিভিন্ন বয়সী শিশু-কিশোর ও যুবক-যুবতীরা ঘুরে ঘুরে সকল খ্রীষ্টভক্তদের বাড়ীতে এই আগমনী কীর্তন পরিচালনা করে।
গ) বিভিন্ন বিপনীবিতান, বাজার, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, ও গৃহে সাজসজ্জা: ইদানিং সময়ে বড়দিন আসার প্রায় ১ মাস পূর্বে থেকেই দেশ-বিদেশে বিভিন্ন বিপনীবিতান, বাজার, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও খ্রীষ্টবিশ্বাসীদের নিজ নিজ বাড়ি সাজানো হয় । নানা রংয়ের রঙ্গিন লাইটিং, রুঙ্গিন কাগজের ঝরকা, উজ্জল তারা, বিভিন্ন রংঙ্গের আলোক সজ্জা, কাঁচা ফুল দিয়ে সাজানো ও আর্কষনীয় ভাবে ক্রিসমাস-ট্রি সাজিয়ে ও পাশে ক্রিষ্টমাস পাপাকে ও সাজিয়ে রাখা হয়। এসময়ে বড়দিন উপলক্ষ্যে বিভিন্ন বিপনীবিতান গুলোতে বিশেষ ছাড় বা বিশেষ অফার পেকেজে বেচা-কেনা চলে। দিকে দিকে মনে হয় খুশির জোয়ার ভেসে উঠে
ঘ) মূখরোচক বিভিন্ন খাবার তৈরী, পিঠাপুড়া, কেক তৈরী ও আনন্দ অনুষ্ঠান: ডিসেম্বর মাসের ১০ তারিখের পর হতে ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্তই খ্রীষ্ট ভক্তদের বাড়ীতে বাড়ীতে, দেশের বড় বড় রেস্তোরা, পিফাশপ, পিজাশপ ও কনফেকশনারীগুলোতে বিভিন্ন মুথরোচক মিষ্টি, পিঠা ও বং-বেরং এর কেক তৈরীর ধুম চলে। অধিকাংশ গ্রামে বড়দিন উপলক্ষে পুরো মাস জুড়ে মা-বোনেরা কঠোর ও আনন্দর্পূন প্রস্তুতি নিয়ে বিভিন্ন প্রকার পিঠা তৈরী করে। তার মধ্যে বিভিক্ষা বা বিয়ে পিঠা, পুলি, বিন্নি ভাতসহ পিঠা, বিন্নি পুলি, পাটিসাপটা, পুয়া, চিতই, পাকন, ডনেশ, দোদল, পাপঢ়, দুধ চিতল, ঝাই, খোলা ঝাই, চুটকি প্রভৃতি পিঠা উল্লেখ যোগ্য। ইদানিং কালে এরসাথে অনেক বাড়ীতে বাড়ীতে চটপটি, ফুসকা, হালিম ও চমুছার আয়োজনও রাখা হয়। এ সময়ে বিভিন্ন প্রকার কেক হচ্ছে বড়দিনের বিশেষ আর্কষণ। রাষ্ট্রিয় পর্যায় হতে শুরু করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠাানে ও বাড়ীতে বাড়ীতে এর জুরি মেলে প্লেইন, ফ্রুট ও বিভিন্ন ফ্লেভারের কেক দিয়ে। তবে ফুুটকেক, পান্সকেক, চকলেট কোটেড কেক, পেষ্ট্রিকেক, ও সফট প্লেন কেক অন্যতম। এতকিছু আয়োজনেও মনে হয় কিছু বাকী থেকে যায়। বিভিন্ন রকমের শীতের পিঠার পাশাপাশি মিষ্টি ও রসমালাইও আপ্যায়নে স্থান পায়। বর্তমান সময়ে শহরে শহরে বিভিন্ন হোটেল, মোটেল, রির্সোট ও পাঁচতারা হোটেলে বড়দিনকে ঘিরে আয়োজিত হয় নানান সংস্কৃতিক, খেলাধুলা ও কমিশন ছাড়সহ বিভিন্ন উপহার/গিফট সহভাগিতা অনুষ্ঠান। ক্রিসমাস-পাপা এ সময়ে ছোটদের জন্য বেশি আনন্দদায়ক ব্যক্তি, যিনি সকলকে বিভিন্ন খেলনা, চকলেট ও বিভিন্ন উপহার সামগ্রী দিয়ে থাকে। এ সময়ে পৃথিবীর সকল মানুষ এক ঐশ সন্তানের মতো এশাকার হয়ে আনন্দ ও মিলনের মেলায় এক হয়ে যায়। দেশে-দেশে, সমাজে-সমাজে স¤প্রীতির বন্ধনে বিভিন্ন জাতি, ধর্ম ও বর্ণের মানুষ মিলিত হয়ে বড়দিনের আনন্দের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়।
ঙ) খ্রীষ্ট বিশ্বাসীদের জন্য বড়দিনের খ্রীষ্টজাগ ও সৌহার্দ্য বিনিময়ঃ গোটা বিশ্বে ২৪ ডিসেম্বর রাত ১২টায় এবং ২৫ ডিসেম্বর সকালে বিভিন্ন গীর্জায় গীর্জায় বড়দিনের মহা-খ্রীষ্টজাগ আয়োজন ও অর্পন করেন সংশ্লিষ্ট ধর্মপল্লীর/ধর্মপ্রদেশের পাল-পুরোহিত/পালক/ধর্মপাল। নিজ নিজ পরিবারসহ প্রতিটি খ্রীষ্টভক্ত এ খ্রীষ্টজাগে অংশ নেন। ভক্তিগীতি, ক্ষমা, শান্তি প্রার্থনা, অর্পন ও প্রভুরভোজ ছাড়াও এখানে বিশেষ আকর্ষণ থাকে খড়কুটা দিয়ে সাজোনো নবজন্ম যীশুখ্রীষ্টের প্রতিকৃতিসহ ছোট্ট গোশালা ঘর, বিভিন্ন আকারে প্রদীপ ও রংবেরংয়ের মোমবাতি আলোক সজ্জা, ক্রিষ্টমাসট্রি, তারাখচিত লাইটিং, প্রবেশমুখে সাজানো গেইট ও বিভিন্ন রঙ্গের বেলুন। খ্রীষ্টযাগ শেষে আতশ-বাজি ফোটানো ও ঢোল-বাজনাসহ কীর্তনসহ নাচানাচির আনন্দই আলাদা। এসময়ে সকলের একে অপরের সাথে ভাব বিনিময়ের/কোলাকুলি/হেন্ড্যসেক ও হাগ বিনিময়ের মাধ্যমে আনন্দঘন হয়ে উঠে এই বড়দিন। আমাদের দেশসহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানগনও এই দিনে সকলের সাথে সৌহার্দ্য বিনিময় অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। এ যেন মানুষের মাঝে ঈশ^রের শান্তি-সস্প্রীতি ও সৌহার্দ্য স্থাপনের অন্যতম মাধ্যম।
এ শুভ দিনেই ধ্বনিত হয়েছে “যে জাতি অন্ধকারে বসেছিলো, তারা এক মহান আলো দেখতে পেল; যারা মৃত্যুছায়ার দেশে বাস করেছিলো তাদের উপর এক আলো উদিত হলো” (মথি:১৫-১৬)। বর্তমান পরিবর্তনীয় অস্থির সময়ে স¤প্রীতি ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ সকল মানুষের কাম্য। তাই শান্তি বিনিময় বড়দিন উৎসবের অন্যতম প্রধান আশীর্বাদ। বড়দিন উৎসবে শান্তি ও শুভেচ্ছা বিনিময় কেবল যদি মৌখিক শিষ্টাচারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে তবে সংস্কারের পক্ষে অবস্থানকারীদের শান্তির আশীর্বাদ হতে আমরা বঞ্চিত হবো। বাড়বে পরিবাবে পরিবারে, সমাজে, দেশে-দেশে বিভিন্ন প্রকার অন্যায্যতা, অন্যায় ও অশান্তি। বড়দিনে ঈশ্বর প্রদত্ত শান্তি অন্তরে গ্রহণ ও লালন করলে মানুষের মন থেকে দূর হতে পারে অহংকার, ঘৃণা, বিদ্বেষ, অবহেলা, নির্যাতন ও অশান্তি। সৃষ্টি হবে বিশ্বাস-আশা ও ভালোবাসা। সসকলের মর্যাদা ও অধিকার হবে সুপ্রতিষ্ঠিত। যার বিশদ প্রয়োজন আজকের এই পৃথিবীতে।
শান্তির ও ত্যাগের এ যীশুখ্রীষ্ট বেথেলহেমের জীর্ন গোসালায় জন্ম নিয়েছিলেন সত্যিই, কিন্তু তিনি বসবাস করেন প্রতিটি খ্রীষ্টভক্তের হৃদয়-মন্দিরে। আমাদের হৃদয়দ্বার অবমুক্ত রেখে যীশু খ্রীষ্টের মহান আর্দশ তথা বিশ্বাস, আশা, প্রেম, ভালোবাসা, ক্ষমা ও ত্যাগের মাধ্যমে পৃথিবীতে সকল মানুষের মাঝে শান্তি ও সম্প্রীতির সর্ম্পক স্থাপন ও ঐক্যবদ্ধ হওয়া আবশ্যক। আনন্দ ও শান্তির উপলক্ষ্য হিসাবে বড়দিন তখনই সার্থকতা পাবে। খ্রীষ্টবিশ্বাসীসহ সকল মানুষের প্রতি রইল বড়দিনের আনন্দময় শুভেচ্ছা। শুভবড়দিন।
নোয়ল গোনছালবেছ
লেখক: উন্নয়ন কর্মী ও খ্রীষ্টভক্ত-জপমালা রানী চার্চ-বাংলাদেশ।