ভ্রাম্যমাণ প্রতিবেদক >>> আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) প্রধান আতাউল্লাহ জুনুনী যেন এক আতঙ্কের নাম। তার বেপরোয়া সিদ্ধান্তের কারণে লাখ-লাখ রোহিঙ্গা হয়েছে বাস্তুচ্যুত। রোহিঙ্গাদের কাছে আতাউল্লাহ এক অভিশাপের নামও। যদিও তিনি নিজেকে রোহিঙ্গাদের মুক্তিকামী নেতা হিসেবে দাবি করেন। তার বিরুদ্ধে হত্যা, হামলা, চোরাচালান, অস্ত্র বাণিজ্যসহ এন্তার অভিযোগ রয়েছে।মঙ্গলবার (১৮ মার্চ) নারায়ণগঞ্জে আরসা প্রধান আতাউল্লাহসহ ৬ সদস্য গ্রেফতা করেছে পুলিশ। আটক আসামীদের ১০ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে নারায়ণগঞ্জ আদালত।এর আগে, সোমবার রাতে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের ভূমিপল্লী আবাসিক এলাকার একটি বাড়ি থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়।গ্রেফতারকৃত আরসা সদস্যরা হলেন,মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যের মৃত মৌলভী গোলাম শরীফের ছেলে আবু আহমদ জুনুনি (আতাউল্লাহ) (৪৮), আরাকান রাজ্যের মৃত লাল মিয়ার ছেলে মোস্তাক আহাম্মদ (৬৬), ময়মনসিংহ জেলার ঈশ্বরগঞ্জ থানার আতিকুল ইসলামের ছেলে মনিরুজ্জামান (২৪), মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যের মৃত আব্দুল আমিনের ছেলে সলিমুল্লাহ (২৭), সলিমুল্লাহর স্ত্রী আসমাউল হোসনা (২৩) ও আরাকান রাজ্যের নুর আলমের ছেলে মো. হাসান (১৫)।পরে আটক আসামীদেরকে নারায়ণগঞ্জ আদালতে তুলা হয়। আদালতে মামলার বাদি ১০ দিনে রিমাণ্ড আবেদন করলে আদালত ২ দফায় ১০ দিনের রিমাণ্ড মঞ্জুর করেন।মামলা সূত্রে জানা যায়, নাশকতার উদ্দেশ্যে আসামিরা নারায়ণগঞ্জ ও ময়মনসিংহসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় অবস্থান করছে। এরূপ গোপন সংবাদের ভিত্তিতে সোমবার রাতে অভিযান চালিয়ে আসামিদের গ্রেফতার করা হয়। পরে সিদ্ধিরগঞ্জ থানার আওতাধীন ৬ জন আসামিকে থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছে র্যাব-১১।মিয়ানমার ভিত্তিক স্বতন্ত্র বিশেষজ্ঞ রিচার্ড হর্সি বলেন, আতাউল্লাহ খুবই ক্যারিশমাটিক। সে সবাইকে অনুপ্রাণিত করে। এমনভাবে কথা বলে যেন রোহিঙ্গাদের কষ্ট অনুভব করতে পারছে তিনি। ধারণা করা হয় ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইনে পুলিশ চেকপোস্টে আতাউল্লাহর নির্দেশেই হামলা চালিয়েছিল আরসা। এরপর সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে লাখ লাখ রোহিঙ্গা।২০১৬ সালের অক্টোবরে এক ভিডিও বার্তায় রোহিঙ্গাদের বিদ্রোহী সংগঠন হিসেবে আরসা ও নেতা হিসেবে নিজেকে প্রকাশ্যে নিয়ে আসেন আতা উল্লাহ। ওই সময়ে মিয়ানমার সীমান্তে একটি হামলা চালিয়েছিল তারা।আরসা নেতার ঘনিষ্ঠ বেশ কয়েকজনের বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা এএফপি জানায়, ৩০ বছর বয়সেই সে একটি বিদ্রোহী সংগঠনের নেতৃত্ব দিচ্ছে। শুরুতে এই সংগঠনের অল্প কয়েকটি বন্দুক ছিল, বেশিরভাগ সময় লাঠি ও ছুরি হাতেই হামলা চালাত তারা।ওই সময় প্রকাশিত ভিডিওতে দেখা যায়, কয়েকজন মুখোশধারী ব্যক্তি তার সঙ্গে দাঁড়িয়ে রয়েছে আর আতাউল্লাহ মিয়ানমারের সরকারের মানবতাবিরোধী অপরাধের বর্ণনা দেন।রোহিঙ্গাদের বেশিরভাগই মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারাও স্বচ্ছলতার মুখ দেখেনি। তবে পাকিস্তানের করাচিতে মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম ও বেড়ে উঠা আতা উল্লাহর।এক আত্মীয়ের বরাত দিয়ে এএফপি জানায়, তার বাবা করাচিতে দারুল উলুম মাদ্রাসায় পড়াশোনার পর পরিবারসহ সৌদি আরব পাড়ি দেয়। সেখানে শিক্ষকতা শুরু করে তার বাবা। এরপর এক বিত্তশালী পরিবারের নজরে আসে আতাউল্লাহ। সেই পরিবারের সন্তানদের পড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয় তাকে। খুব তাড়তাড়িই তাদের কাছের মানুষ হয়ে যায় আতা উল্লাহ।আতাউল্লাহর সৌদি জীবন সম্পর্কে জ্ঞাত অপর এক আত্মীয় জানায়, ওই পরিবার তাকে (আতা) খুবই ভালোবাসত এবং একেবারে আপন মনে করত। কিন্তু ২০১২ সালে রাখাইনে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ১ লাখ ৪০ হাজার রোহিঙ্গা বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়ার ঘটনা নাড়া দেয় তাকে। এরপরই সৌদি আরবের বিলাসবহুল জীবন ছেড়ে রোহিঙ্গাদের সমর্থনে লড়াইয়ে নামে সে।শুরুতে সৌদি আরব থেকে কয়েক কোটি টাকা নিয়ে পাকিস্তানে ফিরে যায় আতাউল্লাহ। এই টাকা শীর্ষ জিহাদিদের কাছ থেকে সে অস্ত্র, যোদ্ধা ও প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে চেয়েছিল বলে করাচিতে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করা এক জঙ্গি জানিয়েছে। ওই জঙ্গির মতে, সে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের তালেবান এবং জম্মু-কাশ্মিরের বিচ্ছন্নতাপন্থী লস্কর-ই-তৈয়বার কাছ থেকে বড় অংকের অর্থের বিনিময়ে সহযোগিতা চায়।২০১২ সালে তার সঙ্গে কাজ করা এক সহযোগীর মতে, ‘প্রকাশ্যে এই জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়ানোর কথা বললেও রাখাইনে তাদের হয়ে যুদ্ধ করতে রাজি হয়নি। বেশিরভাগ পাকিস্তানি জঙ্গিই তার অনুরোধে সাড়া দেয়নি। তবে অনেকে অস্ত্র কেনার দেওয়া অর্থ ফেরত দেয়নি। আতাউল্লাহ অস্ত্রও পায়নি, ফিরে পায়নি টাকাও।পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল তালাত মাসুদ বলেন, বার্মায় জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর জিহাদের ডাক আসলে মুসলিমদের সহানুভূতি অর্জনের জন্য প্রচারণা ছাড়া কিছুই নয়।২০১২ সালে পাকিস্তানে আতাউল্লাহকে কাছ থেকে দেখা কয়েকজন জঙ্গি জানায়, সে পাকিস্তান ছেড়ে যাওয়ার সময় একজন জাতীয়তাবাদীতে পরিণত হয়। জঙ্গিবাদের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলে। কারণ যাদেরকে সে অর্থ দিয়েছিল তারা কোনও সহযোগিতা করেনি। অনেকে নাকি তার অর্থ চুরিও করেছে।আতাউল্লাহ নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়া রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের মতো (আরসা) রাখাইনের অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠীর রোহিঙ্গা গোষ্ঠীর সঙ্গে বৈঠক করে।আরসার নেতার সঙ্গে যোগাযোগ আছে এমন সূত্র জানায়, রাখাইনের নতুন সহিংসতা পর অনেক জঙ্গি গোষ্ঠীই আতাউল্লাহর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিতে চাইছে। তবে আতাউল্লাহ তাদের সহযোগিতা নিতে রাজি হয়নি। যদিও অস্ত্র ও চিকিৎসার খুব প্রয়োজন ছিলো তাদের। কয়েকজন সহযোগী সহযোগিতা নেওয়ার পরামর্শ দিলেও সে রাজি হয়নি।আতাউল্লাহর আশঙ্কা, এতে করে তাদের মুক্তিকামী আন্দোলন বাধাগ্রস্ত হতে পারে। অন্যান্য জঙ্গি গোষ্ঠীর মাঝে হারিয়ে যেতে পারে তাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য।আরসা’র পাকিস্তানি প্রতিনিধি নুর হুসেন বার্মি জানায়, তাদের উগ্রতার কারণে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের দুর্দশা বেড়েছে। সে আর কাউকে কাজ করতে দেয় না কারণ এতে করে অবস্থান হারানোর ভয় রয়েছে।বিশেষজ্ঞ রিচার্ড হর্সির ভাষায়, আতাউল্লাহর বিদ্রোহ রোহিঙ্গাদের হিতে বিপরীত হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। আরসা রোহিঙ্গাদের অধিকারের পক্ষে লড়াই করছে, এমন দাবি গ্রহণযোগ্যভাবে প্রতিষ্ঠা করা খুব কঠিন।রোহিঙ্গা নেতা মাস্টার মুহিব্বুল্লাহকে হত্যা করা হয়েছিল আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) প্রধান আতাউল্লাহ আবু আম্মার জুনুনির নির্দেশেই। গ্রেপ্তারের পর আরসার শীর্ষ নেতা নুর কামাল ওরফে সমিউদ্দিনের বরাতে ২০২৩ সালের ১৬ অক্টোবর এসব তথ্য জানায় র্যাব-১৫।র্যাব জানায়, রোহিঙ্গাদের শান্তিপূর্ণ প্রত্যাবাসনের পক্ষে থাকায় মুহিব্বুল্লাহর ওপর ক্ষুব্ধ ছিল আরসা। সংগঠনের প্রধান আতাউল্লাহ তাকে মিয়ানমারে আরসার সঙ্গে কাজ করার প্রস্তাব দেন, কিন্তু তিনি রাজি না হওয়ায় তাকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।২০২১ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর কুতুপালং শরনার্থী শিবিরের এক বৈঠকে মুহিব্বুল্লাহ হত্যার পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়। দুই দিন পর, ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে ১২ জনের একটি কিলার গ্রুপ দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে মুহিব্বুল্লাহর কার্যালয়ে প্রবেশ করে এবং তাকে গুলি করে হত্যা করে।
Leave a Reply