আজ ২২শে মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৫ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ে বিমানের মনোপলি; বাড়তি মূল্য দিচ্ছে যাত্রীরা


চাটগাঁর সংবাদ ডেস্ক

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসকে যাত্রী ও কার্গো হ্যান্ডলিং পরিষেবার ব্যবস্থাপনার জন্য অর্থ প্রদান করা সত্ত্বেও ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কার্যক্রম পরিচালনা করা বিদেশি এয়ারলাইনগুলোকে এর জন্য নিজস্ব খরচে কর্মী নিয়োগ দিতে হচ্ছে। যার ফলে তারা টিকেটের দামও বেশি রাখছে।

এয়ারলাইনস অপারেটর কমিটির (এওসি) মতে, এই বিমানবন্দরের একমাত্র গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং এজেন্ট বাংলাদেশ বিমানকে—গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং পরিষেবার জন্য প্রতি ফ্লাইটে ২,২০০ থেকে ৬,০০০ ডলার, এবং কার্গো অপারেশনের জন্য প্রতি কেজিতে অতিরিক্ত দশমিক শূন্য ৭ সেন্ট দেয়। এসব ফি দেওয়ার পরেও সেবাগ্রহীতা প্রতিটি এয়ারলাইনকে মাত্র দুই থেকে তিনজন গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং কর্মী দেওয়া হয়, যা তাদের ফ্লাইট কার্যক্রম পরিচালনার জন্য মোটেও যথেষ্ট নয় বলে জানিয়েছে এওসি।

প্যাসেঞ্জার বোর্ডিং (যাত্রীদের ফ্লাইটে ওঠানো সংক্রান্ত কার্যক্রম), ব্যাগেজ হ্যান্ডলিং, কার্গো ব্যবস্থাপনা ও উড়োজাহাজ সচল রাখার বিভিন্ন সহায়ক কার্যক্রম রয়েছে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং পরিষেবার মধ্যে।

ঢাকায় কার্যক্রম পরিচালনার খরচ বেশি

এয়ারলাইনগুলোর দাবি, উন্নয়নশীল অনেক দেশ, এমনকী এ অঞ্চলের কিছু দেশের চেয়েও—ঢাকা বিমানবন্দরে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের খরচ অনেক বেশি। যেকারণে প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে ফ্লাইট পরিচালনা করা প্রতিযোগী এয়ারলাইনগুলোর চেয়ে—এখান থেকে ফ্লাইট পরিচালনাকারী এয়ারলাইনগুলোর পরিচালন ব্যয় অনেকটা বেড়ে যায়।

ঢাকা বিমানবন্দর থেকে ফ্লাইট পরিচালনাকারী একটি বিদেশি এয়ারলাইনের কার্গো ম্যানেজার বলেন, “১০০ টনের বোয়িং-৭৭৭ উড়োজাহাজের কার্গো চার্জ ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার মতো প্রতিবেশী দেশগুলোতে সাড়ে ৩ থেকে ৪ হাজার ডলার পর্যন্ত। কিন্তু, ঢাকা এয়ারপোর্টে একই পরিমাণ কার্গোর চার্জ সর্বোচ্চ ২০ হাজার ডলার পর্যন্ত-ও হয়।”

সম্প্রতি ঢাকা বিমানবন্দরের নবনির্মিত তৃতীয় টার্মিনালের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের কাজও বাংলাদেশ বিমানকে দেওয়া হয়েছে। এতে আরও উদ্বেগ বেড়েছে বিদেশি এয়ারলাইনগুলোর। আগের দুটি টার্মিনালের (১ ও ২ নং) হ্যান্ডলিং এজেন্টও বিমান।

তাই প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সেবার মান বাড়াতে—একাধিক গ্রাউন্ড হ্যান্ডলার নিয়োগ দিয়ে এসব সমস্যার সমাধানের জন্য বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়কে একটি প্রস্তাব দিয়েছে এওসি।

বিদেশি এয়ারলাইনগুলোর ওপর বাড়তি ব্যয়ের বোঝা

বিদেশি এয়ারলাইনের সূত্রগুলোর মতে, ঢাকা বিমানবন্দরে ফ্লাইট কার্যক্রম পরিচালনা করছে ৩৮টি বিদেশি এয়ারলাইন। তাদের মোট কর্মীর সংখ্যা প্রায় ১,১৫০ জন। কিন্তু, গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের জন্য অতিরিক্ত জনবল নিয়োগ দিতে বাধ্য না হলে কর্মীর সংখ্যা প্রায় ৮ গুণ কম রাখা যেত। যেমন সংযুক্ত আরব আমিরাত-ভিত্তিক এয়ারলাইন এয়ার এরাবিয়াকে ঢাকা বিমানবন্দরে প্রায় ৪০ জন কর্মী নিয়োগ দিতে হয়েছে। এরমধ্যে ২৮ জন যাত্রী পরিষেবা ও ১২ জনকে কার্গো ব্যবস্থাপনার কাজ করছেন।

তবে বিদেশি এয়ারলাইনগুলোর কর্মকর্তারা বলছেন, গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং পরিষেবার প্রয়োজন এমন ফ্লাইটের সংখ্যার ওপর ভিত্তি করে এই সংখ্যা সর্বোচ্চ চারজন কর্মচারীর বেশি হওয়া উচিত নয়।

এয়ার এরাবিয়ার এয়ারপোর্ট অপারেশনস ম্যানেজার দিলারা হোসেন বলেন, “নিরাপত্তা ও সেবার মান নিশ্চিত করতে, প্রায় সব এয়ারলাইনকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কর্মী নিয়োগ দিতে হয়েছে। একারণে কোনো কোনো এয়ারলাইনের কর্মীর সংখ্যা ৬০ থেকে ৭০ পর্যন্ত হয়ে গেছে। শুধু নিয়োগ দিলেই হয় না, তাদেরকে আমাদের প্রশিক্ষণও দিতে হয়। এতেও অর্থ ব্যয় হয়। সব মিলিয়ে আমাদের পরিচালন ব্যয় বেড়ে যায়, যার প্রভাব পড়ছে আমাদের টিকেটের দামে।”

দিলারা এওসি’র চেয়ারপারসন, তিনি আরও বলেন, ‘পেশাদার কয়েকটি গ্রাউন্ড হ্যান্ডলার নিয়োগ দিলে কেবল বিমানবন্দরের ভাবমূর্তির উন্নতি হবে না, একইসঙ্গে জাতীয় পর্যায়েও তা ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।”

“বর্তমানে মনোপলি করা গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং এজেন্টের থেকে অনেক বছর ধরে আমরা বহু প্রতিশ্রুতি শুনেছি, কিন্তু তার বাস্তবায়ন হয়েছে সামান্যই” – যোগ করেন তিনি।

কাতার এয়ারওয়েজের কার্গো ম্যানেজার সুহেদ আহমেদ চৌধুরী বলেন, “আমরা গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং ফি দেওয়ার পরেও বিমানবন্দরে ৭০ জন কর্মী নিয়োগ করতে হয়েছে। যেসব কাজ বাংলাদেশ বিমানের করার কথা—সেগুলো আমাদের কর্মী দিইয়ে করাতে হচ্ছে। এখন আমরা বেশি কিছু চাই না, আমরা চাই গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং নিয়ে বিমানের সাথে আমাদের যে চুক্তি রয়েছে, সেটা তারা সঠিকভাবে পালন করুক।”

প্রতিবেশী দেশগুলোর চেয়ে বাংলাদেশে টিকেটের দাম বেশি, ক্ষতিগ্রস্ত যাত্রীরা

খাতসংশ্লিষ্টদের মতে, প্রতিবেশী দেশগুলোর চেয়ে বাংলাদেশে ফ্লাইটের টিকেটের দাম এখনও বেশি। ওমরাহ মৌসুমে যাত্রীদের টিকেট চাহিদা বেশি হওয়ায়—চলতি বছরের ১ ডিসেম্বর থেকে দেশি ও বিদেশি এয়ারলাইনগুলো ভাড়া প্রায় ১০০ ডলার বাড়িয়েছে বলে জানান হক ইন্টারন্যাশনাল ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস-এর কর্মকর্তা মাহমুদুল হক পিয়ারু।

তিনি বলেন, ঢাকা থেকে রিয়াদ যেতে বাংলাদেশি অভিবাসী কর্মীদের ৫৫ থেকে ৭৭ হাজার টাকা টিকেটের দাম দিতে হয়। বুকিংয়ের সময়ের ওপর নির্ভর করে, সাধারণত এক মাস আগেই তা অগ্রিম দিতে হয়। অথচ কলকাতা থেকে রিয়াদের টিকেটের দাম ঢাকার থেকে প্রায় ১০ হাজার টাকা কম।

ট্রাভেল এজেন্টরা বলেছেন, বাংলাদেশ থেকে আকাশপথে ভ্রমণে টিকেটের দাম বেশি হওয়ার অন্যতম কারণগুলো হচ্ছে—ভ্রমণ চাহিদা বাড়া, উপলব্ধ আসনের সীমিত সংখ্যা এবং টিকেটের একটি সিন্ডিকেটের সক্রিয় থাকার অভিযোগ, যারা কালোবাজারি করে বেশি দামে টিকেট বিক্রি করে। এছাড়া, অন্যান্য কারণের মধ্যে আছে—ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমা এবং উচ্চমূল্যের জেট ফুয়েল ক্রয়সহ বিভিন্ন খাতে এয়ারলাইনগুলোর উচ্চ পরিচালন ব্যয়।

অভিযোগ অস্বীকার বাংলাদেশ বিমানের

তবে যথাযথ গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং সেবা দিতে না পারার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন বাংলাদেশ বিমানের কর্মকর্তারা। এগুলোকে তাঁরা ‘গৎবাধা ও ভিত্তিহীন’ অভিযোগ বলে উল্লেখ করেন।

বিমানের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ বিভাগ) ও মুখপাত্র বোসরা ইসলাম বলেন, “এসব অভিযোগ বিমানকে তার গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং কার্যক্রম থেকে বিরত রাখতে স্বার্থান্বেষী একটি মহলের অপপ্রচারের অংশ। সম্প্রতি আমরা নতুন কর্মী নিয়োগ দিয়েছি, এবং আরও নিয়োগের প্রক্রিয়াও চলছে। বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালে সার্বিক সেবা দিতে আমরা পুরোপুরি প্রস্তুত আছি।”

বিমানবন্দরের সক্ষমতা দ্বিগুণ হচ্ছে: বিমান কি সামলাতে পারবে?

তৃতীয় টার্মিনালটি পুরোপুরি চালু হলে ঢাকা বিমানবন্দরের বার্ষিক যাত্রী ও কার্গো হ্যান্ডলিং সক্ষমতা দ্বিগুণ হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এতে বিদ্যমান টার্মিনালগুলোসহ বিমানবন্দরের মোট বার্ষিক যাত্রী হ্যান্ডলিং সক্ষমতা ২ কোটি ৪০ লাখে পৌঁছাবে। বর্তমানে বিমানবন্দরের বার্ষিক ৮০ লাখ যাত্রী এবং ৫ লাখ টন কার্গো হ্যান্ডলিং সক্ষমতা রয়েছে।

আগামী বছরের ডিসেম্বরে তৃতীয় টার্মিনালটি চালু হওয়ার কথা রয়েছে। বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, নতুন টার্মিনালটি চালু হওয়ার পরে একসাথে প্রায় ২০টি উড়োজাহাজের হ্যান্ডলিং করা সম্ভব হবে।

সূত্রগুলো জানায়, এজন্য বিমানের মোট ৩ হাজার ৮৭৮ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর প্রয়োজন হবে, কিন্তু বর্তমানে রয়েছেন মাত্র ২ হাজার ৪৯৪ জন। আগামী বছরের মধ্যেই আরও ১ হাজার ৩৮৪ জনকে নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ দিতে হবে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাটিকে।

গত ১ ডিসেম্বর নিজস্ব সক্ষমতা সম্পর্কে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে বাংলাদেশ বিমান। এসময় গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং পরিচালনার জন্য কর্মী নিয়োগ, প্রশিক্ষণ ও সরঞ্জাম সংগ্রহের বিশদ পরিকল্পনাও তুলে ধরা হয়।

বিমানের আয়ের একটি বড় অংশই আসে– গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং সেবা প্রদানের মাধ্যমে। এই খাত থেকে ২০২৩ সালে বিমান আয় করেছে প্রায় ১,৫০০ কোটি টাকা।

গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের সমস্যা সমাধানে এওসির প্রস্তাব

বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের বেশকিছু গণশুনানির সময়, বিদেশি এয়ারলাইনগুলোর পাশাপাশি অভিবাসী বাংলাদেশি কর্মীরাও বাংলাদেশ বিমানের বিভিন্ন সেবার বিষয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।

গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের সমস্যাগুলো সমাধানে গত ২ ডিসেম্বর সদ্যপ্রয়াত বেসামরিক বিমান পরিবহন উপদেষ্টা এ. এফ. হাসান আরিফকে একটি লিখিত প্রস্তাবনাও দেয় এওসি।

বর্তমান গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং কর্তৃপক্ষের কোনো ‘সিঙ্গেল পয়েন্ট অব কন্টাক্ট’ নেই উল্লেখ করে এতে বলা হয়, “দরকারি সেবা পেতে আমাদের একাধিক বিভাগের সাথে যোগাযোগ করতে হচ্ছে।”

এছাড়া, কর্মীদের শিফট পরিবর্তনের ব্যবস্থাপনা এবং চেক-ইন কাউন্টারগুলো থেকে শুরু করে গেইট, র‍্যাম্প, লোডিং কর্মী ও অপারেটরসহ সবখানে কর্মী সংকটের মতো সমস্যার কথাও তুলে ধরা হয়। অনেক সময় পরের শিফটের কর্মী আসার আগেই আগের শিফটের কর্মীদের কর্মঘণ্টা শেষ হলে তারা চলে যান বলেও এতে জানানো হয়।

এওসি গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং এজেন্ট এবং বিদেশি বিমান সংস্থাগুলোর মধ্যে কোনো শাস্তিমূলক পরিষেবা স্তরের চুক্তি (এসএলএ) নেই এমন কথা উল্লেখ করে বলেছে, এতে সেবার মান ও জবাবদিহিতা ক্ষুণ্ণ হচ্ছে।

বিমানবন্দরের কার্যক্রম পরিচালনায় নিরাপত্তা সংস্কৃতির অভাব, বিশেষ করে কর্মী ও সরঞ্জামের জন্য র‍্যাম্প নিরাপত্তা অনুশীলনের পাশাপাশি চলমান উড়োজাহাজের সাথে ডক করার সময় সরঞ্জাম পরিচালনার জন্য অপারেটরদের অভাব নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সংগঠনটি।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     এই বিভাগের আরও খবর